আদালত অবমাননার অভিযোগের শুনানিতে প্রকাশিত নিবন্ধের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ একজন সম্পাদক।
Published : 11 Mar 2014, 06:37 PM
মিজানুরের জবাবেও ‘আদালত অবমাননা’
প্রথম আলো সম্পাদককে ডেকেছে আদালত
সমকাল ও নয়া দিগন্তের বিরুদ্ধে অবমাননার রুল
‘আদালতকে আক্রমণ করা মিজানুরের অভ্যাস’
নিবন্ধ প্রকাশের দায় নিয়ে আদালতে দুঃখ প্রকাশ করেছেন পত্রিকাটির সম্পাদক মতিউর রহমান।
মঙ্গলবার এ দুজনের বক্তব্য এবং দুপক্ষের আইনজীবীদের শুনানি শেষে আদালত মামলার রায়ের জন্য বৃহস্পতিবার দিন রেখেছেন।
মঙ্গলবার আদালতে হাজির হয়ে মতিউর রহমান বলেন, “আপনি (বিচারক) যেভাবে বলছেন তাতে মনে হচ্ছে, আপনার কাছে আমার দুঃখ প্রকাশ করতে কোনো আপত্তি নেই।”
শুনানির শেষ পর্যায়ে প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান বলেন, “আমার উদ্দেশ্য কোনভাবেই এই মহান প্রতিষ্ঠানকে (আদালত) আঘাত করা নয়। যদি আঘাত করে থাকি তাহলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।”
দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত দুটি লেখা নিয়ে গত ২ মার্চ পত্রিকাটির যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খানকে তলব করে বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমদের বেঞ্চ। পাশাপাশি মিজানুরের বিরুদ্ধে দুটি এবং প্রথম আলো সম্পাদকের বিরুদ্ধে একটি রুল জারি করে আদালত।
বৃহস্পতিবার থেকে মিজানুর রহমান খানের উপস্থিতিতে চার দিন শুনানি হয়।
মঙ্গলবার সকালে মতিউর রহমান ও মিজানুর রহমানের আইনজীবী শাহদীন মালিক শুনানি শুরু করেন।
এক পর্যায়ে আদালতে উপস্থিত মতিউর রহমানকে কথা বলার জন্য ডাকা হয়।
মতিউর রহমান আইনজীবীদের বক্তব্য দেয়ার ডায়াসে দাঁড়ালে আদালত তাকে বলেন, “আপনি দেশের মোস্ট সার্কুলেটেড নিউজপেপারের সম্পাদক ও প্রকাশক, এটা কি সত্যি?”
মতিউর রহমান বলেন, “জ্বি, সত্যি।”
আদালতের প্রশ্ন, “আপনার পত্রিকায় যে নিবন্ধ দুটি ছাপা হয়েছে, তা কি আপনি পড়েছেন?”
মতিউর বলেন, “পড়েছি।”
আদালত প্রশ্ন করে, “আপনার কি মনে হয়েছে যে, এই লেখায় আদালত অবমাননা হয়েছে?”
মতিউর বলেন, “আমরা ১৫ বছর ধরে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য কাজ করছি। আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। বিচার বিভাগকে দুর্বল করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।
“একটা সংবাদপত্র প্রতিদিন ২৪ থেকে ৩২ পৃষ্ঠা বের হয়। অনেক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। প্রতিটা সংবাদ ব্যাখ্যা করে, আলোচনা করে চূড়ান্ত করা সম্ভব নয়। সেখানে ভুল হতে পারে, তবে ইচ্ছাকৃত বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমরা কিছু করিনি।”
এ সময় আদালত জানতে চায়, “সাংবাদিকদের আচরণবিধি আছে কি, আপনি এ বিষয়ে জানেন?”
মতিউর বলেন, “আমাদের নিজেদের আচরণবিধি আছে, আমরা সেটা মেনে চলি। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ পেশা। এটাকে ব্যবহার করে যে কেউ যে কারো বিরুদ্ধে ক্ষতিও করতে পারে। সেজন্য আমরা প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করার কথা বলি। আমাদের বিরুদ্ধে কেউ সংবাদ করলে আমরা আদালতে আসি না। প্রেস কাউন্সিলে যাই।”
এ সময় বিচারক বলেন, “এরকমও দেখেছি, বড় বড় পত্রিকায় লেখা থাকে যে মন্তব্য লেখকের নিজস্ব।”
মতিউর বলেন, “আমি সম্পাদক হিসেবে তো দায় এড়াতে পারি না।”
বিচারক বলেন, “ইন্টারন্যাশন্যান হেরাল্ড ট্রিবিউন, গার্ডিয়ানে এরকম কিন্তু থাকে। আবার ডিসটরটেড এবং বেইজলেস পাবলিকেশন হলে তার দায় সম্পাদককে নিতে হয়।”
মতিউর বলেন, “এটা প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছে, সম্পাদক হিসেবে এটা অস্বীকার করবো কিভাবে?”
এ সময় বিচারক বলেন, “এই লেখাটা পড়লে মনে হয়, এটা পার্টিকুলার বেঞ্চ নিয়ে লেখা হয়েছে। আমি বা আমার ব্রাদার (কনিষ্ঠ বিচারপতি) ব্যক্তিগতভাবে ক্ষুব্ধ কি না সেটা বড় কথা নয়। এটা পুরো আদালতকে নিয়েই বলা হয়েছে।
“হলফনামায় দেখছি, আপনিওতো (মতিউর) এন্টিসিপেটরি জামিন নিয়েছেন।”
মতিউর বলেন, “হ্যা, দুবার নিয়েছি। জামিন নিয়ে এখন জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। অনেক সময় সেশন জজ জামিন দেয় না। লোয়ার কোর্টে যেতে ভয় করে। এ কারণে মানুষ হাই কোর্টে আসে।”
মিজানুরের লেখার প্রসঙ্গ টেনে আদালত জানতে চায়, “উনি (মিজানুর) ব্যাখ্যা দিয়েছেন, আর পাঁচটি বেঞ্চ জামিন দিলেও এই বেঞ্চকে সিম্বলিক হিসেবে লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে। কেন এটা করা হয়েছে? এই বেঞ্চে নারী বিচারক আছে, তার মানে আমরা কি ধরে নেবো জেন্ডার বায়াসড হয়ে এটা করেছেন?”
মতিউর বলেন, “না, না, এটা বলে আমাদের লজ্জা দিবেন না। আমরা নারী স্বাধীনতা নিয়ে অনেক কাজ করছি।”
বিচারক বলেন, “পার্টিকুলার এই বেঞ্চ নিয়ে লেখার ফলে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত মানুষ জেনে গেছে যে, এই বেঞ্চ জামিন দেয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে বসে আছে। হয়তো টেকনাফ থেকে অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ীও জামিনের জন্য চলে আসবে।
“এই লেখায় আমাদের নাম ছড়িয়ে গেছে। থ্যাংক ইউ ফর দ্যাট। পাঁচ বছর পরে একজন ফোন করে বলছেন, তুমি জাজ হয়ে গেছো এটা জানি না। আরেকজন জানতে চেয়েছে, তুমি ক্রিমিনাল ম্যাটার শুনানি কর। আমি যদি আত্মজীবনী লিখি তাহলে এসব লিখবো।”
মতিউর বলেন, “আমাদের ভালো একটা প্রকাশনা সংস্থা আছে, প্রথমা। আমরা ভালো ভালো লেখকের লেখা ছাপাই। আপনি লেখেন। আপনারটাও ছাপাবো।”
এ সময় আদালতকক্ষে উপস্থিত সবাই হাসতে শুরু করেন। কাঠগড়ায় বসা মিজানুর রহমানও হাসছিলেন, তখন তার দিকে তাকিয়ে বিচারক বলেন, “অবশেষে আজ তিনি হাসছেন।”
একথা বলার পর মিজানুর আরো হাসতে থাকেন।
মতিউর তার আইনজীবী শাহদীন মালিকের সঙ্গে কিছু পরামর্শ করে আদালতকে বলেন, “আপনি (বিচারক) যেভাবে বলছেন তাতে মনে হচ্ছে, আপনার কাছে আমার দুঃখ প্রকাশ করতে কোনো আপত্তি নেই।
“জামিন পাওয়ার অধিকার নাগরিকদের আছে। বিচার বিভাগকে খাটো করার কোনো উদ্দেশ্য আমাদের ছিল না।”
এক পর্যায়ে মতিউর রহমানকে উদ্দেশ্য করে বিচারক বলেন, “আমরা আপনাকে হেরাস করার জন্য ডাকি নাই। আসার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি চাইলে বিচার প্রক্রিয়া দেখতেও পারেন আবার চাইলে চলেও যেতে পারেন।”
পরে মতিউর রহমান ডায়াস থেকে গিয়ে আইনজীবীদের বেঞ্চে বসেন।
এ সময় আবার শুনানি করতে থাকেন শাহদীন মালিক।
তার শুনানির মধ্যে আইনজীবী জয়নুল আবেদীন দাঁড়িয়ে বলেন, “আমি একটি কথা বলি, শাহদীন মালিক সাহেব শুনানি করছেন। উনি কি বলতে চাচ্ছেন, সেটা আমরা বুঝতে পারছি না। উনি কি ক্ষমা প্রার্থনা করছেন নাকি লড়ছেন?”
তখন শাহদীন মালিক বলেন, তিনি এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি।
জবাবে বিচারক বলেন, “২ মার্চ আমরা রুল দিলাম। এখনো তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। এটা কেমন কথা হলো। আপনি তাকে জিজ্ঞেস করেন।”
মিজানুরের সঙ্গে পরামর্শ করে শাহদীন মালিক তাকে কথা বলতে সুযোগ দেয়ার জন্য আবেদন জানান।
আদালত অনুমতি দিলে মিজানুর বলেন, “আমাকে কথা বলতে সুযোগ দেয়ার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমার সম্পাদক মহোদয়ের সঙ্গে একমত পোষণ করে আমি বলছি, ভুল হতেই পারে।
“আমি ১৯৮৯ সাল থেকে আইন নিয়ে লিখছি। আইনজীবীরাও আমার অনেক লেখা এপ্রিসিয়েট করেছেন।”
“আমার লেখায় এই প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের লক্ষ্য ছিল। অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। তবে শব্দচয়ন বা বাক্যের ব্যবহার হয়তো যথাযথ ছিল না।”
তিনি বলেন, “আমার উদ্দেশ্য কোনোভাবেই এই মহান প্রতিষ্ঠানকে আঘাত করা নয়। যদি আমার লেখায় আঘাত করে থাকে তাহলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।”
এরপর আবার শুনানি করতে থাকেন শাহদীন মালিক। এ সময় আদালত আবার জিজ্ঞেস করে, উনি যেটা লিখেছেন, সেটার সঙ্গে তিনি এখনো একমত কি-না।
এ সময় রোকন উদ্দিন মাহমুদ বলেন, “বিষয়টা অন্যভাবে চলে গেছে। আমরা এটা চাই না। আপনি এটা শেষ করে রায়ের জন্য রেখে দেন।”
এ সময় আহসানুল করিম বলেন, “বিষয়টা তেঁতো হয়ে গেছে। বেশি হয়ে গেছে।”
রোকন উদ্দিন মাহমুদ বলেন, “আমরা একটা জিনিসই চাই। কারা সাংবাদিকতা করতে পারবে, একটা গাইডলাইন করতে হবে।”
তখন বিচারক বলেন, “কারা সাংবাদিকতায় আসবে, সেই যোগ্যতা আমরা ঠিক করে দিতে পারি না। তবে গাইডলাইন থাকতে হবে।”
রোকন উদ্দিন মাহমুদ বলেন, “না, সেটা না। তবে এটা তাদের (সাংবাদিকদের) বুঝতে হবে, যারা কোর্ট রিপোর্টিং করে তাদের জানতে হবে।”
আদালত এর সঙ্গে একমত পোষণ করে।
এ সময় আহসানুল করিম বলেন, “সাংবাদিকরাও কিন্তু তাদের জন্য একটা গাইডলাইন চাচ্ছে। আজকের পত্রিকায়ই আছে।”
এরপর বিচারকরা রায়ের জন্য দিন রেখে এজলাস ত্যাগ করেন।
শুনানিতে শাহদীন মালিক
শুনানিতে অংশ নিয়ে প্রথম আলোর সাংবাদিকদের আইনজীবী শাহদীন মালিক দাবি করেন, বর্তমানে আদালত অবমাননার বিষয়ে কোনো আইন নেই। তাই আদালত অবমাননার অভিযোগে শাস্তি দেয়ার বিধান নেই।
এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, আদালত অবমাননা আইন-২০১৩ বাতিল হয়ে গেছে। আর এই আইন আগের আইনকে বাতিল করে হয়েছিল।
“তাই যতক্ষণ সংসদ পুনরুজ্জীবিত না করবে ততক্ষণ এটা পুনরুজ্জীবিত হবে না।”
তখন উচ্চ আদালতের একটি রায়ের উদ্বৃতি দিয়ে বিচারক বলেন, “বাতিল হয়ে যাওয়া বা অবৈধ হয়ে যাওয়া কোনো আইন বৈধ কোনো আইনকে বাতিল করতে পারে না। সেই রায় থেকে আমরা এটাই বুঝি।”
এরপরেও এ বিষয়ে যুক্তি পাল্টা যুক্তিতে শুনানি এগিয়ে চলে।
দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত দুটি লেখা নিয়ে গত ২ মার্চ পত্রিকাটির যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খানকে তলব করে হাই কোর্টের এই বেঞ্চ। পাশাপাশি দুটি রুল জারি করে আদালত, যার একটিতে কেবল মিজানুর এবং অপরটিতে মিজানুরের সঙ্গে প্রথম আলো সম্পাদককেও বিবাদি করা হয়।
গত ৬, ৯ ও ১০ মার্চ মিজানুরের উপস্থিতিতে এ বিষয়ে শুনানি হয়। হলফনামার বিষয়ে নিশ্চিত হতে আদালত প্রথম আলো সম্পাদকের বক্তব্য শুনতে চাইলে মঙ্গলবার তিনি হাজির হন।