“টিপু হত্যাকাণ্ডের তদন্ত চলছে। এর পেছনে কারা, নাটের গুরু কারা, কারা ঘটিয়েছে, সবকিছুই খোলসা করে আপনাদের (সাংবাদিক) মাধ্যমে দেশবাসীকে জানানো হবে।”- ঠিক এক বছর আগে এই কথা বলেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
হত্যাকাণ্ডের বছর গড়িয়ে মন্ত্রীর কথারও এক বছর পূর্ণ হল রোববার ২৬ মার্চ। কিন্তু এখনও তদন্ত শেষ করতে পারেনি পুলিশ। এর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৪ জনকে। এক আসামির জবানবন্দিতে টিপুর দল আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের দিকেই উঠছে অভিযোগের আঙুল।
এই পরিস্থিতিতে সন্তানসহ নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন নিহত টিপুর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম ডলি, যিনি নিজেও ক্ষমতাসীন দলের সমর্থনেই ভোটে জিতে নারী কাউন্সিলারের দায়িত্বে রয়েছেন।
এক বছরেও তদন্ত শেষ না হওয়ায় যতটা ক্ষোভ রয়েছে, ফারহানার তার চেয়ে বেশি ক্ষোভ জবানবন্দিতে আসা নেতাদের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদক্ষেপ না দেখে।
“খুন তো খুনই, অপরাধ যেই করুক, দলের নেতা বলে কী তাদের বিচার হবে না?” ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন তিনি।
জাহিদুল ইসলাম টিপু (৫৪) ছিলেন ঢাকার মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যও ছিলেন তিনি। মতিঝিল এজিবি কলোনির গ্র্যান্ড সুলতান রেস্তোরাঁর মালিক টিপু ঠিকাদারির কাজও করতেন। দুই মেয়ে, এক ছেলের জনক টিপু থাকতেন শাহজাহানপুরে।
গত বছরের ২৪ মার্চ রাতে শাহজাহানপুরের আমতলী এলাকার রাস্তায় অস্ত্রধারীর গুলিতে নিহত হন গাড়িতে থাকা টিপু। তার মাইক্রোবাসের পাশে দাঁড়িয়ে গুলি ছোড়ে হেলমেটধারী আততায়ী। ওই সময় গাড়ির কাছেই রিকশায় থাকা বদরুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া আফনান প্রীতিও গুলিতে নিহত হন। টিপুর গাড়িচালক মুন্না বেঁচে গেলেও আহত হন।
হত্যাকাণ্ডের পর অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মামলা করেন ফারহানা। এক বছর পর রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথায় নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেন কাউন্সিলর ফারহানা।
তিনি বলেন, তিনি অনেক আগে থেকেই এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের পরিকল্পনাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি তুলেছিলেন। এখন তাদের নাম একজন আসামির জবানবন্দিতেই এসেছে। কিন্তু তাদের নিয়ে পুলিশের কোনো পদক্ষেপ তিনি দেখছেন না।
টিপু-প্রীতি হত্যাকাণ্ডের একটি মামলায়ই তদন্ত চলছে। ওই মামলায় এখন পর্যন্ত ২৪ জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ ও র্যাব। তাদের মধ্যে তিনজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এদের মধ্যে সুমন শিকদার মুসা রয়েছেন।
মামলাটি তদন্ত করছে ডিবির মতিঝিল বিভাগ। তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে এই বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) রাজিব আল মাসুদ রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মোটামুটি শেষ পর্যায়ে। কিছু ছোটখাট বিষয়ে ক্লিয়ার হওয়ার দরকার আছে। আমরা রিপোর্ট দিয়ে দেব।”
হত্যাকাণ্ডের পরপরই পুলিশ ও র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, খুনের আগে আগে দেশের বাইরে চলে গিয়েছিলেন মুসা। দুবাইয়ে বসেই তিনি দেশে এই হত্যাকাণ্ডের কলকাটি নাড়েন।
বাংলাদেশের পুলিশের চেষ্টায় গত বছরের ১২ মে মুসা মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ ওমানে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ৯ জুন তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। গত বছরের ২৮ জুন ঢাকার হাকিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন মুসা।
কার নাম বলেছেন মুসা?
মুসার জবানবন্দিতে ঘটনার পূর্বাপর উঠে আসে বলে জানিয়েছেন মামলার বাদী ফারহানা।
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, মাসুম মো. আকাশ (গ্রেপ্তার হওয়া) টিপুকে কাছে থেকে গুলি করেছে বলে জানিয়েছেন মুসা। আকাশকে বহনকারী মোটরসাইকেলটি চালাচ্ছিলেন শাহীন নামে একজন।
জবানবন্দিতে মুসা ১৯ জনের নাম উল্লেখ করেছেন বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আশরাফ তালুকদার, ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ মনসুরের নাম রয়েছে।
মুসা বলছেন, হত্যার জন্য বিদেশে বসে যাবতীয় সহায়তা দিয়ে গেছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ ও জাফর আহমেদ মানিক।
আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার আগে পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদেও একই তথ্য দিয়েছিলেন মুসা।
মুসার ভাষ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফ তালুকদারের সঙ্গে তার পুরনো সম্পর্ক। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তিনি আশরাফ তালুকদারকে ফোন করে আইডিয়াল স্কুলে একজন ছাত্র ভর্তির তদ্বির করেছিলেন। এর কিছুদিন পর জানুয়ারির মাঝামাঝিতে আশরাফ তালুকদারের ছোট ভাই টিটু ফোন করে তাকে বায়তুল মোকাররমের উল্টো দিকের একটি রেস্তোঁরায় ডেকে নেন।
সেখানে গিয়ে আশরাফ তালুকদার, কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ মনসুর, যুবলীগ নেতা মারুফ রেজা সাগর (গ্রেপ্তার), ছাত্রলীগ নেতা সোহেল শাহরিয়ার রানা (গ্রেপ্তার), মোল্লা রানা, সোহেল, আমিনুল, বাবুল তালুকদার এবং রানার অনুসারী রিফাত, টিটু ও খায়রুলকে দেখতে পাওয়ার কথা বলেছেন মুসা।
তার ভাষ্য অনুযায়ী, সেখানে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ ও আইডিয়াল স্কুলে ভর্তি বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, আর সবাই টিপুর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। এসব নিয়ে জিসান ও মানিকের ক্ষোভের কথা বলেন সোহেল। পরে জিসান ও মানিক ভিডিও কলে সেই বৈঠকে যুক্ত হন। তারা টিপু ও তার অনুসারীদের এলাকাছাড়া করতে সাহায্যের প্রস্তাব দেন।
মুসা বলেন, এরপর আশরাফ ও মনসুর ওই হোটেল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কিছু লাগলে ‘ব্যবস্থা করে’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
জবানবন্দিতে মুসা বলেন, সপ্তাহখানেক পর বেইলি রোডে ফকরুদ্দীন বিরিয়ানির দোকানে আবার তাকে ডেকে নেওয়া হয়। সেখানে বসে সিদ্ধান্ত হয়, টিপুকে এজিবি কলোনিতে মারা যাবে না। কারণ সেখানে মারলে আশরাফ ভাই ও মনসুর ফেঁসে যেতে পারেন।
টিপুকে খুনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এরপর জিসান ও মানিক তাড়া দিকে থাকলে এক পর্যায়ে দুবাই চলে যান বলে মুসা জানান। তবে পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কথা স্বীকার করেন তিনি।
‘সবই কাল্পনিক’
মুসার জবানবন্দিতে নিজের নাম আসার খবরে বিস্ময় প্রকাশ করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফ তালুকদার।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুসা যেটা বলেছে সেটা নিছক একটা কাল্পনিক গল্প। এটা ইচ্ছাকৃতভাবে হোক বা অন্য কোনোভাবে হোক সে এটা করেছে। এটার সাথে আমার ব্যক্তিগত কোনো যোগাযোগ নেই।”
মুসাকে চেনেনই না দাবি করে তিনি বলেন, “আমি আগে কিছুই জানতাম না, পত্রপত্রিকায় দেখেই জেনেছি। আমি বিভিন্ন সাংগঠনিক দায়িত্ব নিয়ে ব্যস্ত থাকি। কোথায় কে মিটিং করছে আর এ মুসা না কে, একে আমি কোনোদিন দেখিও নাই, চিনিও না। তার সঙ্গে বৈঠক করার প্রশ্নই আসে না। আর অভ্যাসগত কারণে আমি কোনো রেস্তোরাঁয় বসে আড্ডা মারি না।”
টিপু খুনে তাকে জড়ানোর পেছনে অন্য কোনো অভিসন্ধি থাকতে পারে মনে করেন আশরাফ তালুকদার।
তিনি বলেন, “আমি যেহেতু দীর্ঘদিন রাজনীতি করি। আমার একটা সুনাম আছে। রাশেদ খান মেননের (বর্তমান সংসদ সদস্য) সঙ্গে তিন বার তিনটা নির্বাচনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছি।
“মানুষ এমনও মনে করতে পারে, আগামী দিনে আমি এখানে এমপি ইলেকশনও করতে পারি, মহানগরের সাধারণ সম্পাদকও হতে পারি। সবকিছু মিলে আমি গন্ধ পাচ্ছি এসবই হচ্ছে রাজনীতি থেকে আমাকে দূরে রাখার একটা ষড়যন্ত্র।”
নিজের দলের নেতা টিপু হত্যার বিচার চাওয়ার কথাও বলেন আশরাফ তালুকদার।
“টিপু আমার রাজনৈতিক সহকর্মী ও ফ্রেন্ড ছিল। আমি চাই এটার সুষ্ঠু বিচার হোক,” বলেন তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ মনসুরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
মুসাকে ফিরিয়ে আনার পর র্যাব বলেছিল, মতিঝিল এলাকায় আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্ব আর পুরনো শত্রুতার জেরে খুন হন টিপু।
২০১৩ সালের ৩০ জুলাই গুলশান শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিল্কী খুন হয়েছিলেন। সেই খুনের মামলায় আসামি ছিলেন টিপু, পরে অবশ্য তিনি মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন।
‘নেপথ্যের লোকেরা যেন গ্রেপ্তার হয়’
টিপুর স্ত্রী ফারহানা বলেন, “যারা এই খুনের সঙ্গে জড়িত, সবই আমার দলের লোক। এটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য! তারা অনেকেই পদে বহাল আছে। আবার শুনছি তাদের জন্য দলেরই অনেক দায়িত্বশীল নেতা তদ্বির করছেন। এগুলো দেখে আরও কষ্ট লাগছে।”
মুসার স্বীকারাক্তিতে যাদের নাম এসেছে, তাদের গ্রেপ্তার চেয়ে তিনি বলেন, “আমি শুরু থেকেই বলছি শুটার এখানে মেইন সাবজেক্ট না। যারা পরিকল্পানাকারী, আমি তাদের বিচার চাই। তাদের মুখোশ এখন খুলছে। যদি তারা অন্যায় না করে থাকে তবে আইন তাদের রেহাই দেবে। তবে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।”
নিরাপত্তাহীনতার ভুগছেন জানিয়ে কাউন্সিলর ফারহানা বলেন, “কতগুলো নম্বর থেকে ফোন আসে। আমি ধরি না। মোবাইলে একটা সিস্টেম করে দিছে ডিবিরা। ওই যে অটো ব্লক হয়ে যায়। তবে ফোন আসে, তখন ওগুলো তাদের দেখাই।”
ফোন না ধরলে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করেও নানা হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি। তাদের রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপককে হুমকি দেওয়ার পর মতিঝিল থানায় একটি জিডি করছেন বলে জানান ফারহানা।
ক্ষোভ থাকলেও ডিবির তদন্তে ভরসা থাকার কথা বলেন টিপুর স্ত্রী।
“ডিবি খুবই ভালো কাজ করছে। নাহলে মামলাটা এই পর্যন্ত আসতই না। আসামি আরও যারা আছে, আর জবানবন্দিতে যাদের নাম আছে, তাদের গ্রেপ্তার করে দ্রুত চার্জশিটটা দেওয়া হোক। তাহলে অন্তত আমার আর আমার ছেলে-মেয়েরা একটু হলেও নিরাপদ হব।”