একাত্তরে কুষ্টিয়ার তিনটি স্থানে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান। দুইটি স্থানে আগে থেকেই ছিল, আর ২৫ মার্চ নতুন করে জড়ো করা হয় আরো ২০০ সেনা।
Published : 13 Dec 2017, 04:21 PM
কিন্তু ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের বাঙালি সেনাদের সঙ্গে হাজারো জনতার সম্মিলিত আক্রমণে টিকতে পারেনি ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনী। বাঙালি সেনারা থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল আর সাধারণ মানুষ লাঠি, দা-বটি নিয়ে মাত্র দুদিনেই শত্রুমুক্ত করে কুষ্টিয়া।
৩০ ও ৩১ মার্চের সেই যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় মুক্ত হয় কুষ্টিয়া, পথ তৈরি হয় ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের।
বিজয়ের ৪৬তম বার্ষিকীতে কুষ্টিয়া যুদ্ধের আদ্যোপান্ত শুনিয়েছেন সেই যুদ্ধে সামরিক বাহিনীর প্রধান আবু ওসমান চৌধুরী।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী চুয়াডাঙ্গায় ইপিআরের চার নম্বর উইংয়ের অধিনায়ক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে আট নম্বর সেক্টরের এই কমান্ডার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান লেফটেন্যান্ট কর্নেল হয়ে।
বর্তমানে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের ভাইস চেয়ারম্যান আবু ওসমান চৌধুরী ২০১৪ সালে পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক।
কুষ্টিয়া যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভোর ৪টায় অতর্কিত আক্রমণ করি আমরা। পরিকল্পনা করা হয় সারপ্রাইজ অ্যাটাক হবে। কারণ সারপ্রাইজ অ্যাটাক ইজ হাফ দ্য ব্যাটল ওয়ান।
“তিন কোম্পানি সৈন্য এবং হাজার হাজার মানুষ ছিল। আমরা তাদেরকে (পাকিস্তানি বাহিনী) গিয়ে ঘুমেই পেয়েছি। কাজেই তারা কিছুই করতে পারে নাই। যদি তারা জানত, তাহলে তাদের কাছে যে অস্ত্রশস্ত্র ছিল সেগুলো যদি লে-আউট করা থাকত এবং রেডি থাকত তাহলে সব কিছু উড়াই দিতে পারত।”
বঙ্গবন্ধুর আহ্বান ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকবে’ সেই যুদ্ধে কাজে লেগেছিল উল্লেখ করে সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান বলেন, “কেউ দা-বটি নিয়ে এসছে, কেউ লাঠি নিয়ে এসছে। যার কাছে যা ছিল তা নিয়ে আসছে।”
একাত্তরের সম্মুখ সমরে: কামালপুরের পথ ধরে এগিয়েছিল বিজয়রথ একাত্তরের সম্মুখ সমরে: মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণ শুরু চট্টগ্রামে একাত্তরের সম্মুখ সমরে: পথ দেখালো জয়দেবপুর |
‘লো-এস্টিমেশনও’ পাকিস্তানিদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তারা ভেবেছে থ্রি-নট-থ্রি ওয়ালা ইপিআর আমাদের কিছু করতে পারবে না। কিন্তু সেটা পেরেছি আমরা জনগণকে সাথে নিয়ে।”
২৫ মার্চে মেজর শোয়েবের নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বালুচ রেজিমেন্টের ২০০ সৈন্য কুষ্টিয়ায় অবস্থান নেওয়ায় সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এলাকার মানুষ, কেউ কেউ এলাকাও ছাড়তে থাকে।
সেখানে গিয়ে এলাকায় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠকে কুষ্টিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়; দিনক্ষণ ঠিক হয়ে চলে সেনাবাহিনীর বাইরে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহের কাজও।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোকাবেলা করার শপথ নিয়ে গঠন করা হয় উপদেষ্টা পরিষদ, আওয়ামী লীগ নেতা আসহাবুল হককে করা হয় বেসামরিক প্রশাসনের প্রধান আর আবু ওসমান চৌধুরীকে সামরিক বাহিনীর প্রধান।
৩০ মার্চ ভোরে তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে কুষ্টিয়া আক্রমণ করেন প্রতিরোধ যোদ্ধারা। সুবেদার আবদুল মতিন পাটোয়ারির নেতৃত্বে পুলিশ লাইনের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের মহাজনপুরে একটি বাড়ির তিনতলা থেকে পুলিশ লাইনে অবস্থান করা পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালায় একটি দল।
আযম চৌধুরীর নেতৃত্বে দ্বিতীয় দল কুষ্টিয়া জিলা স্কুলে অবস্থিত পাকিস্তানি সেনা এবং নায়েব সুবেদার মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে তৃতীয় দলটি মোহিনী মিলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওয়্যারলেস টিমের ওপর আক্রমণ চালায়।
আক্রমণের বর্ণনা দিয়ে আবু ওসমান চৌধুরী বলেন, “আমরা এভাবে চারটার আগে ওখানে পৌঁছে গেছি, আস্তে আস্তে এবং চারটার সময় ওপেনিং করলাম, দৌড় দিলাম একসাথে। তিন জায়গার তিন কোম্পানি সৈন্য এবং হাজার লোক, তারা সকলে একত্রে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিলে কেঁপে উঠে সবকিছু।”
এ অবস্থায় জীবিত পাকিস্তানি সেনারা পুলিশ লাইন ও ওয়্যারলেস স্টেশন ছেড়ে জিলা স্কুলে একত্র হওয়ার চেষ্টা করে। পালানোর পথেও বহু সেনা নিহত হয়। ওইদিন জিলা স্কুল ছাড়া পাকিস্তানিদের সব অবস্থান প্রতিরোধ যোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
৩১ মার্চ ভোরে আবার কুষ্টিয়া জিলা স্কুলে অবস্থান করা পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়; কিন্তু পাকিস্তানিদের ভারী অস্ত্রের গোলা বর্ষণে তাদের ধ্বংস করতে পারেনি।
দিনের যুদ্ধ শেষে বেঁচে থাকা অর্ধশতাধিক পাকিস্তানি সেনা ওই রাতে দুটি জিপ ও দুটি ডজ গাড়িতে করে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও পড়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশে।
আবু ওসমান চৌধুরী বলেন, “তারা পালানোর চেষ্টা করে পারেনি। আমরা রাস্তা কেটে রেখেছিলাম। রাতের বেলা যেন বুঝতে না পারে সেজন্য তারপলিন দিয়ে রেখেছিলাম কাটা জায়গার উপর। তারা গিয়ে পড়ল ওটার উপর।”
পাকিস্তানি সেনাদের দুটি গাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকুপায় এলাকায় ওই ব্রিজের গোড়ায় পড়ে গেলে সেখানে প্রস্তুত প্রতিরোধ যোদ্ধারা তাদের ঘায়েল করেন।
মেজর শোয়েবসহ বেশিরভাগ পাকিস্তানি সেনা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। কয়েকজনকে আহত অবস্থায় ধরে গ্রামবাসীরা।
আবু ওসমান চৌধুরী বলেন, “এখানে তারা সুপার পাওয়ার হয়েও কিন্তু নরমাল পাওয়ারকে কিছু করতে পারে নাই। কুষ্টিয়াই একমাত্র জেলা যেটা শত্রুমুক্ত হয়েছে যুদ্ধের প্রথম এক সপ্তাহের মধ্যেই। এর ধারাবাহিকতায় আমরা মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণের জন্য মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলতে এবং সেই এলাকা প্রস্তুত করতে পেরেছিলাম।”