আসামি ৭, হাসান-হোসেন বাদ

ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে এ মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Dec 2012, 04:00 AM
Updated : 11 Feb 2017, 12:10 PM

দীর্ঘ  টানাপড়েনের পর ‘ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে সাত জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), যাতে সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেন বা সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীকে আসামি করা হয়নি।  

দুদকের উপ পরিচালক আবদুল্লাহ আল জাহিদ সোমবার রাজধানীর বনানী থানায় এ মামলা দায়ের করেন। এতে প্রধান আসামি করা হয়েছে সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে, বিশ্ব ব্যাংকের শর্ত অনুসারে যাকে আগেই ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।

বাকি ছয় আসামি হলেন- সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (নদী শাসন) কাজী মো. ফেরদৌস, সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজ আহমেদ জাবের, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালটেন্ট লিমিটেডের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশে কানাডীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের স্থানীয় প্রতিনিধি মোহাম্মদ মোস্তফা, এসএনসি-লাভালিনের সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল, এই সংস্থার আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহ ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস।

এজাহারের বরাত দিয়ে বনানী থানার ওসি ভূঁইয়া মাহবুব হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই আসামিরা পারস্পরিক যোগসাজশে ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্র করার মাধ্যমে পদ্মা সেতু প্রকল্পের তদারকি পরামর্শকের কাজ এর অন্যতম দরদাতা এসএনসি লাভালিন ইন্টারন্যাশনালকে পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে। এর মধ্য দিয়ে তারা দণ্ডবিধির ১৬১ এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নতি প্রতিরোধ আইনে অপরাধ করেছেন, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।”   

এসএনসি লাভালিন ওই কার্যাদেশ পেলে ‘ঘুষ লেনদেন সম্পন্ন হতো’ বলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী প্রসঙ্গে এজাহারে বলা হয়েছে, ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রে তাদের ভূমিকার বিষয়ে অনুসন্ধানে যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারেনি দুদক। মামলার তদন্তের সময় তাদের বিষয়ে অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে।

কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি লাভালিনের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ ওঠার পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে ২৯১ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি স্থগিত করে বিশ্ব ব্যাংক।

দুদক এরপর তদন্ত শুরু করলেও সরকার এবং তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন দুর্নীতির অভিযোগ নাকচ করে অনড় থাকেন। এই প্রেক্ষাপটে গত জুন মাসে ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্ব ব্যাংক।

এরপর আবুল হোসেনের পদত্যাগ, প্রকল্পের ইন্টেগ্রিটি অ্যাডভাইজর ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান এবং সেতু বিভাগের তৎকালীন সচিব মোশাররফ হোসেন ভূইয়াকে ছুটিতে পাঠানোসহ সরকারের নানামুখী তৎপরতায় বিশ্ব ব্যাংক সিদ্ধান্ত বদলায়।

তাদের দেয়া শর্ত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সাবেক প্রসিকিউটর লুই গাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্যানেল দুদকের তদন্ত পর্যবেক্ষণে দুই দফা ঢাকা সফর করে। এই প্যানেলের প্রতিবেদনের ওপরই নির্ভর করছে বহু প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু নির্মাণ, যা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি।

দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ার পর অনুসন্ধান পর্যায়ে সৈয়দ আবুল হোসেন, আবুল হাসান, মোশাররফ হোসেনসহ ২৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুর্নীতি দমন কমিশন।

দুর্নীতি দমন কমিশনের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হন প্রকল্পের ইন্টেগ্রিটি অ্যাডভাইজর ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান, সাবেক প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলাম, জাতীয় সংসদের হুইপ নূর আলম চৌধুরী লিটনের ভাই নিক্সন চৌধুরী ও এসএনসি-লাভালিনের স্থানীয় এজেন্ট জিয়াউল হক।

এছাড়া প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মূল্যায়ন কমিটির প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. আনম সফিউল্লাহ, পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. ইশতিয়াক আহমেদ, সড়ক ও জনপথ বিভাগের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী তরুণ তপন দেওয়ান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মকবুল হোসেন, ইস্টার্ন বাংলাদেশ ব্রিজ ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পের পরিচালক মো. দলিল উদ্দিন ও সেতু বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (নদী শাসন) কাজী মো. ফেরদৌসও জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হন।

তদন্ত শুরুর পর দুদক দীর্ঘদিন দুর্নীতির কোনো তথ্য প্রমাণ না পাওয়ার কথা বললেও তদন্তকারী এ সংস্থার চেয়ারম্যান গোলাম রহমান গত ২৭ নভেম্বর সাংবাদিকদের বলেন, পদ্মা প্রকল্পের কাজ পেতে ‘ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রে’ প্রমাণ পেয়েছেন অনুসন্ধানকারী প্যানেল।

দুদকের জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক আবদুল্লাহ-আল জাহিদ, মীর জয়নুল আবেদীন শিবলী, গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী ও উপ-পরিচালক মির্জা জাহিদুল আলমকে নিয়ে গঠিত ওই ‘অনুসন্ধান প্যানেল’ গত ৪ ডিসেম্বর কমিশনে যে প্রতিবেদন জমা দেয়, তাতে কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশ করা হয়।

ঠিক কতোজনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ এসেছে- সে সময় তা না জানালেও গোলাম রহমান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ওই সংখ্যা ১০ এর কম।

অনুসন্ধান প্যানেলের ওই প্রতিবেদন নিয়ে গত ৫ ডিসেম্বর বিশ্ব ব্যাংকের তিন পর্যবেক্ষকের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করেন দুদক কর্মকর্তারা। ওই বৈঠকের পর দুদক চেয়ারম্যান বলেছিলেন, দুর্নীতির ‘ষড়যন্ত্র’ যে হয়েছিল, সে বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংক ও দুদক ‘একমত’ হলেও কার কার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে- সে বিষয়ে মতৈক্য হয়নি।

শেষ পর্যন্ত মতৈক্য ছাড়াই ঢাকা ছাড়েন বিশ্ব ব্যাংকের পর্যবেক্ষক ওকাম্পো ও তার সঙ্গী টিমোথি টং ও রিচার্ড অল্ডারম্যান।

এরপর ৮ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে বিশ্ব ব্যাংক সাফ জানিয়ে দেয়, দুর্নীতি দমন কমিশন ‘সুষ্ঠু ও পূর্ণাঙ্গ’ তদন্ত না করা পর্যন্ত তারা পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না ।