‘পিরের মানা’, ভোট দেন না চাঁদপুরের দক্ষিণ রূপসার নারীরা

বাড়ির বাইরে বিভিন্ন কাজে গেলেও চাঁদপুরের দক্ষিণ রূপসা ইউনিয়নের নারীরা ‘প্রায় অর্ধশতাব্দী ভোট দেন না’।

আল ইমরান শোভন চাঁদপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Dec 2021, 11:13 AM
Updated : 24 Dec 2021, 11:26 AM

ইউনিয়নটির জনপ্রতিনিধিদের ভাগ্য নির্ভর করে পুরুষ ভোটারদের ওপর। এমনকি সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যরাও নির্বাচিত হন শুধু পুরুষদের ভোটে।

জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার এই ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান মো. ইসকান্দার আলী।

তিনি বলেন, “মওদুদুল হাসান জৈনপুরী নামে এক পির প্রায় ৫০ বছর আগে ইউনিয়নের গৃদকালিন্দিয়া এলাকায় আস্তানা গাড়েন। তার আদি বাড়ি ছিল ভারতের জৈনপুরী এলাকায়।

“তার নির্দেশে এলাকার নারীরা স্থানীয় থেকে জাতীয় কোনো পর্যায়ের নির্বাচনেই ভোট দেন না। ওই পির প্রায় ৩০ বছর আগে মারা গেলেও এলাকার নারীরা এখনও তার নির্দেশ অনুসরণ করছেন।”

৭৪ বছর বয়সী এই জনপ্রতিনিধি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এলাকায় কলেরা মহামামী দেখা দেয়। মহামারী থেকে রক্ষা পেতে দোয়ার আয়োজন করে এলাকাবাসী।

“তখন মওদুদুল হাসান জৈনপুরী নারীদের পর্দা মেনে চলার আদেশ দেন।”

যুগ যুগ ধরে সেই আদেশ মেনে চললেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে নানা কাজে অংশ নেন নারীরা। পড়াশোনা, বাজার-সওদাসহ প্রয়োজনীয় অনেক কাজই তারা করেন। শুধু ভোট দেওয়া ছাড়া।

রাহেলা খাতুন নামে ৫৫ বছর বয়সী এক নারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পিরের দেয়া নির্দেশ মেনে আমরা কখনোই ভোট দিতে যাই না। ভোটের দিন বাড়িতেই সময় কাটে। শুধু পুরুষ সদস্যরা ভোট দিতে যান।”

তবে রৌজ আক্তার নামে এক তরুণী বলেন, তিনি এবার ভোটার হয়েছেন এবং আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট যাবেন।

“আমার ভোট দেওয়ার ইচ্ছে আছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ভোট দিতে যাব।”

তার বান্ধবী বা অন্য কোনো নারীও এবার ভোট দিতে যাবেন কিনা তা তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি।

পিরের নির্দেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, “শুনেছি পির সাহেব নারীদের পর্দার মধ্যে চলাফেরা করার কথা বলে গেছেন। এখানকার সব নারীই কাজের প্রয়োজনে বাইরে বের হচ্ছেন। সব কাজ করছেন। তাহলে ভোটাধিকার প্রয়োগে সমস্যা কোথায়?”

নারীদের ভোটকেনেন্দ্র যেতে উৎসাহিত করতে কেউ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ করেন রৌজ।

“প্রশাসন, ভোট প্রার্থী বা নির্বাচন কর্মকর্তারা নারীদের ভোট দিতে উৎসাহিত করতে খুব একটা কাজ করেনি। এই নির্বাচনেও তেমন কোনো লক্ষণ দেখছি না।”

ফরিদগঞ্জ উপজেলা নির্বাচন দপ্তরের তথ্যমতে, ইউনিয়নটিতে মোট ভোটার আছেন ১৮ হাজার ৭৮৬ জন। তাদের মধ্যে নারী ভোটার ৯ হাজার ৪৫ জন।

আগামী ৫ ডিসেম্বর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী মো. শরীফ হোসেন। তিনি নারীদের ভোট দিতে উৎসাহী করতে কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানান।

শরীফ বলেন, “শুনেছি হুজুর বলেছিলেন নারীদের পর্দানশীন হওয়ার জন্য। ভোটাধিকার প্রয়োগ না করার কথা বলেননি তিনি। এখন নারীরা বাজার করা থেকে শুরু করে সকল কাজই করেন। আশা করি তারা তাদের ভোটের অধিকারও প্রয়োগ করবেন।”

ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান ৪-৫-৬ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত আসনের সদস্য মনোয়ারা বেগম নারীরা ভোট না দেওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন।

তিনি বলেন, “আমি নিজে একজন নারী। কিন্তু নির্বাচিত হই পুরুষের ভোটে। এই উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের ১৩টিতেই নারীরা ভোটকেন্দ্রে যান এবং ভোট দেন।

“কিন্তু আমার ইউনিয়নের নারীরা ভোট দিতে যান না। আমরা তাদের কাছে যাই। তাদের হাতে-পায়ে ধরে বোঝাই। ভোটকেন্দ্রে নারী এজেন্টও থাকে। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। এটা অনেক কষ্টের বিষয় আমাদের জন্য। আমরা চাই পুরুষ ভোটারদের পাশাপাশি আমাদের মা-বোনদের ভোটে আমরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হই।”

ফরিদগঞ্জের ইউএনও শিউলী হরি বিষয়টি অবগত আছেন বলে জানান। এ বিষয়ে ডিসি কোনো নির্দেশনা দিলে সেই অনুযায়ী কাজ করবেন বলেও তিনি জানান।