পদ্মায় দুর্নীতির প্রমাণ পায়নি দুদক, সবাইকে অব্যাহতি

পদ্মা সেতু নির্মাণে ‘দুর্নীতি বা ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়নি’ জানিয়ে সব আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Sept 2014, 10:44 AM
Updated : 3 Sept 2014, 03:50 PM

বুধবার দুদক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান এ তথ্য জানান।

তিনি বলেন, “মামলার মেরিট না থাকায়, তদন্তে পর্যাপ্ত তথ্য ও সাক্ষী না পাওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদনের জন্য মামলাটি নথিভুক্ত করা হয়েছে। দেড় বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তে মামলাটিকে এগিয়ে নেওয়ার মতো তথ্য পাওয়া যায়নি। তাই আদালতে চার্জশিট পেশ করা সম্ভব হচ্ছে না।”

চূড়ান্ত প্রতিবেদনের অনুলিপি আদালতে পাঠানো হবে বলেও জানান তিনি।

সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান দুদক কমিশনার সাহাবুদ্দিন চুপপু।

দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে দীর্ঘ টানাপড়েন শেষে গত বছর জানুয়ারিতে দেশের সবচেয়ে বড় এ অবকাঠামো প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল হয়ে যায়

এর আগে বিশ্ব ব্যাংকের তাগিদে ‘ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে দুদকের উপ পরিচালক আবদুল্লাহ আল জাহিদ ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর বনানী থানায় এই মামলা দায়ের করেন, যাতে সাতজনকে আসামি করা হয়। 

মামলায় প্রধান আসামি করা হয় সেতু বিভাগের তখনকার সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে। তাকে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি সরকারি চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান। গত বছর জুনে বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে তাকে চাকরিও ফিরিয়ে দেয়া হয়। 

বাকি ছয়জন হলেন- সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (নদী শাসন) কাজী মো. ফেরদৌস, সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজ আহমেদ জাবের, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালটেন্ট লিমিটেডের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশে কানাডীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের স্থানীয় প্রতিনিধি মোহাম্মদ মোস্তফা, এসএনসি-লাভালিনের সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল, এই সংস্থার আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহ ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস।

মামলায় বলা হয়েছিল- “এই আসামিরা পারস্পরিক যোগসাজশে ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্র করার মাধ্যমে পদ্মা সেতু প্রকল্পের তদারকি পরামর্শকের কাজ এর অন্যতম দরদাতা এসএনসি লাভালিন ইন্টারন্যাশনালকে পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে। এর মধ্য দিয়ে তারা দণ্ডবিধির ১৬১ এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে অপরাধ করেছেন, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।”  

এসএনসি লাভালিন ওই কার্যাদেশ পেলে ‘ঘুষ লেনদেন সম্পন্ন হতো’ বলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছিল।

দুর্নীতির ওই ষড়যন্ত্রে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে পদত্যাগে বাধ্য হন সেই সময়ের যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেন। অভিযোগ ছিল সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর বিরুদ্ধেও। তবে তাদের নাম এ মামলার আসামির তালিকায় রাখেনি দুদক। 

এ প্রসঙ্গে এজাহারে বলা হয়েছিল, ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রে তাদের ভূমিকার বিষয়ে অনুসন্ধানে যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারেনি দুদক। মামলার তদন্তের সময় তাদের বিষয়ে অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে।

দুদক চেয়ারম্যান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রাথমিক তথ্য ও চূড়ান্ত সত্যতা এক নয়। প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তি ছিল পত্রিকায় প্রকাশিত খবর  ও বিশ্ব ব্যাংকের অভিযোগ।

“২০১১ সালে পদ্মা সেতু নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আমরা এই দুর্নীতির তথ্য সম্পর্কে জানতে পারি। এরপর বিশ্ব ব্যাংকের অনুরোধে আমরা একটি টিম গঠন করি। এর মধ্যে বিশ্ব ব্যাংকের টিম একাধিকবার বাংলাদেশে আসে এবং আমাদের সঙ্গে তাদের কয়েক দফা বৈঠক হয়। দুদক টিম দীর্ঘদিন এই অভিযোগ অনুসন্ধান করে।”

সেই অনুসন্ধান শেষেই ২০১২ সালে দুদক মামলা দায়ের করে, যা ছিল মূলত ‘দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের’ মামলা।

বদিউজ্জামান বলেন, “বিশ্ব ব্যাংকের আশ্বাসের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করা হলেও মামলা চালানোর জন্য দাতাসংস্থা ও কানাডা থেকে পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত পাওয়া যায়নি। ফলে শেষ পর্যন্ত কমিশন মামলা থেকে সকল আসামিকে অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনের কপি শিগগিরই আদালতে পাঠানো হবে।”

দুদক কমিশনার সাহবুদ্দিন চুপপু এ বিষয়ে বলেন, “মামলা দায়েরের পর তদন্তের স্বার্থে বিশ্ব ব্যাংক) কিছু তথ্য আমাদের দিয়েছিল, কিন্তু তাতে কোথাও এমন কোনো স্পষ্ট ইনফরমেশন বা প্রমাণ নেই যে ঘুষের ষড়যন্ত্র হয়েছে।”

বিশ্ব ব্যাংকের অনুরোধে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে কানাডায় এসএনসি লাভালিনের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটির আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহ ও সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর টরোন্টোতে তাদের বিচারও শুরু হয়।

ওই সময় রমেশ সাহের কাছ থেকে কানাডীয় পুলিশের জব্দ করা একটি ডায়েরি নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়, যাতে কাকে কতো শতাংশ ঘুষ দেয়া হবে তার সাংকেতিক বিবরণ ছিল বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়।  

এসব প্রতিবেদনে বলা হয়, এসএনসি-লাভালিনকে পদ্মা সেতুর পরামর্শকের কাজ পাইয়ে দিলে প্রকল্প ব্যয়ের চার শতাংশ আবুল হোসেনকে এবং আরো কয়েকজন কর্মকর্তাকে আরো ছয় শতাংশ দেয়ার কথা ছিল। প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা মসিউর রহমান, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী কায়সার এবং সেতু সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার নামও তাতে উঠে আসে।

দুদকের পক্ষ থেকে সে সময় বলা হয়েছিল, তারা তদন্তের জন্য সেই ডায়েরির কপি সংগ্রহের চেষ্টা করছেন।

সাহবুদ্দিন চুপপু এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে ডায়েরি শব্দটি ছিল, কানাডার আদালতে যাকে বলা হয়েছে নোটবুক। আমরা ওই  নোটবুকের কপি পর্যালোচনা করেছি। তাতে কোনো আসামিকেই দোষী সাব্যস্ত করা যায় না।”

সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে কমিশনার বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের ‘তথ্য-প্রমাণ দেয়ার আশ্বাসেই’ দুদক মামলা করেছিল। তদন্তের স্বার্থেই এজাহারভুক্ত আসামি হিসাবে সে সময় মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের পর নিজস্ব অর্থায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয় সরকার। ১২ হাজার কোটি টাকায় চার বছরের মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণে চীনা কোম্পানি মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তিও করা হয়। জমি অধিগ্রহণ করে সেতুর সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।