অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো গুলির ঘটনা ঘটলে সেটা তদন্তে বেরিয়ে আসবে বলেও জানান তিনি।
Published : 30 Jul 2024, 09:53 PM
সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, এখন আন্দোলনকারীরা নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরে যাবেন বলে সরকার আশা করছে।
চলমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে মঙ্গলবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে গুরুত্বপূর্ণ চার মন্ত্রী ও তিন জন প্রতিমন্ত্রী তিন ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, শিক্ষামন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, শ্রম প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম চৌধুরী।
বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা সারাদেশের পরিস্থিতি তুলে ধরেন।
পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চালমান কারফিউ শিথিলসহ আরও কিছু সিদ্ধান্তের কথা জানান সাংবাদিকদেরকে।
আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, “আমরা সারা বাংলাদেশের শান্তিশৃঙ্খলা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছি। আলোচনার মাধ্যমে জানতে পারছি পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। সে কারণে সান্ধ্য আইন বা কারফিউতে আরও কিছু পরিবর্তন করছি।
“বুধবার থেকে শনিবার পর্যন্ত সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকবে। এটা শুধু ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদী জেলার জন্য। সবাইকে অনুরোধ করব কারফিউ মেনে চলার জন্য।”
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে তিনি বলেন, “প্রাইমারি মাধ্যমিক ও কলেজ লেভেলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কবে থেকে চালু হবে সেই সিদ্ধান্ত শিক্ষামন্ত্রী নেবেন। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী কবে থেকে ইন্টারনেট চালু করবেন, সেটার সিদ্ধান্ত নেবেন। তথ্য প্রতিমন্ত্রী মহোদয় স্যোশাল মিডিয়ায় অপপ্রচার বন্ধের ব্যবস্থা নেবেন।”
কারা এই আন্দোলন করেছেন, কারা তাদেরকে ব্যবহার করেছেন, এসব বিষয় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “তবুও দেশ বিদেশে অনেক অপপ্রচার হচ্ছে। আমরা এগুলো তাদের কাছে তুলে ধরব।”
২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে জারি করা পরিপত্র হাই কোর্ট অবৈধ ঘোষণা করলে ছাত্ররা চলতি জুলাই মাসের শুরু থেকে ফের আন্দোলনে নামে। ধীরে ধীরে তাদের আন্দোলনের মাত্রা ও ব্যপ্তি বাড়তে থাকে।
১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে কোটা আন্দোলনকারীদের সংঘাতের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। পরদিন ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুর থেকে ৬ জনের মৃত্যুর খবর আসে।
এর প্রতিক্রিয়ায় ১৮ জুলাই সারা দেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা হয়, সেদিন মাঠে নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরাও। গোটা দেশে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ে, এর মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় রাষ্ট্রীয় সম্পদে হামলা শুরু হয়। প্রাণহানির সংখ্যাও বাড়তে থাকে।
রামপুরায় বিটিভি ভবন, মেট্ররেলের দুটি স্টেশন, বনানীতে সেতু ভবন, মহাখালীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এই পরিস্থিতিতে বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট।
পরদিন পরিস্থিতির অবনতি হলে কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েন করা হয় সারা দেশে। দুই দফায় তিন দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলে পুরো দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
কোটার আন্দোলন কীভাবে সহিংস হয়ে উঠলো তার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, “যখন এই আন্দোলন শুরু হয় তখন আমরা ধারণা করেছিলাম, এটা ছাত্রদের অহিংস একটা আন্দোলন হবে। তাদের দাবির প্রতি আমরা সহনুভূতিশীল ছিলাম। হাই কোর্ট একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে আপিলও করা হয়েছিল। ছাত্ররা আদালতে না গিয়ে আন্দোলনেই রয়ে গেলেন। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট একটা সুন্দর রায় দিয়েছে। আন্দোলনকারীরা যা চেয়েছিলেন তার চেয়ে বেশি তাদেরকে দিয়ে দিয়েছে। এদেশের মানুষ সবাই বলেছে যে, একটা সুন্দর সাজেশন আদালত থেকে এসেছে।
“আন্দোলনকারীরা রায় মেনে নিলেও যারা আন্দোলনকারীদের ঢাল হিসাবে নিয়েছে, তার এটা মেনে নিতে পারল না। আন্দোলনকারীদের প্রভাবিত করে তাদেরকে দিয়ে জোর করে দাবির পর দাবি উত্থাপন করতে লাগল। অযৌক্তিক কিছু দাবি নিয়ে আন্দোলনকারীরা সমাবেশ করতে লাগল।
ছাত্রদের নামে দ্বিতীয় সারির লোকজন সামনে চলে আসলো।”
আন্দোলনে সহিংসতায় নিহতদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এই আন্দোলনে আমাদের কাছে ১৫০ জন নিহত হওয়ার খবর এসেছে। এর মধ্যে পুলিশ রয়েছেন তিনজন, সাংবাদিকরা রয়েছেন, রাজনৈতিক কর্মীরা রয়েছেন, সাধারণ পথচারি রয়েছেন এবং কয়েকজন ছাত্র রয়েছেন।
“তাদের সবার জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। তাদের সব দাবি আমরা মেনে নিয়েছি। আশা করছি তারা ঘরে ফিরে যাবেন, নিজ নিজ স্কুল কলেজে ফিরে যাবেন।”
আন্দোলন-সহিংসতার পর গণগ্রেপ্তার শুরু হয়েছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তারও জবাব দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “অনেকেই বলছেন আমরা গণগ্রেপ্তার করছি। কোনো গণগ্রেপ্তার আমরা করছি না। গোয়েন্দা তথ্য, ভিডিও ফুটেজ ও সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ভুলক্রমে কাউকে নিয়ে আসা হলে থানায় চেক করে তাদেরকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
“তাদের ধ্বংসাত্মক কাজগুলো আপনারা দেখেছেন। আমাদের জাতীয় সম্পদ, রাষ্ট্রীয় সম্পদ তারা নষ্ট করেছে। তিন পুলিশ সদস্য, একজন আনসার সদস্যকে তারা হত্যা করেছে। ১০ জন পুলিশ ও র্যাব সদস্য মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন। এক নারী সাংবাদিককে তারা হেনস্তা করেছে। উত্তরা, যাত্রাবাড়ীতে যা হয়েছে, তা ছাত্রদের কর্মকাণ্ড নয়। প্ল্যান করে অচল রাষ্ট্র বানানোর জন্য এসব হয়েছে। যারা এসব কর্মকাণ্ড করেছেন তারা রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ড করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে। কিন্তু নিরাপরাধ ব্যক্তিকে অন্তরীণ করব না।”
গুলির ব্যবহার নিয়ে যা বললেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
বিবিসি বাংলার সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, প্রাণঘাতি গুলির ব্যবহারের অনেক ঘটনা ঘটেছে। গুলির আঘাত নিয়ে অনেকেই এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এই আন্দোলন দমন করতে কত গুলি ব্যবহার করতে হয়েছে?
জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আপনি একজন সাংবাদিক না? আপনি দেখেছেন ধ্বংসলীলাটা? কীভাবে সেতু ভবন ধ্বংস, নরসিংদীতে কারাগার ভেঙে লুটপাট, যাত্রাবাড়ীতে পুলিশ সদস্যকে লটকে রেখেছে? দুই সাংবাদিককে মেরে ফেলছে। সিআরপিসি আইন অনুযায়ী জীবন রক্ষা করার দায়িত্ব পুলিশ বাহিনীর।”
মন্ত্রী আরও বলেন, “পুলিশ বাহিনী প্রথমে অতি ধৈর্য্যের সঙ্গে যা যা করার করেছে। বলেছে, ধাক্কা দিয়েছে, টিয়ারগ্যাস ছুড়েছে, জলকামান ছুড়েছে। কিন্তু তারা যায়নি। তারা জল কামানের গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, যেখানে আগুন ধরেছে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যেতে চেয়েছে, যেতে দেয়নি, পুড়িয়ে দিয়েছে। উত্তরায় জনপ্রিয় সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের এক স্টাফকে কীভাবে মেরে লাশ ঝুলিয়ে রেখেছে। ওখানে আমাদের পুলিশ বাহিনী যেতে চেয়েও যেতে পারেনি।
“বিটিভি ভবনে বিজিবি যেতে চেয়েও যেতে পারেনি। হেলিকপ্টার ইউজ করতে হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে একটা হাসপাতালের একটা ফ্লোরে হাইওয়ে পুলিশের ক্যাম্প ছিল। সেই হসপিটালসহ পুড়িয়ে দিয়েছে। সেখান থেকে হেলিকপ্টার দিয়ে রোগী, মা-বাচ্চাদেরকে রক্ষা করা হয়েছে। সমস্ত ধ্বংসযজ্ঞ র্যাব, পুলিশ, বিজিবি ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবেলা করেছে। না পেরে সেনাবাহিনীকে আসতে হয়েছে।”
গুলি করার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, “যেখানে পারেনি, সেখানে জীবন রক্ষার জন্য, দেশের সম্পদ রক্ষার জন্য গুলি করতে বাধ্য হয়েছে। সবগুলোর হিসাব-নিকাশ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা রাখেন। কোনো একটি গুলি, কোনো একটি মৃত্যু যদি অনাকাঙ্ক্ষিত হয়, সেজন্য একটা ইনকোয়ারি হয়, সেগুলো হবে ইনশাআল্লাহ।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “ইতোমধ্যেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় একটা বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করা হয়েছে। তারাও একটা সুন্দর রিপোর্ট দেবে বলে আমরা মনে করি। এই কয়েকদিনে কী ঘটনা ঘটেছিল তার একটা পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট আসবে। আমরা সারা বিশ্বকে জানাতে পারব যে, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি কী ঘটনা ঘটাতে চেয়েছিল।”