রাজধানীর বেশ কাছে থেকেও কোনো দিন ঢাকা আসা হয়নি কিশোর মনিরের। বড় বড় দালান-কোঠা আর আলো ঝলমলে সেই শহর দেখা হলেও আর বাড়িতে ফেরা হল না তার। হরতালের আগুনে শরীরের ৯৫ ভাগ পুড়ে যাওয়া এই কিশোর চলে গেলেন আর না ফেরার জগতে।
Published : 07 Nov 2013, 11:18 AM
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার ভোর পৌনে ৫টার দিকে মৃত্যু হয় মনির হোসেনের(১৪)।
গাজীপুরের কালিয়াকৈর বড় কাঞ্চনপুরের কভার্ড ভ্যানচালক রমজান আলীর ছেলে মনির স্থানীয় একটি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।
দগ্ধ শরীরে হাসপাতালের শয্যায় কাতরাতে কাতরাতে ফের বাবার কাছে বায়না ধরেছিল, “বাবা, আমি বাড়ি যামু।”
এই আকুতি জানানোর মাত্র কয়েক ঘণ্টার মাথায় কাঞ্চনপুরের উদ্দেশে রওনা হন রমজান আলী। তবে এবার কভার্ড ভ্যানের সামনে নিজের আসনের পাশে বসিয়ে নয়, ছেলের শবযাত্রায় তিনি।
মনিরের মৃত্যুর আগে ও পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে একাধিকবার কথা হয় রমজান আলীর।
টাঙ্গাইল ট্রান্সপোর্টের একটি কভার্ড ভ্যানের চালক রমজান জানান, ছেলের বায়না মেটাতে বিরোধী দলের ৬০ ঘণ্টার হরতাল শুরুর আগের দিন রোববার সকালে তাকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় রওনা হন।
“কোনোদিন ঢাকায় আসেনি। তাই কভার্ড ভ্যানের সামনে আমার পাশে বসিয়ে মনিরকে ঢাকায় নিয়ে আসলাম। রোববার সারা দিন আমার সঙ্গে ছিল। সোমবার ভোরে সোয়ারি ঘাট থেকে ভ্যানে মাল উঠালাম। মনির কভার্ড ভ্যানেই ঘুমিয়ে ছিল।”
সকাল পৌনে ১০টার দিকে গাজীপুর চৌরাস্তায় একটি দোকানে গাড়ি থেকে মাল নামিয়ে দেয়া হয়।
ছেলেকে গাড়িতে ঘুমোতে বলে রাস্তার অবস্থা বোঝার জন্য সামনে এগোন রমজান।
“একটু দূরে যেতেই পিছনে তাকিয়ে দেখি আমার গাড়িটি দাউ দাউ করে জ্বলছে। দৌড়ে কাছে গিয়ে দেখি- আমার সুন্দর ছেলেটার সারা দেহ পুড়ে গেছে,” কাঁদতে কাঁদতে বর্ণনা দিয়ে চলে রমজান আলী।
পরে পুলিশের সহায়তায় অ্যাম্বুলেন্সে করে মনিরকে ঢাকায় আনা হয়।
বুধবার রাত সোয়া ৯টার দিকে হাসপাতালে গিয়ে শয্যার পাশে বসে ছেলের দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায় বাবাকে।
এ সময় ছেলে বাড়ি যেতে চাইছিল। অসহায় বাবা আর টিকতে না পেরে চলে যান হাসপাতালের বারান্দায়। সেখানে দাড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে দেখা যায় তাকে।
“আমার ছেলে বাড়ি যেতে চায়। তাকে কি জীবিত বাড়ি নিতে পারব,” প্রশ্ন করেছিলেন রমজান আলী।
এর আট ঘণ্টার মাথায় প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যান তিনি। বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার দিকে দেখা যায়, সেই আইসিইউর বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছেন রমজান।
চিৎকার করে বলছেন, “রাতে ছেলেটা বাড়ি যেতে চাচ্ছিল। আর ভোরে মারা গেল। আমি মনুর (মনিরের মা মনোয়ারা বেগম) কাছে কী জবাব দিমু।”
“ছেলেকে ঢাকায় এনে মেরে ফেললাম আমি। স্যার, আমিই আমার ছেলেকে পুড়িয়ে মেরেছি। আমাকে গ্রেপ্তার করুন,” বিলাপ করতে থাকেন সন্তানহারা এই ব্যক্তি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “ভাই, খবর পেয়ে মনিরের মা হরতালের মধ্যেই মঙ্গলবার অ্যাম্বুলেন্সে করে মনিরকে দেখতে এসেছিল। কিন্তু ছেলের দগ্ধ শরীর দেখে বার বার মূর্ছা যায়। তাই তাকে ওই দিনই বাড়িতে পাঠিয়ে দিই।
“এখন লাশ দেখে তো মনু মারা যাবে। সন্তান হারানোর যন্ত্রণা সইতে পারবে না ও।”
হরতালকারীদের আগুনে দগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মনিরের আগে মৃত্যু হয় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান মুকুলের।
হরতালের আগের দিন সাভারে অটোরিকশায় ছোড়া পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। পরদিন তার মৃত্যু হয়।
‘ঢাকা আর আমু না’
মায়ের নিষেধ সত্ত্বেও দাদি রহিমা খাতুনের সঙ্গে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছিল শিশু সুমি।
নেত্রকোনার দুর্গাপুরের ঘণ্ডবেগের আট বছরের এই শিশুর কখনো ঢাকায় আসেনি। তাই আবদার মেটাতে হরতালের আগের দিন রোববার নাতিকে সঙ্গে করেই মেয়ের বাসার উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠেন রহিমা।
সন্ধ্যায় গাজীপুরে পৌঁছালে হরতাল সমর্থকদের আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলে তাদের বাস। অন্যরা বেরোতে পারলেও রেহাই মেলেনি দাদি-নাতনীর।
“বাসের পিছনের দিকে বসেছিল দুজন। তাই আগুন দেয়ার পর নামতে গিয়ে দুজনই আগুনে পুড়ে যায়,” বলেন সুমির মা রুবিনা।
বৃহস্পতিবার যখন সুমির মার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয় তখনই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে সুমি বলে উঠে, “আমি আর ঢাকায় আমু না, মা।”
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের টানা ৬০ ঘণ্টার হরতালে গত তিন দিনে আগুন ও পেট্রোলবোমায় দগ্ধ অন্তত ১৫ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
হিউম্যান হলার চালক আল আমিন, অটোরিকশা চালক আসাদ গাজী, পোশাক শ্রমিক নাসিমা আক্তার, কভার্ড ভ্যান চালক রোকনুজ্জামান, আটোরিকশার যাত্রী হাসু মিয়া, রহিমা ও সুমি রয়েছেন তাদের মধ্যে।
বুধবার তাদের হাসপাতালে দেখতে এসে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজির আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, “স্বাধীনতার ৪০ বছর পর গরীব, হত-দরিদ্র, দিনমজুরদের জীবনে এমন করুণ দৃশ্য দেখতে হবে তা ভাবতে পারি না।
“স্বাধীনতার ৪০ বছর পর এমন দৃশ্যের কথা ভাবা যায় না।”