বিশ্ব ব্যাংকের অর্থ নেবে না বাংলাদেশ

বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়নের অনুরোধ আনুষ্ঠানিকভাবে ফিরিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ।  

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Jan 2013, 11:11 PM
Updated : 31 Jan 2013, 11:11 PM
শুক্রবার বিশ্ব ব্যাংকের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “বাংলাদেশ সরকার গতকাল বিশ্ব ব্যাংককে জানিয়েছে, তারা পদ্মা সেতুর জন্য অর্থায়নের অনুরোধ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে।”

তবে পদ্মা প্রকল্পে দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে তদন্ত চালিয়ে যাবে বলে বিশ্ব ব্যাংককে জানিয়েছে সরকার।

বিবৃতিতে বলা হয়, “বাংলাদেশ সরকারের এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বিশ্ব ব্যাংক অবগত হয়েছে এবং পদ্মা প্রকল্পে দুর্নীতির পূর্ণ ও নিরপেক্ষ তদন্ত শেষ করার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে উৎসাহ দিচ্ছে।”   

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিশ্ব ব্যাংককে চিঠি দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন এবং বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী প্রয়োজনে নিজেদের অর্থায়নেই এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন হবে। 

শুক্রবার সকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বিশ্ব ব্যাংককে বলেছি, অর্থায়ন পুনর্বিবচেনার যে অনুরোধ আমরা করেছিলাম, তা আমরা প্রত্যাহার করছি। এখন আমাদের এ প্রকল্পে তোমাদের অর্থায়নের আর প্রয়োজন নেই।”

“একইসঙ্গে আমরা এডিবি, আইডিবি ও জাইকাকে বলেছি, গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পে তারা যেন থাকে। আমার বিশ্বাস, তারা আমাদের এ প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট থাকবে”, বলেন মুহিত।

বিশ্ব ব্যাংকের বিবৃতি আসার প্রায় ১২ ঘণ্টা পর সরকারের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, “বাংলাদেশ সরকার কিছুদিন আগে থেকেই বলছে যে তারা জানুয়ারি ২০১৩ এর মধ্যে পদ্মা সেতুর অর্থায়নে বিশ্ব ব্যাংকের প্রত্যাবর্তন আশা করছিল এবং জানুয়ারিতেই এই বিষয়ক বিকল্প সিদ্ধান্ত নিতে সরকার বদ্ধপরিকর। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার গতকাল (বৃহস্পতিবার) বিশ্ব ব্যাংককে জানিয়ে দেয় যে তারা পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ এখনি শুরু করতে চিইছে এবং বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন ছাড়াই কাজটি শুরু করতে হচ্ছে।”

বিশ্ব ব্যাংকের সময়সূচি মেনে এগোলে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ অনিশ্চিত হয়ে পড়ত উল্লেখ করে সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়, “প্রয়োজনে প্রকল্পের ব্যয় কমানোর জন্য শুধু সড়ক সংযোগ সেতু নির্মাণ করা হবে।”

২৯০ কোটি ডলারের এ প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের ১২০ কোটি ডলার দেয়ার কথা ছিল। এছাড়া এডিবি ৬১ কোটি, জাইকা ৪০ কোটি ও আইডিবি ১৪ কোটি ডলার দেয়ার জন্য চুক্তি করে সরকারের সঙ্গে। কিন্তু কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি লাভালিনের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ ওঠার পর ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে চুক্তি স্থগিত করে বিশ্ব ব্যাংক।

দুদক এরপর তদন্ত শুরু করলেও সরকারের সঙ্গে মতভেদ না কাটায় গত জুন মাসে বিশ্ব ব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করে। এরপর সরকারের নানামুখী তৎপরতায় তারা সিদ্ধান্ত বদলায়।

তাদের দেয়া শর্ত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সাবেক প্রসিকিউটর লুইস গাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্যানেল দুদকের তদন্ত পর্যবেক্ষণে দুই দফা ঢাকা সফর করে।

দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ার পর অনুসন্ধান পর্যায়ে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান, সাবেক সেতু সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াসহ ২৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুর্নীতি দমন কমিশন।

তবে গত বছর ১৭ ডিসেম্বর ‘ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে দুদক সাত জনের বিরুদ্ধে যে মামলা করে তাতে আবুল হোসেন ও আবুল হাসানের নাম বাদ দেয়া হয়।

এরপর বিশ্ব ব্যাংক প্যানেল চলতি মাসে দুদকের তদন্ত নিয়ে একটি চিঠি পাঠায়, যাতে পর্যবেক্ষকরা তদন্ত নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়।  বিশ্ব ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, শর্ত পূরণ না হলে তারা পদ্মার অর্থ ছাড় করবে না। 

এসব বিষয়ে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বিবৃতিতে বলা হয়, “সরকার প্রথম থেকেই বলছে যে বিশ্ব ব্যাংকের দুর্নীতি বিষয়ক অভিযোগ তারা যথাযথভাবেই বিবেচনা করছে। কিন্তু অভিযোগের  পক্ষে প্রমাণের অভাবে ২০১২ সালের জুন মাস পর্যন্ত এফআইআর পেশ করার মতো অবস্থা ছিল না। বিশ্ব ব্যাংক নভেম্বর মাসে অতিরিক্ত প্রমাণ সরবরাহ করলে বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন কিছু অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এফআইআর পেশ করে। এই এফআইআরে তারা আরো কতিপয় অভিযুক্ত ব্যক্তি সম্বন্ধে তদন্ত চালিয়ে যাবার ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানায়।

“বাংলাদেশ সরকার মনে করে যে, এই পদক্ষেপ যথাযথ এবং তারই ভিত্তিতে বিশ্ব ব্যাংকের প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু করা সমীচীন হতো। এ ক্ষেত্রে দেখা গেল যে বাংলাদেশ সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সূচি বিশ্বব্যাংকের সময়সূচির সঙ্গে সমঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিশ্ব ব্যাংকের সময়সূচি অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ অনিশ্চিত।”

অর্থায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে গত বছরেই মালয়শিয়া সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা এগিয়ে নেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। দুইপক্ষের মধ্যে সমঝোতাও হয়।

এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থ অনুদান নিয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়নেরও প্রক্রিয়া শুরু হয় গতবছর। অনুদানের অর্থ সংগ্রহের জন্য দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খোলা হয়।

গত ২৩  জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, জানুয়ারিতে বিশ্ব ব্যাংকের সাড়া না পেলে ‘বিকল্প অর্থায়নে’ পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হবে।

তিনি বলেন, “পদ্মা সেতু আমরা করব। আমি আপনাদের এটুকু আশ্বাস দিতে পারি- বিকল্প ব্যবস্থা আমাদের আছে।”

বিশ্ব ব্যাংককে ‘না’ বলে দেয়ার পর পদ্মা প্রকল্পের ভবিষ্যৎ কি হবে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী মুহিত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন, নিজস্ব অর্থায়নে আমরা এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করব। সে লক্ষ্য সামনে রেখেই আমরা দ্রুত কাজ শুরু করব।”

“আওয়ামী লীগ নির্বাচনের আগে পদ্মা সেতু নির্মাণের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেই অঙ্গীকার পূরণে এখন আমরা দ্রুত অগ্রসর হবো”, বলেন অর্থমন্ত্রী।  

আগামী রবি বা সোমবার জাতীয় সংসদে এ বিষয়ে বক্তব্য দেয়ার কথা রয়েছে মুহিতের।