এখন উদ্বোধন হলেও অপেক্ষায় থাকতে হবে আরও কিছুদিন। আগামী ১ নভেম্বর থেকে দ্বিতল এ সেতু দিয়ে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হবে।
Published : 10 Oct 2023, 01:44 AM
প্রমত্তা পদ্মা সাঁই করে পাড়ি দিয়ে মানুষ চলছে এক বছরের বেশি সময় ধরে; এবার সেই পথে খুলছে নতুন দুয়ার, যোগ হচ্ছে যোগাযোগের ভিন্ন মাত্রা।
স্বপ্নের এ সেতু চালুর সঙ্গে সঙ্গে ঘুচেছে নদীতে ফেরি পারাপারের দীর্ঘ যুগের ভোগান্তি; জীবনযাত্রা আর অর্থনীতিতেও এসেছে গতি। দক্ষিণের মানুষ নতুন পথের সন্ধান পেয়েছেন। সেই পথে এবার শুরু হচ্ছে রেলের যাত্রা।
ট্রেনে চেপে যাতায়াতের অধরা স্বপ্ন পূরণ এখন সময়ের ব্যাপার। রেল নেটওয়ার্কে প্রথমবারের মতো যুক্ত হওয়ার সেই সময় সমাগত। প্রথমবারের মতো রেলযাত্রার অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ আসছে তাদের সামনে।
রূপপুরের আগে দেশের বৃহত্তম এ নির্মাণ প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যাওয়া যে কারণে, সেই সেতুর বুক চিড়ে গড়ে তোলা রেলপথ উদ্বোধন কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা মাত্র। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ট্রেনে চেপে সেতু পার হবেন, পদ্মার বুকে যাত্রা শুরু হবে নতুন এক পথের। ট্রেনে করেই ভাঙ্গা পর্যন্ত যাবেন তিনি।
কাঙ্খিত এ রেলসেতুর উদ্বোধনী দিনের সূচি অনুযায়ী, মঙ্গলবার দুপুরে কমলাপুর থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা লাইন উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। তবে এর যাত্রা শুরু হবে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া স্টেশনে।
পরে ভাঙ্গা উপজেলা সদরের কাজী আবু ইউসুফ স্টেডিয়াম মাঠে জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় তিনি বক্তব্য দেবেন।
সোয়া এক বছর আগে দেশের বৃহত্তম এই সেতু দিয়ে যান চলাচল শুরু হওয়ায় ফেরির ভোগান্তি এখন স্মৃতি মাত্র। এখন রেলপথেও ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন হওয়ায় আনন্দের বন্যায় ভাসছেন ফরিদপুর ও আশপাশের জেলার বাসিন্দারা।
ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতা নিতে মানুষ মুখিয়ে আছে বলে জানালেন ফরিদপুরের ভাঙ্গা মহিলা কলেজের শিক্ষক দিলীপ রায়।
তার কথায়, “কয়েক দিন ধরে রেললাইন পরিষ্কার করছে ও দফায় দফায় ট্রায়াল ট্রেন চলছে। ট্রেনের শব্দে যেন আর তর সইছে না আমাদের। যে পদ্মা নদীতে আগে ফেরি-লঞ্চে পার হতাম, সেই পদ্মা সেতুতে এখন ট্রেন চলবে ভাবতেই স্বপ্ন মনে হয়।”
ঈদসহ প্রতিটি উৎসবে ঢাকা থেকে পদ্মা পাড়ি দিয়ে দক্ষিণের জেলাগুলোতে যেতে মানুষের চরম ভোগান্তি পোহাতে হত। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বোয়ালমারী উপজেলা চেয়ারম্যান এম এম মোশাররফ হোসেন মুশা মিয়া বলেন, “এসব সময়ে যাত্রীদের কাছ থেকে গণপরিবহনগুলো তাদের খেয়াল খুশিরমত ভাড়া আদায় করতো। ট্রেন চালু হতে যাওয়ায় আমরা খুশি , এই ট্রেনে অন্যসময় তো বটেই বিশেষ করে ঈদের ছুটিতে সাশ্রয়ী মূল্যে বাড়িতে ফিরতে পারবে এ অঞ্চলের মানুষ।”
রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার শাহাদাত আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, উদ্বোধনের পর ট্রেনে চেপেই সরকারপ্রধান যাবেন ভাঙ্গা। তাতে পাওয়ার কারসহ কোচ থাকছে ১৪টি।
পদ্মার ওপারের বাসিন্দারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় এ ক্ষণের জন্য। এতে দক্ষিণের বেশ কিছু জেলা প্রথমবারের মতো যুক্ত হবে রেল নেটওয়ার্কে। যাতায়াতের ভোগান্তির পাশাপাশি সময়ও কমবে তাদের।
২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু দিয়ে যান চলাচল শুরুর প্রায় ১০ মাস পর গত ৪ এপ্রিল প্রথমবারের মতো সেতু অতিক্রম করে পরীক্ষামূলক ট্রেন। সেদিন একটি গ্যাং কার এবং তিন মাস পর গত ৭ সেপ্টেম্বর কমলাপুর থেকে যাত্রীবাহী ট্রেন পরীক্ষামূলকভাবে পদ্মা সেতু পাড়ি দেয়।
দুই ঘণ্টার কিছু কম সময়ে সেটি ভাঙ্গায় পৌঁছে। পদ্মা সেতু পার হতে এর সময় লাগে আট মিনিটের মতো।
ব্যয়: ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা
দূরত্ব: ঢাকার কমলাপুর থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার
প্রকল্প প্রস্তাব: ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি
কাজ শুরু: ২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিল
শেষের লক্ষ্যে: ২০২৪ সালের ৩০ জুন
নিমার্ণ প্রতিষ্ঠান: চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড (সিআরইসি)
নতুন রেল: মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল জেলা
লাইনের দৈর্ঘ্য: ২২৬ দশমিক ৯৫১ কিলোমিটার
সেতু: রেলপথে ৬০টি বড় সেতু, ২৭২টি কালভার্ট
নতুন স্টেশন: ১৪টি
পুরনো স্টেশন: ছয়টি
আরও তিন সপ্তাহের অপেক্ষা
তবে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীবাহী ট্রেন শুরু হয়ে যাবে না। রেল কর্মকর্তারা জানান, এ জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে আরও তিন সপ্তাহ।
রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার শাহাদাত আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগামী ১ নভেম্বর থেকে এই সেতু দিয়ে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হবে।”
পদ্মা সেতু দিয়ে রেল চালু হলে মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল জেলা রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হবে। এছাড়া ভাঙ্গা-পাচুরিয়া- রাজবাড়ী সেকশনও পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকার সাথে সরাসরি সংযুক্ত হবে।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর গত ৪ এপ্রিল পরীক্ষামূলকভাবে একটি গ্যাং কার পদ্মা সেতু পার হয়। সেদিন রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ভাঙ্গা থেকে পদ্মা সেতু পার হয়ে মাওয়া আসেন। ওইদিন গ্যাং কারটি ভাঙ্গায় ফিরে যায়।
গত ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার কমলাপুর থেকে একটি যাত্রীবাহী ট্রেন পরীক্ষামূলকভাবে পদ্মা সেতু পাড়ি দেয়। সেদিন রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনসহ কয়েকজন মন্ত্রী, এমপি এবং সাংবাদিকরা ওই ট্রেনে ছিলেন। ঢাকা থেকে ছেড়ে পদ্মা দুই ঘণ্টার কিছু কম সময়ে ভাঙ্গা পৌঁছায় ট্রেনটি। পদ্মা সেতু পার হতে সময় লাগে আট মিনিটের মতো।
এ রেলপথে কোন কোন রুটে ট্রেন যাবে- এমন প্রশ্নে তিনি জানান, ঢাকা থেকে খুলনা পর্যন্ত চলা ‘সুন্দরবন এক্সপ্রেস’, ঢাকা থেকে যশোরের বেনাপোল পর্যন্ত চলা ‘বেনাপোল এক্সপ্রেস’ বঙ্গবন্ধু সেতুর বদলে পদ্মা সেতু হয়ে চলবে।
এর পাশাপাশি রাজশাহী থেকে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পর্যন্ত ‘মধুমতি এক্সপ্রেস’ নামে যে ট্রেনটি চলাচল করছে, সেটির চলার পথ বাড়িয়ে ঢাকায় নিয়ে আসা হবে। অর্থাৎ ঢাকা থেকে রাজশাহী যোগাযোগেও রেলে নতুন একটি পথ চালু করতে যাচ্ছে পদ্মা রেল সেতু।
এ তিন রুটের ট্রেন চলাচল পর্যবেক্ষণ করে পদ্মা সেতু হয়ে ট্রেনের সংখ্যা আরও বাড়বে বলেও জানান শাহাদাত আলী।
সুন্দরবন ও বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেন দুটি এখন যে সময়ে চলে, নতুন পথে সূচি কিছুটা পাল্টাতে পারে বলেও জানান তিনি। তবে তা খুব বেশি উলোটপালট হবে না।
ঢাকা থেকে খুলনার পথে সুন্দরবন এক্সপ্রেস এখন সকাল সোয়া ৮টায় কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে যায়। এর খুলনায় পৌঁছার সময় সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায়।
খুলনা থেকে ঢাকার পথে ট্রেনটি এখন ছেড়ে আসে রাত সোয়া ১০টায়। ঢাকায় পৌঁছার সময় নির্ধারিত আছে সকাল ৭টা। তবে দীর্ঘ দূরত্বে চলাচলে সময় মেনে চলতে পারে না ট্রেনটি।
বেনাপোল এক্সপ্রেস ঢাকার কমলাপুর স্টেশন থেকে রাত সোয়া ১১টায় যাত্রা শুরু করে, সেটি বেনাপোলে পৌঁছানোর সময় নির্ধারিত আছে সকাল ৮টা ২০ মিনিটে। বেনাপোল থেকে ট্রেনটি ছেড়ে আসার সময় নির্ধারিত আছে বেলা ১২ টা ৪৫ মিনিটে, ঢাকায় পৌঁছার কথা নির্ধারিত আছে রাত ৮টা ৪০ মিনিটে।
মধুমতি এক্সপ্রেস রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ ঘাটের উদ্দেশে রাজশাহী ছাড়ে সকাল আটটায়। সেটি পৌঁছার সময় নির্ধারিত আছে বেলা সোয়া একটায়।
উল্টোপথে গোয়ালন্দ থেকে ট্রেনটি ছেড়ে যায় বেলা তিনটায়। রাত ৮টা ২০ মিনিটে সেটির রাজশাহী পৌঁছার সময় নির্ধারিত আছে।
ভাড়া কত?
পদ্মা সেতু হয়ে যে ট্রেনগুলো চলবে, সেগুলোর পথের ভাড়া এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে প্রাথমিকভাবে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৭৭ কিলোমিটার অংশে আন্তঃনগর ট্রেনের ভাড়া ৩৫৩ টাকা করার সুপারিশ করেছে ভাড়া নির্ধারণে গঠিত রেলওয়ের কমিটি।
এর সঙ্গে বাকি পথের দূরত্ব হিসাব করে প্রতিটি ট্রেনের ভাড়া নির্ধারিত হবে। এ ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু ব্যবহারের খরচই বেশি ধরা হয়েছে।
খুলবে সম্ভাবনা দুয়ার
নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ রবিউল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পদ্মা সেতু চালুর পর সড়কপথে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ অনেক সহজ হয়েছে। রেল চালু হলে এই যোগাযোগ আরও উন্নত হবে।
“মালামাল পরিবহনও সহজ হবে। আমরা পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকার সঙ্গে বেনাপোল পর্যন্ত সরাসরি রেল চলাচলের অপেক্ষায় আছি।”
ফরিদপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মো. নজরুল ইসলাম বলেন, “ফরিদপুরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল দীর্ঘদিন অবহেলিত ছিল। এই অবস্থার পরিবর্তন আসবে। এ অঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। ব্যবসায়ীরা এতে সুবিধা পাবে অন্যদিকে তরুণ তরুণীদের কর্মসংস্থানের পথ খুলবে।”
সুন্দরবন অ্যাকাডেমির নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কাদির বলেন, “ঢাকা থেকে ভাঙ্গা হয়ে যশোর পর্যন্ত ট্রেন চালু হলে সড়কপথে চাপ কমবে, মানুষ আরামদায়ক যাতায়াত করতে পারবে।
“যদি মোংলা বন্দর থেকে কনটেইনার ঢাকায় বা দেশের অন্য কোনো জায়গায় নেওয়া হয়, তাহলে খরচ কমবে।”
আরও পড়ুন
পদ্মায় এবার ট্রেন: জেনে নিন রেল সংযোগের খুঁটিনাটি
ট্রেনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গী হবেন হকার-চালক-পোশাককর্মী-শিক্ষার্থী