খালের জমি উদ্ধারে অভিযানের সময় সবার মনযোগের কেন্দ্রে ছিল প্রাণীটি। একটি মাচা বানিয়ে রাখা হয়েছিল একে।
Published : 27 Jun 2024, 10:19 PM
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর খালের ওপর গড়ে তোলা পশু খামার সাদিক অ্যাগ্রোর অবৈধ অংশ উচ্ছেদের সময় সরাতে হল ১৫ লাখ টাকা দাম হাঁকা সেই ছাগল, যেটি বিক্রি হওয়ার পর এনবিআরের এক সদস্য ও তার পরিবারের বিপুল পরিমাণ সম্পদের বিষয়টি সামনে আসে।
আলোচিত এই খামারটির একাংশ খাল দখল করে গড়ে তোলার প্রমাণ পেয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে অভিযান চালায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।
উচ্ছেদের পূর্বনির্ধারিত সময় সকাল ১০ টা থাকলেও শুরু হয় বেলা ১২ টার পর। এই অভিযান নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন এসেছে আগের দিনেই। তাই সাদিক অ্যাগ্রোকে ঘিরে সকাল থেকেই ছিল উৎসুক মানুষের ভিড়।
এই অভিযানে সেখানে মূল আকর্ষণ ছিল সেই ছাগলটিকে ঘিরে, সাংবাদিকরা ছাড়াও এলাকাবাসী সেটির ছবি তুলছিলেন, ভিডিও করছিলেন। মানুষের এই ভিড়ের মধ্যেও ভাবলেসহীনভাবে দাঁড়িয়েছিল ছাগলটি। পুরোটা সময় তাকে খাবার দেওয়া হয়নি, বরং তার থাকার স্থানটি হারাতে হয়।
মোহাম্মদপুরের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে বেড়িবাঁধ লিংক রোডে এই সাদিক অ্যাগ্রোর অবস্থান। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জরিপ দল প্রমাণ পেয়েছে, যেখানে এই খামারের অবস্থান, তার একটি অংশে এক সময় ছিল খাল।
খাল ভরাট করা সেই অংশটিতেই বাঁশ ও কাঠ দিয়ে মাটি থেকে দেড় হাতের মত উঁচু মাচা তৈরি করে তাতে রাখা ছিল ছাগলটি। জায়গাটি গ্রিল দিয়ে আটকিয়েও রাখা, ফলে ভেতরের সব কিছু দেখা যায়।
অভিযানের সময় ছাগলটিকে সরিয়ে সেখান থেকে নেওয়া হয় অন্য একটি শেডে। সে সময় এই প্রাণীটিকে নিয়ে নানা রসিকতা করতে দেখা যায়।
সাদিক অ্যাগ্রোর এই ছাগলটিকে নিয়ে তোলপাড়ের শুরু ঈদের অনেক আগে থেকেই, যখন এর মালিক ইমরান হোসেন একে বিরল জাতের প্রাণী দাবি করে ১৫ লাখ টাকা দাম হাঁকেন।
পরে মুশফিকুর রহমান ইফাত নামের এক তরুণ ১২ লাখ টাকায় ছাগলটি কেনার চুক্তি করেন। এত দামে কে ছাগল কিনলেন- এই নিয়ে আলোচনার মধ্যে পরে প্রকাশ পায় ১৯ বছর বয়সী এই তরুণীর বিপুল পরিমাণ সম্পদের কথা, প্রকাশ পায় তার বাবা এনবিআরের সদস্য মতিউর রহমান।
মতিউর শুরুতে দাবি করেন, ইফাত তার সন্তান নন, তাকে চেনেনও না। তার বিরুদ্ধে যারা ‘অপপ্রচার’ চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করবেন।
তবে পরে মতিউরের এই বক্তব্য অসত্য প্রমাণ হয়। তারও আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এমন বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য মেলে।
কেবল মতিউর নিজে নন, তার দুই স্ত্রী এবং তাদের সন্তানদের সম্পদের হিসাব আসতে থাকে গণমাধ্যমে; জানা যায়, প্রথম স্ত্রীর মেয়ে ফারজানা রহমান ইপ্সিতা কানাডায় চার কোটি টাকা দামের গাড়ি হাঁকেন, দামি বাড়িতে থাকেন, যদিও তিনি অনলাইনে মেকআপ টিউটোরিয়াল করে স্বাবলম্বী হওয়ার দাবি করেছিলেন।
আলোচনার মধ্যেই কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মতিউর রহমানকে এনবিআর থেকে সরিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সোনালী ব্যাংকে পরিচালকের পদও হারিয়েছেন তিনি।
মতিউর লাপাত্তা হয়ে গেছেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তিনি দেশ ছেড়েছেন, তবে কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না।
তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের আবেদনে মতিউর ও তার পরিবারের সব বিও হিসাব অবরুদ্ধ এবং তাদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত।
এতসব কাণ্ডের পর ইফাত সেই ছাগলটি আর নেননি, তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারার কথা জানিয়েছেন সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক।
এই ছাগল কাণ্ড দিয়ে আলোচনা হয়েছে সংসদেও। ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, ছাগল চিহ্নিত করার আগেই দুর্নীতিবাজদের সরকারের চিহ্নিত করতে হবে।
ঢাকা উত্তর সিটির এই অভিযানের সময় সংস্থাটির একজন কর্মচারীকে বলতে শোনা গেল, “সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সকল ঘটনার মূলেই রয়েছে এই ছাগলটি। এটি এখন শুধুই ১৫ লাখ না। এটি এখন মহামূল্যবান।”
অভিযানে কী হল
ডিএনসিসি অঞ্চল-৫ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোতাকাব্বির আহমেদ অভিযানে নেতৃত্ব দেন।
মোতাকাব্বির আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, “খালের জায়গার উপরে যারা স্থাপনা করেছে সব ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সাদিক অ্যাগ্রোর স্থাপনার যেটুকু অংশ খালের উপরে ছিল সেটুকু জায়গা উদ্ধার করা হয়েছে।”
খালের জায়গায় সেখানে ৫০ টির মতো টিনশেড ঘর, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের সীমানা প্রাচীরও ভেঙে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আজই খননের কাজ শুরু করেছি। যে খাল-নদীর জমি দখল করবে তারা কেউ টিকতে পারবে না, উচ্ছেদ করা হবেই।”
অভিযানের খবর পাওয়ার পর বুধবার রাতেই বেশকিছু গরু এবং খাল ও সড়কের জায়গার অস্থায়ী কিছু স্থাপনা সরিয়ে নেয় সাদিক অ্যাগ্রো কর্তৃপক্ষ। তবে রাতে গরু সরানো হলেও ছাগল সরানো হয়নি।
অভিযান চলাকালে ডিএনসিসি যখন সাদিক অ্যাগ্রোর স্থাপনা ভেঙে সামনের দিকে যাচ্ছিল, তখন ছাগল সরানো কাজ শুরু করে কর্মীরা।
ইমরানের দেখা নেই, ষড়যন্ত্রের অভিযোগ সাদিক অ্যাগ্রো কর্মকর্তার
সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেন নানা সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গণমাধ্যমের সামনে নিজে থেকে হাজির থাকলেও এই অভিযানের সময় তাকে দেখা যায়নি। এমনকি তিনি কোথায় আছেন, সেটি বলেননি কোনো কর্মকর্তাও।
ইমরান হোসেন গবাদিপশুর খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি।
খামারটির ইনচার্জ সুমন খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের বিরুদ্ধে কঠিনভাবে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।”
কারা কথিত ষড়যন্ত্র করছে, সেই প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি। আরেক প্রশ্নে বলেন, ভালো মুনাফা হওয়ার কারণেই এই ‘ষড়যন্ত্র’।
এই অভিযানে ক্ষতি হলেও সাদিক অ্যাগ্রো এগিয়ে যাবে- এমন কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এসব লস ব্যাপার না, এসব কিছুই না। সাদিক অ্যাগ্রোর কিছুই হবে না। কেউ কিছুই করতে পারবে না ইনশাআল্লাহ।”
সুমন খান জানান, এই জায়গা সাদিক অ্যাগ্রোর নিজস্ব সম্পত্তি নয়। তারা জায়গাটা ভাড়া নিয়েছেন বছর তিনেক আগে।
তবে কার কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছেন তার নাম বলেননি তিনি।
“এটা আমরা ভাড়া নিছি। আমাদের তো কোনো দায় নাই। আমরা তো জায়গাটা দখল করি নাই”, বলেন তিনি।
আগেও একবার এসে স্থাপনার কিছু অংশ সিটি করপোরেশন ভেঙে দিয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “তখন পিলার গেড়ে বলেছে, ‘এটা আপনার সীমানা’।
“এখনও স্থাপনা সেই পিলারের বাহিরেই আছে, তবুও ভাঙা হচ্ছে। তাদের দেওয়া পিলারের বাহিরে যেহেতু আছে তাহলে এবার ভাঙল কেন?”
তাদেরকে কোনো নোটিশ করা হয়নি এবং সময় দেওয়া হয়নি- এমন অভিযোগ করে তিনি বলেন, “আমাদের বড় জেনারেটরের জন্য বলছিলাম, ১০ মিনিট সময় দেন। কিন্তু আমরা সরাতে পারলাম না। আমাদের অফিসগুলোর এসিসহ বিল্ডিংয়ের ভেতরে থাকা কিছুই সরাতে পারি নাই। আমাদের অফিসগুলোর এসি খোলার সময়ও দেয়নি।”
তবে অভিযান পরিচালনাকারী ম্যাজিস্ট্রেট এই দাবি নাকচ করে বলেন, “আমরা অনেকবার নোটিশ দিয়েছি স্থাপনা সরানোর জন্য।”
আশ্রয় হারাল ২০টি পরিবার
স্থানীয় বাসিন্দা মো. শরিফ বলেন, “এই খাল ছিল একেবারে প্রধান সড়ক পর্যন্ত। কিন্তু এখন তো সবটাই দখল হয়ে গেছে। খালটাও মরে গেছে।”
আরেকজন বাসিন্দা আব্দুর রহিম বলেন, “এই খাল নেতা-ফেতারাই দখল করছে। তারাই দায়ী। খালে তারাই মাটি ফেলছে। না হয় খাল ভরাট হয় কীভাবে?”
এই অভিযানে সাদেক এগ্রোর পিছনে অন্তত ২০ টি পরিবার খালের উপরেই ঘর তৈরি করে থাকছিলেন। তাদেরকেও উচ্ছেদ করা হয়েছে।
তাদের মধ্যে একজন পারুল আক্তার বলেন, “তিন মাস আগে এইহানে আইছি। আয়া দেহি অনেক ময়লা। পরে সবগুলো সরাইছি। খুব কষ্ট কইরা ঘর তুলছি।
“কোথাও থাকার জায়গা নাই তাই, এইহানে ঠাঁই পাইছিলাম। কিন্তু এহন আমাগো খেদায়া দিতাছে। যদি খেদায়াই দেয়, তাইলে আরেক জায়গায় আমাগো থাকার ব্যবস্থা কইরা দিক সরকারে।”
শেখ মুক্তা নামে আরকেজন বলেন, “আমাদেরকে এমন কইরা খেদায়া দিব, আমরা যামু কনে? আমাদের খেদাইলে আমাগো আরেক জায়গায় থাকার ব্যবস্থা কইরা দিক।”
মোহাম্মদপুরের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ সরকার বলেন, “মেয়র (আতিকুল ইসলাম) গত বছরও বলেছেন এখানে পরিষ্কার করা হবে। যারা দখল করে আছে সেসব উদ্ধার করে মাছ চাষ করা হবে।
“খালের এক পাশে সাত মসজিদ হাউজিং ইউনিট আওয়ামী লীগের কার্যালয় ছিল সেগুলোও উদ্ধার করা হয়েছে।”