“আমরা সব দরজা খোলা রেখেছি। সকলের সঙ্গে আলাপ করছি।”
Published : 18 Apr 2025, 10:11 PM
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের (আরাকান) বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে এই মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান।
শুক্রবার সন্ধ্যায় কক্সবাজারে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, “আমরা সব দরজা খোলা রেখেছি। সকলের সঙ্গে আলাপ করছি।”
প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সঙ্কট ও সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি সংক্রান্ত হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান কক্সবাজারের টেকপাড়া আছিমং পেশকার পাড়ায় রাখাইন সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী মাহা সাংগ্রেং পোয়ে বা জলকেলি উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন।
এর আগে এদিন দুপুরে তিনি উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যান।
খলিলুর রহমান বলেন, “এই মুহুর্তে আরাকানের যে অবস্থা তাতে রোহিঙ্গাদের নিরাপদভাবে প্রত্যাবাসন করা সম্ভব নয়। আমরা সব পক্ষের সঙ্গে কাজ করছি যেন আরাকানে শান্তি ও স্থিতাবস্থা ফিরে আসে, রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়।”
তিনি মনে করেন, যদি সকল দেশ একসঙ্গে কাজ করে, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সহজতর হয়ে উঠবে।
মিয়ানমারের পক্ষ থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ‘প্রত্যাবাসনযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করার বিষয়টিকে সময়োপযোগী পদক্ষেপ বলে মনে করেন খলিলুর রহমান।
গত ৪ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর জানায়, মিয়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী উ থান শিউ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে থাকা আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা থেকে আংশিক যাচাই-বাছাই শেষ করার তথ্য দিয়েছেন।
এ যাচাই-বাছাইয়ে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য ‘যোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে এক বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমানকে এ তথ্য জানিয়েছিলেন থান শিউ।
আরও ৭০ হাজার রোহিঙ্গার চূড়ান্ত যাচাই বাছাইয়ের অংশ হিসেবে ছবি ও নাম মিলিয়ে দেখার কাজ চলার কথাও বলেছিলেন তিনি।
ওই তালিকার বাকী সাড়ে ৫ লাখ রোহিঙ্গার যাচাই বাছাই কাজও দ্রুত সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মিয়ানমার।
বাংলাদেশ ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ছয়টি ধাপে ওই আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারকে দিয়েছিল।
শুক্রবার দুপুরে উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জুমা পড়ার কথা তুলে ধরে খলিলুর রহমান বলেন, “আমি তাদের বলেছি জাতিসংঘের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হচ্ছে, সেখানে রোহিঙ্গাদের সংঘবদ্ধ এবং স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেখানে তারা তাদের ভবিষ্যৎ আকাঙ্খা ও স্বপ্ন নিয়ে কথা বলতে পারবে।”
তিনি বলেন, “আমরা আশাবাদী, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আগামী ঈদ নিজ দেশে করার রোহিঙ্গাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করার লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।”
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা ঢলের শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট।
এরপর কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে ওই এলাকার ক্যাম্পে বসবাস করছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকার। ওই বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেও সই করে।
২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রুতিতে রোহিঙ্গারা আস্থা রাখতে না পারায় সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়।
এরপর আসে কোভিড মহামারী; রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগেও ঢিল পড়ে। বিশ্বজুড়ে সেই সংকটের মধ্যেই ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সু চির সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সামরিক জান্তা জেনারেল মিন অং হ্লাইং। তাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আসে নতুন ধাক্কা।
এর মধ্যে চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের অংশ হিসেবে কয়েকবার রোহিঙ্গাদের ফেরানোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের যুদ্ধের তীব্রতার মধ্যে প্রত্যাবাসনের আলোচনা কমে আসে। উল্টো রাখাইনে যুদ্ধের কারণে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ শুরু হয়।
এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে আরও ৮০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের তথ্য দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া সব এলাকা বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি দখলে চলে যাওয়ার মধ্যে নেপিদোর সঙ্গে যোগাযোগেও ভাটা পড়ে ঢাকার।
এর মধ্যে গত ১৪ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গাদের কষ্ট নিজের চোখে দেখেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। এক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে তিনি সেদিন ইফতারও করেন।
প্রত্যাবাসনই যে রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান, সে কথা তুলে ধরে জাতিসংঘ প্রধান সেদিন বলেন, “শেষমেষ মিয়ানমারেই সমাধান পেতে হবে আমাদের। এখানে থাকা সব শরণার্থীর স্বেচ্ছা, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত আমরা ক্ষান্ত হব না।”
প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান রাখাইন সম্প্রদায়ের জলকেলি উৎসব উপলক্ষে কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাং পরিদর্শন করেন।
এ সময় সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ সকল ধর্ম, নৃগোষ্ঠী ও সংস্কৃতিতে পরিপূর্ণ একটি দেশ। দেশে এখন উৎসবের আমেজ চলছে।”
এমন আয়োজন আগামীতে এ দেশের সংস্কৃতিতে বড় ধরণের ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান।
ক্যাং পরিদর্শনের সময় খলিলুর রহমানের সঙ্গে ছিলেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান, জেলা প্রশাসক মো: সালাহউদ্দিন ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিলুফা ইয়াসমিন।
পুরনো খবর:
১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে 'প্রত্যাবাসনের যোগ্য' বলছে মিয়ানমার