নদী ভাঙন: এবারও ঝুঁকিতে হাজার হেক্টর এলাকা

তবে গত দেড় যুগে নদী ভাঙনের ঝুঁকির মাত্রা অনেকটা কমিয়ে আনা গেছে।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Sept 2022, 07:44 PM
Updated : 17 Sept 2022, 07:44 PM

ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি মিলে পরিবারের ২২ জনকে নিয়ে হঠাৎ করেই আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন মুন্সীগঞ্জের বাংলাবাজার ইউনিয়নের শম্ভু হালদারকান্দি গ্রামের যুগমায়া রানী। সাত দিন আগে যেখানে তাদের ঘর ছিল, সেখানে এখন প্রমত্তা পদ্মা। 

যুগমায়ার মতো প্রায় ৩০০ পরিবার এখন ভিটে-মাটি হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে কিংবা অন্য গ্রামে স্বজনদের আশ্রয়ে দিন কাটাচ্ছেন। গত দেড় মাসে শম্ভু হালদারকান্দি আর পাশের সরদারকান্দি গ্রামের অনেকটাই চলে গেছে পদ্মার গ্রাসে।

পদ্মা কেবল মুন্সীগঞ্জে নয়, ফরিদপুরেও গ্রাস করছে জনবসতি, ফসলের জমি। মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলায় ভাঙছে ইছামতী আর ধলেশ্বরীর তীর। মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার চর পাচুড়িয়ার মানুষকে নিরাশ্রয় করছে মধুমতি।

টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে যমুনা, শেরপুরের নালিতাবাড়ী পৌর শহরের তারাগঞ্জ আড়াইআনী এলাকায় ভোগাই নদী, ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলায় বিষখালীর ভাঙনও হাহাকার বাড়াচ্ছে। লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলা একটু একটু করে ভেঙে নিচ্ছে মেঘনা।

দেশে নদী ভাঙনের এই চিত্র নতুন নয়। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) তাদের ২০২২ সালের পূর্বাভাসে বলছে, চলতি মওসুমে দেশের নদী অববাহিকার ১২ জেলার ১৭টি এলাকা ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে।

এই পূর্বাভাস ঠিক হলে প্রায় ১৮০০ হেক্টর জমি, বসতবাড়িসহ সড়ক, বাঁধ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, কবরস্থান, এতিমখানাসহ অন্যান্য অবকাঠামো মুছে যেতে পারে মানচিত্র থেকে।

সিইজিআইএস এর ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা আব্দুল্লাহ খান অবশ্য বলছেন, সরকারের নেওয়া নানা উদ্যোগের ফলে গত দেড় যুগে নদী ভাঙনের ঝুঁকির মাত্রা অনেকটা কমিয়ে আনা গেছে।

“আমরা নদী ভাঙনের পূর্বাভাস দিয়ে আসছি ২০০৫ সাল থেকে। তখন এরকম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ছিল অন্তত ৫০টি, এখন সেটা ১৭টিতে নেমে এসেছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন তীর রক্ষা উদ্যোগের ফলে এটা সম্ভব হয়েছে।”

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের এ সদস্য বলেন, বাংলাদেশে এখন নদী ভাঙনের প্রবণতা দেখা যায় সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শেষে আর অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে। সিইজিআইএস এবার তিনটি নদীর ভাঙনের ঝুঁকির পূর্বাভাস দিয়েছে।

“যমুনা, গঙ্গা, পদ্মা- এই বড় তিনটি নদীর ১৭টি জায়গা চিহ্নিত করেছি। এ ভাঙনের পূর্বাভাসে বলেছি- ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো বিলীন হওয়ার এ সম্ভাবনা প্রায় ৫০%।”

আশির দশকে যেখানে নদী অববাহিকাগুলোর সাড়ে ৯ হাজার হেক্টর এলাকা ভাঙত, এখন তা ৩ হাজার হেক্টরের নিচে নেমে এসেছে জানিয়ে মালিক ফিদা বলেন, “দুটি কারণে এটা ঘটছে। প্রথমত প্রাকৃতিকভাবেই ভাঙন কমেছে। গত দশক ধরে যমুনা নদী স্টেবল (স্থির) অবস্থায় রয়েছে। তাতে মনে হচ্ছে- পানি ও সেডিমেন্টের (নদীর তলানি) মধ্যে ভারসাম্য রয়েছে।”

সবচেয়ে বিপজ্জনক এলাকা

মালিক ফিদা বলেন, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী ও মাদারীপুর- এই চার জেলা এবার নদী ভাঙনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে তারা মনে করছেন। 

ঝুঁকিপূর্ণ বাকি জেলাগুলো হল- কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, মানিকগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, ফরিদপুর। ভাঙনপ্রবণ ১৭টি জায়গার মধ্যে নয়টি যমুনায়, ছয়টি গঙ্গায় আর দুটি পদ্মায়।

পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এসব এলাকার প্রায় ৬০০ হেক্টর কৃষিজমি, ১৬৫ হেক্টর বসতবাড়ি, সোয়া ২ কিলোমিটার সড়ক, ২ দশমিক ৮ কিলোমিটার বাঁধ, ২৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ১৭টি মসজিদ, ৫টি হাঁটবাজার, দুটি কবরস্থান, একটি এতিমখানা ও অন্যান্য স্থাপনা ভাঙনের কবলের পড়তে পারে।

ঝুঁকিপূর্ণ অববাহিকা

  • যমুনা: উলিপুর, সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধাসদর, সাঘাটা, শাহজাদপুর, চররাজিবপুর, ফুলছড়ি, দেওয়ানগঞ্জ, কালিহাতি, টাঙ্গাইল সদর, চৌহালি, নাগরপুর।

  • গঙ্গা: দৌলতপুর, ভেড়ামারা, মিরপুর, ভেড়ামারা, পাবনা সদর, রাজবাড়ি সদর, গোয়ালন্দ, চারঘাট, রাজশাহী, সুজানগর।

  • পদ্মা: পাবনা, সদরপুর চরভদ্রাসন, সদরপুর, শিবচর।

নদী ভাঙনের যে পূর্বভাস দিয়েছে সিইজিআইএস, তার ভিত্তিতে তিন ভাগে কাজ করা যায় বলে মনে করেন জাতীয় নদী কমিশনের সদস্য মালিক ফিদা।

  • নদী তীর রক্ষার নকশ/পরিকল্পনায় এসব তথ্য কাজে লাগতে পারে।

  • কোথাও ভাঙন হলে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নিতে হয়; সরকার আগে থেকে পূর্বাভাস পেলে তা মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে পারে।

  • ভাঙনপ্রবণ এলাকায় কী ধরনের স্থাপনার ক্ষতি হতে পারে, সেসব অস্থাবর সম্পত্তি কিছুটা হলেও আগে থেকে সরিয়ে নেওয়া যায়। স্থানীয় প্রশাসন সাধারণকে নিয়ে স্থাপনা ও শস্য আগাম সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করলে ক্ষতি কিছুটা হলেও কমবে।

বন্যার ঝুঁকি, বালি তোলার বিপদ

বর্ষা মৌসুমে জুলাই-অগাস্ট মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হলেও সেপ্টেম্বরে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বন্যার পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

জুলাই মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৫৮ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে এ বছর। অগাস্টে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের তুলনায় ৩৬ শতাংশ কম হয়েছে।

সেপ্টেম্বর মাসের পূর্বাভাসে অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান জানান, এ মাসে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে ভারি মৌসুমী বর্ষণে স্বল্প থেকে মাঝারি মেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

চলতি বছর জুনের দ্বিতীয়ার্ধে সিলেট, সুনামগঞ্জসহ ১৮ জেলায় এক দফা বন্যা হয়। ওই বন্যায় প্রায় ৮৭ হাজার কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয় বলে সরকারের হিসাব বলছে।

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম জানান, উজানে সীমান্তবর্তী এলাকায় ভারি বর্ষণ হলেই ভাটিতে বন্যা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনে চরম আবহাওয়াগত ঘটনার তীব্রতা বেড়েছে এবং তা অনিয়মিতভাবেই।

“বন্যা প্রবণ দেশে। এতবড় ডেল্টার নিচে আছি, বন্যা ব্যবস্থাপনাটা এমন হতে হবে যেন, বন্যা আমাদের সবচেয়ে কম ক্ষতি করে। বন্যায় আগে সহজে যেভাবে পানি নেমে যেতে পারত এখন তা হচ্ছে না; প্রচুর নগরায়ন হয়েছে।

“অপরিকল্পিত বাধের কারণে নাব্য সঙ্কট হয়েছে। সব করতে হবে বন্যা ম্যানেজ করে; যাতে বন্যার সঙ্গে বসবাস করতে পারি।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যাপ্রবণ দেশে প্রতিবারই বন্যার পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে নদীর ভাঙন তীব্র হয়। সেই সঙ্গে রয়েছে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন।

কয়েক বছরের তুলনায় কম বন্যা হলেও সামনে ঝুঁকি রয়ে গেছে। আগাম জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি রক্ষা, পুনরুদ্ধার ও ভাঙন রোধে নদীর জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করার ওপর জোর দিচ্ছেন তারা।

বুয়েটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম যৌথ নদী কমিশনের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি শক্তিশালী ফ্লাড ওয়ার্নিং ব্যবস্থার তৈরিরও তাগিদ দিয়েছেন।

জলাধার ভরাট ও অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে জোর দিয়ে তিনি বলেন, “নদীর যে গভীরতা হারিয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে। ডিটেইল স্টাডি দরকার। অনেক রাস্তাঘাট, অনেক স্থাপনা, ফ্যাক্টরি, মিল হয়েছে। সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে পানি প্রবাহের কথা মাথায় রেখে করা হয়নি। এখন থেকে এ জিনিসগুলো সাধারণ মানুষের মাথায় রাখতে হবে।”

বালু উত্তোলন তীব্র হলে নদী ভাঙনের প্রবণতা দেখা দেবে। স্থানীয় বালু মহালে বালু উত্তোলনের যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে বলে মনে করেন সিইজিআইএস এর ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা।

তিনি বলেন, “সুপারিশ করছি- একটি বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা করে দেখা দরকার সেডিমেন্ট (তলানির পলি/বালু) কীভাবে তোলা যায়। এ সমীক্ষার পরেই যেন জেলা প্রশাসন কী পরিমাণ বালু উত্তোলন করতে পারবে সে বিষয়ে ইজারা দেন।”

আর সেটা করা গেলে বালু উত্তোলনের কারণে ভাঙ্গন রোধ করাও সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।