“আমি ১০-১২ জনরে চিনি যারা করোনার পরে থিকা ভিক্ষা করে। কাম খুইজ্জা পায় না, কী করব,“ বলছিলেন নিউ মার্কেট এলাকার পঙ্গু ভিখারি আলী আহম্মদ।
Published : 21 Dec 2022, 12:24 AM
‘ব্যাগ নেন ভাই, ব্যাগ নেন, অনেক ভাল ব্যাগ, মাত্র ৩০ ট্যাকা’; বাসের ভেতরে কয়েকবার হাঁকডাক দিয়ে কয়েক যাত্রীর কাছে গিয়ে নূর হোসেন বললেন, ‘দেই একটা? হাতে নিয়া দেখেন, ভাল লাগলে নিয়েন’।
সবাই তার ব্যাগ নেড়েচেড়ে দেখলেন, নিলেন না কেউ। হতাশ হয়ে নূর হোসেন বলতে লাগলেন- ‘সংসার টানতে পারি না। এই কাজ করেও কিছু হয় না, ব্যাগ না নিলে এই অসহায়কে পারলে ১০ ট্যাকা দিয়ে সাহায্য কইরেন।”
তিন দশক আগে ভোলার স্বরাজগঞ্জ থেকে নদীভাঙ্গনে নিঃস্ব হয়ে ঢাকায় আসা নূর হোসেনের সঙ্গে কথা হল নিউ মার্কেট এলাকায়। মিরপুরগামী একটি বাসে উঠে ব্যাগ বিক্রি করতে না পেরে সাহায্য চাইছিলেন তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নূর হোসেন জানালেন, ভাগ্যের সন্ধানে ঢাকা এসে উঠেছিলেন কামরাঙ্গীচরে। একটি ওয়ার্কশপে কাজ করছিলেন। ২০১৭ সালের দিকে এক দুর্ঘটনায় শারীরিকভাবে মারাত্মক আঘাত পাওয়ার পর ভারী কাজ আর করতে পারেন না।
টুকটাক ব্যবসা শুরু করলেও করোনাভাইরাস মহামারীতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েন। এরপর থেকে হকারি শুরু করেন, কিন্তু জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে তাতে আর কুলাতে পারছেন না, তাই মাঝেমাঝে হাতও পাতছেন।
তিন বছর আগে শুরু হওয়া মহামারী এবং প্রায় বছরখানেক ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কট নূর হোসেনের মত ঢাকায় বহু মানুষকে দারিদ্র্যে, বেকারত্বে আর ভিক্ষাবৃত্তিতে ঠেলে দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দারিদ্র্য আর ভিক্ষাবৃত্তি ঠেকাতে সরকারের নানা পদক্ষেপের পরও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় মানুষ অভাব সামলে নিতে পারছে না।
২০২০ সালে মহামারী শুরুর পরপর হঠাৎ করেই ঢাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভিক্ষা করা মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায়, যা আগে অনেকটা কমে এসেছিল। লকডাউন শুরু হলে, অর্থনীতির চাকা কার্যত থেমে গেলে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবী মানুষের হাত পাতা ছাড়া কোনো উপায় আসলে ছিল না।
ভাইরাসের প্রকোপ এখন কমে এসেছে অনেকটা; কিন্তু সামলে ওঠার পথে যুদ্ধের ধাক্কা খেয়েছে দেশের অর্থনীতি। নিম্ন আয়ের মানুষের আয় বাড়েনি, কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে।
কিছুদিন আগেও মানুষের বাসা-বাড়িতে বুয়া বা রান্নার কাজ করতেন পঞ্চাশ বছর বয়সী জয়নব, এখন মিরপুরের মধ্য মনিপুর এলাকায় দোকানে দোকানে ভিক্ষা করেন।
তার ভাষায়, “চাইর-পাঁচ মাস হইব ভিক্ষা করতাসি। করোনার আগে ১০ বছর এক বাসাত কাম করছি। করোনার সময় সাবের চাকরি গেছেগা, পরে আমারে তারা ছাইড়া দিছে। এরপরে কয়েক বাসাত কাম করছি। অহন আর কাম পাই না, তাই মাইনষের কাছে চাইয়া খাই।“
মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় নূর হোসেন কিংবা জয়নবের মত নিম্ন পুঁজির হকার ও শ্রমজীবীরা ভিক্ষাবৃত্তির আশ্রয় নিচ্ছেন বলে মনে করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সামনে যেহেতু একটি দুর্ভিক্ষের কথা বলা হচ্ছে, আর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়েছে, সেহেতু মানুষ এখন অতিরিক্ত খরচ কমিয়ে দিয়েছে। আগে মানুষ রাস্তার পাশে বা বাসে হকারের কাছ থেকে কিছু কিনলেও তারা এখন কম কিনছে।
“এর প্রভাব পড়ছে এসব হকার ও শ্রমজীবীদের ওপর। আগে হয়ত দিনে সে ৫০০-৭০০ আয় করত, কিন্তু এখন তা নেমে আসছে ৩৫০-৩০০ টাকায়। এই টাকা দিয়ে তো সংসার চালাতে পারছে না সে, ফলে হাত পাতছে।“
সবশেষ জনশুমারির হিসাব অনুযায়ী, ১ কোটি দুই লাখ ৭৮ হাজার ৮৮২ মানুষের মেগাসিটি ঢাকা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনেক মানুষ প্রতিবছর এ শহরে কাজের সন্ধানে আসছেন। এটাও ভিক্ষুক বেড়ে যাওয়ার কারণ বলে মনে করেন অধ্যাপক জাহাঙ্গীর।
তিনি বলেন, “দারিদ্র্যের কষাঘাতে পড়লে এদেশের সব মানুষই গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসার কথা ভাবে। কারণ এখানেই সব। কিন্তু অনেকেই এখানে এসে কাজ না পেয়ে যোগ দেন ভিক্ষাবৃত্তিতে।“
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর নানা কর্মসূচি থাকার পরও ঢাকা শহরে কেন ভিক্ষুকদের আনাগোনা বেশি- তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে জাতীয় সংসদেও। গত ৬ নভেম্বর সরকারি দলের সংসদ সদস্য এ কে এম রহমতুল্লাহ সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের উদ্দেশে এমন প্রশ্ন রেখে ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে পদক্ষেপ চান।
সম্পূরক প্রশ্নে ঢাকা-১১ আসনের এমপি রহমতুল্লাহ বলেন, “সরকারের তিন টার্ম কন্টিউনিয়াস চলছে। এর আগে ১৯৯৬ সালেও আমরা ক্ষমতায় ছিলাম। আমরা বয়স্কভাতাসহ অনেক রকম ভাতা দিয়ে যাচ্ছি। যাদের বাড়িঘর নেই, তাদের বাড়িঘর দিয়েছি। আজকেও আসার সময় রাস্তায় ১০ জন ফকির ভিক্ষা চাচ্ছে।
“আমরা সামাজিক বেষ্টনীর মধ্যে সব কিছু নিয়ে আসছি। আশ্রয়ণ প্রকল্প করছি। সবরকম সাহায্য দিচ্ছি। তাহলে আমাদের রাস্তার উপরে ভিক্ষুক থাকার তো কথা নয়। থাকা উচিতও নয়। এদের জন্য কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, এটা আমার প্রশ্ন।”
জবাবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা শহরে ভিক্ষুকদের উৎপাতের বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। এটা নিরসন করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি।”
‘কাল হয়েছে’ করোনাভাইরাস
নিউ মার্কেট এলাকায় এক যুগের বেশি সময় ধরে ভিক্ষা করেন জন্ম থেকে পঙ্গু আলী আহম্মদ। তার অভিজ্ঞতা বলছে, আগের তুলনায় ভিক্ষুকের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে।
“আগে ভিক্ষা করত যার হাত নাই, পাও নাই, অভাবী। এখন অনেক ভালা মানুষ ভিক্ষা করে, তারার সাথে আমরা কুলাইতে পারি না। আমি ১০-১২ জনরে চিনি যারা করোনার পরে থিকা ভিক্ষা করে। কাম খুইজ্জা পায় না, কী করব। আগে মানুষ যা ভিক্ষা দিত, তাও দেয় না, মানুষের হাতে ট্যাকা নাই।“
নতুন করে ভিক্ষায় নেমেছেন এমন এক নারীর সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিলেন আলী আহম্মদ। জহুরা বেগম নামের ওই নারী জানালেন, তার স্বামী নাজিরাবাজারে কুলির কাজ করতেন। নিজেদের দোকান দেওয়ার জন্য তারা টাকা জমাচ্ছিলেন।
“করোনা আসার পরে তো কাজ বন্ধ। অনেক কষ্টে দিন কাটাইলাম। জমানি সব ট্যাকা শেষ হইয়া গেল। এহন উনার বয়স হইছে আগের মতো মাল টানতে পারে না। মেয়ে দুইটারে বিয়া দিছি, একটা পোলাও নাই যে আমারে দেখব। বয়স হইয়া গেছে, আমি কী করমু। পেট তো মানে না।“
নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি নয়া ফকির। এল্লিগা অনেকে আমারে দেখতে পারে না। পুরানা যারা আছে তারা অনেক কিছু বলে, তাড়াইয়া দিতে চায়।“
নিউ মার্কেটে কেনাকাটা করতে এসেছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাহমিনা তাবাসসুম। গত কিছুদিনের অভিজ্ঞতা থেকে তারও মনে হয়েছে, আগের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ এখন সাহায্য চাইতে আসে।
“গত কয়েক বছরে এটা বেশ বেড়েছে। দেখা যায় মার্কেটের গেটে গেলে অনেকজন মিলে ঘিরে ধরছে। একজনকে দিলে আরেকজন কষ্ট পাচ্ছে। ফলে অনেক সময় দেয়াও হয় না।“
শুক্রবার জুমার নামাজের পর মহাখালীর গাউসুল আজম জামে মসজিদের সামনে অন্তত ৫০ জন ভিক্ষুককে দেখা যায়। মসজিদে আসা সবার কাছে তারা হাত পাতেন। একজনকে ভিক্ষা দেওয়ার সময় অন্যরাও ছুটে এসে ঘিরে ধরেন।
সাদেক আলী নামের এক ভিক্ষুক বললেন, “না পাইরা হাত পাতি। বয়েস থাকতে রিশকা বাইতাম। অহন আর পারি না। আমারে দেখারও কেউ নাই।“
মহাখালীর এই মসজিদের সামনেই সাতজনকে পাওয়া গেল, যারা মহামারীতে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছেন। আগে তাদের কেউ ছিলেন পান-সিগারেট বিক্রেতা, কেউ শ্রমিক, কেউ দারোয়ান আর কেউবা বাসা-বাড়ির বুয়া।
তাদের মধ্যে আজমত মিয়া নামের এক পৌঢ় বলেন, “আমার গুদারাঘাটে পান সিগারেটের দোকান ছিল। করোনায় সব শেষ, পুঞ্জি নাই। অভাব এমনভাবে ধরছে আর কিছু করতে পারলাম না। পরিবার নিয়ে খুব চাপে আছি। আমিই জীবনে কত মানুষরে ভিক্ষা দিছি, এখন নিজের ভিক্ষা করন লাগে। এই কষ্ট কওয়ার মত না।“
কোভিড পরবর্তী সময়ে ভিক্ষুক বেড়ে যাওয়ার কথা জানালেন মিরপুর ও মহাখালী এলাকার কয়েক দোকানিও। কাজীপাড়া এলাকার মুদি দোকানি শাহ আলম ভূঁইয়া বলেন, “আজকাল দিনে প্রায় শ খানেক ভিক্ষুক আসে। সবাইরে তো দিতে পারি না। প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষ চাইতে আসে। কী করব- ভাঙতি থাকলে দিই, নাইলে বলি ‘মাফ করেন’।”
ঢাকা শহরে ভিক্ষুক বাড়ার বিষয়টি ‘স্পষ্ট’ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “স্পষ্টতই ঢাকার রাস্তায় ভিক্ষুক বেড়ে গেছে। যদিও মন্ত্রী-এমপিরা বলেন ভিক্ষুক নেই, তার কারণ হচ্ছে তাদের গাড়ির কাছে তো কেউ ঘেঁষতে পারে না। কিন্তু, আমরা রাস্তায় বের হলেই দেখি আগের চেয়ে বেশি ভিক্ষুক আসছে। বাড়িতে-বাড়িতে, পাড়ায়-পাড়ায় এখন যে হারে ভিক্ষুক আসে সেটি কয়েক বছর আগেও এমন ছিল না।“
হাত পাতছেন শ্রমজীবীরা
মহাখালী ওয়্যারলেস গেইট এলাকায় পথচারীদের কাছে অর্থ সাহায্য চাইছিলেন শেফালী নামের এক তরুণী। শেরপুরের কামারের চর থেকে বোনকে নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন পোশাক কারখানায় কাজের উদ্দেশে, কিন্তু তার সেই কাজ আর পাওয়া হয়নি।
“চেয়ারম্যানবাড়িতে (বনানী) এলাকার অনেক মেয়ে থাকে, হেরা গার্মেন্টসে কাজ করে। আমারে কইছিলো কাজ পামু। আজকে ১৩ দিন হইলো আইছি। কোনো গার্মেন্টসে নাকি নতুন লোক নিতাছে না। বাড়িত যাওয়ারও তো উপায় নাই। কাজ না পাওয়া পর্যন্ত ক্যামনে চলুম এল্লিগা মানুষের কাছে চাইতাছি।“
মিরপুর দশ নম্বর এলাকার শাহ আলী মার্কেটের সামনে দুই বছর বয়সী শিশুকে কোলে নিয়ে ভিক্ষা করছিলেন মোসাম্মত শাহানুর। এর বাইরে তিনি অন্য কাজও করেন।
“সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আমি তিন বাসায় ছুটা বুয়ার কাজ করি। তিন হাজার টাকা পাই। আমার জামাই রিশকা চালায়। বিকালের পরে আমি মার্কেটের সামনে আইসা সাহায্য চাই, ভিক্ষা করি না। ছোট বাচ্চা আছে, ঘরভাড়া আছে, সংসারের অনেক খরচ। আমি-জামাই যা কামাই তা এইগুলাতে চইলা যায়। সন্ধ্যায় এদিকে আসলে চাইর-পাঁচশ ট্যাকা পাই। এইটা দিয়া দিনের বাজার চলে।“
আগারগাঁও এলাকায় সুমন মিয়া বলেন, “আমি খেতে কামলার কাজ করতাম। মুজুরি কম ছিল। একজনের কথা শুইনা ঢাকায় আসছিলাম। এদিকে নাকি অনেক কাজ আছে। কিন্তু পরিচিত লেবার ছাড়া কেউ কামে নেয় না। মাঝে মাঝে টুকটাক কাম পাই। আর যখন পাই না তখন খাবারের জন্য আপনাগো কাছে চাই।“
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “দারিদ্র্যসীমার নিচে মানুষ বেড়ে গেছে।…বিশাল মানুষ করোনার জন্য আর্থিক সংকটে পড়েছে তা নিয়ে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা ছিল না। আমাদের অনেক মানুষ শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে ছাঁটাই হয়েছে, আবার অনেকেই আছেন যারা অনানুষ্ঠানিক খাতের পেশাজীবী, তাদের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছে।
“নিশ্চিত আয় নেই, আবার এমন কোনো জায়গাও নেই যেখানে তারা সহায়তা পেতে পারে। যার দরুণ, অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তারা ঋণগ্রস্ত হয়েছে।”
“শ্রমজীবী মানুষ সংকটে পড়লে পরিবারের সবাই মিলে কাজ করে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু করোনার পর যেভাবে দাম বেড়েছে তাতে তারা আর সামাল না দিয়ে রাস্তায় নামছে , হাত পাতছে“, বলেন তিনি।
সরকারের পদক্ষেপ কী
সমাজসেবা অধিদপ্তরের বলছে, ঢাকা শহরে ভিক্ষাবৃত্তি রোধে প্রাথমিকভাবে সিটি করপোরেশন শহরের কিছু এলাকা ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিমানবন্দরে প্রবেশ পথের পূর্ব পাশের চৌরাস্তা, বিমানবন্দর পুলিশ ফাঁড়ি এবং এর আশপাশের এলাকা, হোটেল র্যাডিসন সংলগ্ন এলাকা, ভি আই পি রোড, বেইলি রোড, হোটেল সোনারগাঁও ও হোটেল রূপসী বাংলা সংলগ্ন এলাকা, রবীন্দ্র সরণী এবং কূটনৈতিক জোন।
রাজস্ব খাতের অর্থায়নে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান’ শীর্ষক কর্মসূচি ২০১০ সাল থেকে চলছে। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি বদলায়নি। ২০১০-১১ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার এই খাতে ৭৫ দশমিক ২৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়, ব্যয় হয় ৪২ দশমিক ৬৪৩ কোটি টাকা। প্রকল্পে উপকারভোগী হন ১৪ হাজার ৭০৭ জন।
এছাড়া ঢাকা শহরের ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা এলাকায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে আটক করা ভিক্ষুকদের রাখতে পাঁচটি সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রের ভেতরে ফাঁকা জায়গায় অস্থায়ী ভিত্তিতে ১৬টি টিনশেড ডরমিটরি ভবন নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ১৩০টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে ২ হাজার ৬০০ জন ভিক্ষুকে ধরা হয়। তাদের রাখার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় ১ হাজার ৮০৫ জনকে ভিক্ষাবৃত্তি না করার শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়। অবশিষ্ট ৭৯৫ জনকে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ভিক্ষুক ও চা শ্রমিক) মো. শাহ জাহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা প্রতিটি জেলার জেলা প্রশাসকদের কাছে ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের জন্য তহবিল পাঠিয়েছি। নিজ নিজ এলাকায় ফিরে গেলে ভিক্ষুকরা তার সুবিধা পাবে। কিন্তু তারা যেতে চায় না।
“আমরা মাইকিং করি, পুনর্বাসনে নিয়ে যাই, কিন্তু দেখা যায় কিছুদিন পর এই পেশাতেই ফিরে আসে। কোনো কাজ না করে টাকা পাওয়া যায় বলে তারা এই পেশা উপভোগ করে।“
ঢাকায় ভিক্ষুক যে বেড়ে গেছে, সেটা অবশ্য মানতে চান না সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ভিক্ষুক বাড়ে নাই, আগের মতোই আছে। একেক সময় তারা একেক এলাকায় এসে জড়ো হয়।”
ভিক্ষুকদের নিয়ে সরকার কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ভিক্ষুক নিয়ে আমাদের অনেকে প্রকল্প আছে, ভিক্ষুকদের ঘরবাড়ি করে দিয়ে পুনর্বাসনও করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন থাকার পর এসব বিক্রি করে আবার তারা ঢাকায় চলে আসে, কারণ এই পেশায় কোনো কাজ না করেই পয়সা পাওয়া যায়। আর সারাবিশ্বে একটা মন্দা চলছে এর প্রভাব তো আছেই।
“আর অনেককে দেখবেন অল্প বয়স কিশোর-তরুণ ভিক্ষুক আছে। তারা শুক্রবারে মসজিদের এখানে এসে ভিড় করে বা মার্কেটের সামনে থাকে, তারা আদতে মাদকসেবী। এরা একেবারেই পেশাদার। সরকার যেভাবে ভাতা, সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে তাতে ভিক্ষা করার কথা না। বিনা পরিশ্রমে, পুঁজিতে অর্থ আয় করা যাচ্ছে শুধুমাত্র এই কারণে অনেককে এই পেশা থেকে ফেরানো যাচ্ছে না।“
আরও খবর
নানা কর্মসূচির পরও ঢাকায় এত ভিক্ষুক কেন? প্রশ্ন সংসদে