হরতালের আগুনে বাবাকে হারাল মাহি-মৌসুমী

“আমার স্বামী কোনো রাজনীতি করত না, সাধারণ মানুষ ছিল, আর সেজন্যই তাকে জীবন দিতে হল,সাধারণ মানুষের জীবনের কোনো দাম নাই,” সংঘাতময় রাজনীতির প্রতি ঘৃণার প্রকাশ ঘটালেন বীণা বেগম।

গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Nov 2013, 07:17 PM
Updated : 4 Nov 2013, 07:17 PM

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় সোমবার সকালে দুই শিশুকন্যাকে নিয়ে আহাজারি করছিলেন ৩৫ বছর বয়সি এই নারী। সামনে ছিল স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান মুকুলের লাশ।

বিরোধী দলের হরতালের আগের দিন রোববার সাভারে একটি অটোরিকশা পুড়িয়ে দেয়া হলে অগ্নিদগ্ধ হন মুকুল (৪০)। একদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে মারা যান তিনি।

মুকুলের মতোই হরতালের আগুনে দেহের ৯০ শতাংশজুড়ে ক্ষত নিয়ে হাসপাতালের শয্যায় যন্ত্রণায় ছটফট করছেন কিশোর মনির হোসেন। তার মতো অগ্নিদগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন আরো ছয়জন।

বিরোধী দলের ৬০ ঘণ্টার হরতালের প্রথম দিন সোমবার পার হয়েছে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, গাড়ি পোড়ানো, আর বোমাবাজির মধ্য দিয়ে।

এর মধ্যে নাটোরে হরতালকারীদের ইটে নিহত হয়েছেন একজন। লালমনিরহাটে হরতালের পক্ষে-বিপক্ষের কর্মীদের সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন বিরোধী দলের একজন।

হরতাল শুরুর আগের দিনই ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গাড়ি পোড়ানো শুরু হয়। এর মধ্যেই ঢাকা থেকে নবীনগর ফেরার পথে সাভারে পেট্রোল বোমার শিকার হন মুকুল।

স্ত্রী বীণা এবং দুই শিশুকন্যা মাহি ও মৌসুমীকে নিয়ে নবীনগরের একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর গ্রামের মুকুল। চাকরি করতেন বিশ্বাস গ্রুপে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সোমবার হরতাল সহিংসতায় নিহত মোস্তাফিজুর রহমান মুকুলের স্ত্রীর আহাজারি। হরতালের আগের রাতে সাভারে অটোরিকশায় ছোড়া পেট্রোল বোমায় আহত হয়েছিলেন তিনি। ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

“হরতাল আমার অবুঝ মাইয়া দুইটার থেইক্যা ওগো বাবারে কাইরা নিল। সে আর কোনো দিন চোখ মেলবে না। আমাগো লগে কথা বলবে না,” মেয়েদের নিয়ে হাহাকার করেন বীণা।

মুকুলের সহকর্মী আবু ইউসুফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রোববার সকালে সাড়ে ১০টার দিকে তারা তিন সহকর্মী অফিসের জরুরি কিছু ইলেকট্রনিক সামগ্রী ‍কিনতে ঢাকার ধোলাই খালে যান।

কেনাকাটা শেষ করে বাড়ি ফিরছিলেন তারা। নবীনগর যেতে ১২০০ টাকায় একটি সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করেন।

আবু ইউসুফের বাসা মিরপুরে হওয়ায় তিনি টেকনিক্যাল মোড়ে নেমে যান।

এরপর সাভারে হরতাল সমর্থকদের ছোড়া পেট্রোল বোমায় সিএনজিচালকসহ তিন আরোহী দগ্ধ হন। আহত বিশ্বাস গ্রুপের অপর কর্মকর্তা মো: হাসু (৩৮) ও সিএনজিচালক আসাদ গাজী বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

কিশোর মনির হরতালের আগুনের শিকার হন সোমবার সকালে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তায়।  তার বাবার চোখের সামনেই অগ্নিদগ্ধ হয় সে।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গাজীপুরে চান্দনা চৌরাস্তার পূর্ব পাশে জাতীয় আইন কলেজের সামনে একটি কভার্ড ভ্যানে আগুন দেয় হরতালকারীরা।

জয়দেবপুর থানার পরিদর্শক জাহিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান,ভ্যানটি ছিল রমজান আলীর (৫০)। আর ওই ভ্যানেই ছিল তার ১৫ বছর বয়সি ছেলে মনির। 

রমজান আলীর বাড়ি গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার বড়কাঞ্চনপুর গ্রামে। সেখানে মা আর ছোটভাই সহ মনির থাকত। পেশাগত কারণে  গাজীপুর শহরে থাকা রমজানের কাছে দুদিন আগে বেড়াতে এসেছিল ছেলে।

রমজান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হরতালে গাড়ি বের করবেন কি না, তা দেখার সকাল ১০টার দিকে তিনি ছেলেকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে চান্দনা চৌরাস্তায় এসেছিলেন।

“চৌরাস্তার পূর্বপাশে গাড়িটা রেখে আমি একটু বের হয়েছিলাম, মনির গাড়িতে ছিল। দূর থেকে হঠাৎ দেখলাম, ৪-৫ জন যুবক আমার গাড়ির কাছে এসে কিছু পাউডার ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিল।”

এর সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে আগুন ধরে যায়। ছুটে এসে অগ্নিদগ্ধ ছেলেকে গাড়ির ভেতর থেকে বের করে আনেন রমজান। তবে ততক্ষণে ছেলে গায়েও আগুন ধরে যায়।

“পোলাটা আমার চোখের সামনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল,” আহাজারি করেন রমজান।

বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক পার্থ শংকর পাল জানান, মুনীরের শরীরের ৯৫ ভাগই আগুনে পুড়ে গিয়েছে। তার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন।

বার্ণ ইউনিটের পর‌্যবেক্ষণ কক্ষে ডান হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে যন্ত্রনায় ছটফট করছিল আট বছরের সুমি। তার পাশের শয্যায় হাত আর মুখ আগুনে ঝলসানো অবস্থায় কাতরাচ্ছিলেন দাদি রহিমা বেগম (৫০)।

হরতালের আগের দিন রোববার সন্ধ্যায় গাজীপুরে একটি বাসে আগুন দেয়া হলে অগ্নিদগ্ধ হন এর আরোহী রহিমা ও সুমি।

নেত্রকোনার দুর্গাপুরে তাদের বাড়ি, যাচ্ছিলেন ঢাকায়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সুমি। হরতালের আগের রাতে গাজীপুরে বাসে দেয়া আগুনে দগ্ধ হয়েছিল সে। ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

অগ্নিদগ্ধ রহিমা জানান, দুর্গাপুর থেকে ঢাকার উত্তরায় যাওয়ার পথে চৌরাস্তা বাইপাস মোড়ে  দুর্বৃত্তরা তাদের বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়।

তার স্বজন কামাল হোসেন বলেন, “দেশে হরতাল প্রতিরোধে একটা আইন দরকার। যারা হরতালে মানুষকে আগুন দিয়ে মারতে চাইবে, তাদের কঠোর শাস্তির কথা বলা থাকবে ওই আইনে।”

হরতালে কারণে অগ্নিদগ্ধ সুমির বাবা-মা ঢাকায় আসতে পারছেন না বলেও জানান তিনি।

হরতালের আগের দিন ও হরতালের দিন পেট্রোল বোমার আঘাতে সব মিলিয়ে সাতজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে দেখা যায়।

ধাওয়ায় গাড়ি উল্টে নিহত ১

নাটোরের গুরুদাসপুরে হরতাল সমর্থকদের হামলায় এক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। নিহত ইসাহাক মোল্লা (৪২) সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার বায়েজ উদ্দিন মণ্ডলের ছেলে।

গুরুদাসপুর থানার ওসি শফিকুল ইসলাম জানান, সকাল পৌনে ৬টার দিকে প্রায় ৫০ জন কৃষি শ্রমিককে নিয়ে একটি মিনিট্রাক সিরাজগঞ্জ থেকে নাটোরের দিকে যাচ্ছিল। নয়াবাজার এলাকায় হরতাল সমর্থকরা ঢিল ছুড়ে ট্রাক থামানোর চেষ্টা করে।

এ সময় ইটের আঘাতে ইসাহাক মোল্লা গুরুতর আহত হন।

এরপর ট্রাকচালক দ্রুত ওই এলাকা ত্যাগ করেন এবং আঁড়মারি এলাকায় গিয়ে ট্রাক থামান। এ সময় হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে আহত হন আরো কয়েকজন।

গুরুতর আহত ইসাহাককে ভ্যানে করে গুরুদাসপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে সকাল সাড়ে ৭টায় দিকে সেখানেই তার মৃত্যু হয়।

লালমনিরহাটে সংঘর্ষে নিহত ১

হরতালের মধ্যে লালমনিরহাটের পাটগ্রামে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন নিহত হয়েছেন।

নিহত নাসির হোসেন (২২) উপজেলার সোহাগপুর এলাকার মিন্টু মিয়ার ছেলে। তিনি ছাত্রদলের একজন কর্মী ছিলেন বলে বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন।  

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল সাড়ে ৮টার দিকে পাটগ্রাম উপজেলার সোহাগপুরে এই সংঘর্ষের ঘটনায় কয়েকজন পুলিশসহ অন্তত ২৫ জন আহত হন।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও গুলি ছুড়তে বাধ্য হয় বলে পাটগ্রাম থানার ওসি সোহরাব হোসেন জানান। সংঘর্ষের মধ্যে গুলিবিদ্ধ  নাসিরকে হাসপাতালে নেয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়।

স্থানীয়রা জানান, উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা সকালে মিছিল করার জন্য ধরলা সেতুর সোহাগপুর প্রান্তে মিলিত হলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা উল্টো দিকের পুর্ব বাজার এলাকায় অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয় এবং সংঘর্ষে বেঁধে যায়।

পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে তাদের দিকেও ঢিল ছোড়া হয়। এতে এসআই রমজানসহ অন্তত ১০ পুলিশ সদস্য আহত হন বলে জানান ওসি।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেন গাজীপুর প্রতিনিধি আবুল হোসেন, নাটোর প্রতিনিধি, লালমনিরহাট প্রতিনিধি আনিসুর রহমান)