একাত্তরের সম্মুখ সমরে: মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণ শুরু চট্টগ্রামে

পাকিস্তানিদের শোষণ-নিপীড়নের অবসান চাওয়ায় একাত্তরের ২৫ মার্চ বাঙালির উপর খড়গ হয়ে নেমে এসেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’।

মাসুম বিল্লাহ কাজী নাফিয়া রহমান ও সাজিয়া আফরিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Dec 2017, 07:34 AM
Updated : 11 Dec 2017, 01:18 PM

ঢাকাসহ প্রায় সারা দেশে নিরস্ত্র বাঙালিরা এই আক্রমণের অসহায় শিকার হলেও চট্টগ্রামের চিত্র ছিল অনেকটা ভিন্ন।

অস্ত্র-জনবল-সামর্থ্য সীমিত হলেও ‘অপারেশন সার্চলাইট’র প্রথম সপ্তাহে বিদ্রোহী বাঙালি সেনারা একটি নিয়মিত সেনাবাহিনীর মতো দক্ষতায় চট্টগ্রাম নগরে গড়ে তুলেছিলের কার্যকর প্রতিরোধ।

যুদ্ধদিনের সেই গল্প শুনিয়েছেন সেই প্রতিরোধ যুদ্ধের নায়ক, ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম।

স্বাধীনতা যুদ্ধে ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ চট্টগ্রাম শহর এবং এর আশেপাশের এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের এই প্রতিরোধ যুদ্ধ কাকতালীয়ভাবে আসেনি। ২৫ মার্চের আগে থেকেই বাঙালির উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হামলার পরিকল্পনা আঁচ করতে পারছিলেন সেনাবাহিনীতে থাকা বাঙালিরা।

চট্টগ্রাম এলাকায় থাকা বাঙালিরা তখনই হিসেব শুরু করেন, চূড়ান্ত লড়াই শুরু হলে কে কার পক্ষে থাকবে, শহর থাকবে কার দখলে, কীভাবে কাবু করতে হবে পাকিস্তানের সৈন্যদের। এমনকি চট্টগ্রাম শহরকে দখলে রাখতে সেখানে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যদের নিরস্ত্র করার ছকও কষতে থাকেন তারা।

চট্টগ্রামে যুদ্ধ পরিচালনাকারী রফিকুল ইসলাম মনে করেন, চূড়ান্ত যুদ্ধের আগেই ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) অবাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে না পারলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস ভিন্নও হতে পারত।

স্বাধীনতার ৪৬তম বার্ষিকীতে এক সাক্ষাৎকারে চট্টগ্রামে সীমান্ত ফাঁড়িগুলো ধ্বংস করা ও শহর দখলে রাখার অভিযানের বিস্তারিত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে তুলে ধরেন মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সেনানী।

১৯৭১ সালে রফিকুল ইসলাম চট্টগ্রামে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) হেডকোয়ার্টারে অ্যাডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেনের দায়িত্বে ছিলেন। যুদ্ধকালে চট্টগ্রাম শহর ছাড়াও সীমান্তবর্তী এলাকায় বিচক্ষণতার সাথে লড়াই পরিচালনা করেছেন তিনি, পরে ভূষিত হয়েছেন বীর উত্তম খেতাবে। মেজর হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া রফিকুল ইসলাম পরে রাজনীতিতে আসেন। দায়িত্ব পালন করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবেও; এখনও সংসদ সদস্য তিনি।

রফিকুল ইসলাম জানান, অবাঙালি সৈন্যদের উপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা তিনি নিজেই করেছিলেন। ইপিআরে ১১০০-১২০০ বাঙালি সৈন্যের বিপরীতে চার-পাঁচশো অবাঙালি সৈন্য থাকায় তাদের আক্রমণ করে বন্দি করাটা সহজ হবে বলে মনে করেছিলেন তিনি।

“শত্রুপক্ষ বোঝার আগেই তাদের ওপর আক্রমণ করে ফেলা ছিল সেই যুদ্ধের অন্যতম কৌশল।”

তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, অতর্কিতে তাদের উপর আক্রমণ করে পুরো চট্টগ্রাম শহরটাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলবেন। এটা করার পর বাঙালি সৈন্যরা সীমান্ত এলাকায় সীমান্ত ফাঁড়িগুলো দখল করে ফেলবে আর পাকিস্তানিদের ধ্বংস করে তার নির্দেশনা অনুযায়ী শহরে চলে আসবে।

ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর হয়ে বা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা চট্টগ্রাম শহরের দিকে আসবে- এমন ধারণা থেকে পাল্টা ব্যবস্থাও নিযেছিল মুক্তিযোদ্ধারা। শহরে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে তাই নেওয়া হয় রাস্তায় কী ধরনের অস্ত্র বসালে পাকিস্তানি সৈন্যরা আসতে পারবে না, সেই পরিকল্পনা।

“কোন কোন পাহাড়ে কী ধরনের অস্ত্র নিয়ে কতজন সৈন্য থাকবে, আগ্রাবাদ শহরের কোন জায়গায় সৈন্যরা বসবে, কী ধরনের অস্ত্র নিয়ে, কোন কোন বিল্ডিংয়ে বসবে সেই পরিকল্পনা করলাম। হালিশহরের পেরিমিটার ডিফারেন্স যেটা, সমস্ত কিছুর আমি একটা গোপন ছক করলাম। খুব সিম্পল, যাতে মনে রাখা সহজ হয়,” বলেন বীর উত্তম রফিকুল।

তখন বাঙালিরা ধেয়ে আসা একটি ব্যাপক বিধ্বংসী গণহত্যার আলামত স্পষ্টভাবেই দেখতে পারছিলেন, যা সামাল দিতে মার্চের প্রথম সপ্তাহে বৈঠকও করে তারা।

রফিকুল ইসলামের ভাষায়, “তাদেরকে আর বেশি কিছু বললাম না, শুধু বললাম আমি একটা গোপন সাংকেতিক বার্তার মাধ্যমে তোমাদেরকে নির্দেশ দেব, সেই নির্দেশ অনুযায়ী তোমরা যুদ্ধ শুরু করবে, সীমান্তেও যুদ্ধ শুরু হবে।”

তিনি জানান, ২৪ মার্চে তার অধীনস্ত একটি ফিল্ড সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স ইউনিট পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ বলে খবর দেয়। তখনি তিনি বুঝতে পারেন, গণহত্যা শুরু হতে যাচ্ছে।

“আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, যুদ্ধ আমাকে আজকেই শুরু করতে হবে।”

পরে ২৪ মার্চই যুদ্ধ শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়ে রেলওয়ে হিলে এক আত্নীয়ের বাসায় যান রফিকুল ইসলাম, যুদ্ধ হলে এই স্থানটিকে নিজের হেড কোয়ার্টার করার পরিকল্পনাও নেন তিনি।

কৌশলগত কারণে নিতে হয় দুটি ‘কোড ম্যাসেজ’। যার একটি একটা ছিল- ‘অ্যারেঞ্জ সাম উড ফর মি’ এবং  অন্যটি হচ্ছে, ‘ব্রিং সাম উড ফর মি’।

 

রফিকুল ইসলাম বলেন, “প্রথম কোড মেসেজটার অর্থ ছিল, আধা ঘণ্টার মধ্যে আমাদের যুদ্ধ শুরু করতে হবে। দ্বিতীয়টির অর্থ ছিল, যুদ্ধ শুরু কর, পশ্চিমাদের ধ্বংস কর, করে অস্ত্র গোলা বারুদ নিয়ে শহরের দিকে আস, এসে তোমার জন্য পূর্বনির্ধারিত স্থানে অবস্থান কর।”

পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৪ মার্চই পাকিস্তানি সৈন্যদের ধ্বংস করে সীমান্তের সব ফাঁড়ি দখল করে নেয় রফিকুল ইসলামের অনুসারীরা।

এই যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে এম আর চৌধুরী এবং জিয়াউর রহমানের রহমানের সঙ্গেও আলাপ হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি তাদেরকেও যুদ্ধ শুরুর আহ্বান জানাই। তারা রাজি হলেন না। তারা বললেন, ‘এখনও তো ইয়াহিয়ার সাথে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা চলছে, এখনই আমরা যুদ্ধ শুরু করা বিরাট ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হবে’।”

তখন দোটানায় পড়ে গেলেন রফিকুল। দল ভারী করতে তিনি ততক্ষণে জিয়াউর রহমান ও এম আর চৌধুরীকে পরিকল্পনার কথা জানিয়ে ফেলেছেন। অন্যদিকে যুদ্ধও শুরু হয়ে গেছে, হয়েছে প্রাণক্ষয়ও।

“এখন যুদ্ধ বন্ধ করলেও এ খবর চলে যাবে শাসকগোষ্ঠীর কাছে। তখন বিদ্রোহী সৈন্যদের কোর্ট মার্শাল করে ফায়ারিং স্কোয়াডে নেওয়া হবে। এই দোটানায় যুদ্ধ স্থগিত করার মধ্যেই রাজধানীসহ সারা দেশে পাকিস্তানিদের তাণ্ডব শুরু হয়ে যায়।”

এতে কেটে যায় রফিকুলদের সব দ্বিধা। পরিকল্পনা অনুসারে তিনি এবার চট্টগ্রাম শহর দখলে নিতে সৈন্যদের নির্দেশ দেন তিনি।

হালিশহরের পুরো ডিফেন্স, ওয়ারলেস, যানবাহন, অস্ত্রাগার নিয়ন্ত্রণে নেন বাঙালি সৈন্যরা। সবকিছু ছিল বাঙালিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কৌশলে বাঙালিদের বিভিন্ন ডিউটিতে রাখায় সুবিধা হয়েছিল বলেও জানান রফিকুল।

২৫ মার্চ রাত ৮টা ৪০ মিনিটে পুরো শহর দখলের যুদ্ধে নেমে পড়েন রফিকুল ইসলাম ও তার বাহিনী। পথে ওয়্যারলেস কলোনির একটি প্যাট্রোনের কমান্ডার ক্যাপ্টেন হায়াতকে তিনি নিরস্ত্র করে বন্দি করেন এবং টেলিফোন লাইন কেটে সৈনিকদের নিয়ে চলে আসেন এই মুক্তিযোদ্ধা।

“সব বাঙালি সৈন্যদের বললাম, তোমরা রেলওয়ে হিলে আমার হেডকোয়ার্টার দখলে রাখ গিয়ে, যেন অন্য কিছু না ঘটে সেখানে। সেখান থেকে আসলাম পাহাড়তলির এক হাই স্কুলে। সেখান থেকে একটা প্লাটুনকে বললাম, বাটালিতে যেতে। এই দুই পাহাড়ে অবস্থান নিলে শহরের দিকে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না এবং ক্যান্টমেন্ট থেকে কেউ চলাফেরা করতে পারবে না।”

এরপর বাহিনী নিয়ে হালিশহরে আসেন রফিকুল ইসলাম।

“এখানে এসে সিনিয়র পশ্চিমা সৈন্যদের বন্দি করে একটা ঘরে আটকে রাখা হল মুখ বন্ধ করে। তারপর বাকি কাজগুলো সুবেদার জয়নাল ও অন্যদের হাতে দিয়ে আমি চলে আসলাম আমার হেডকোয়ার্টারে। রাত ১১টার মধ্যে শহর দখল, সাড়ে ১১টার মধ্যে আমি আমার রেলওয়ের হেডকোয়ার্টারে আসলাম।”

ঝুঁকিপূর্ণ হলেও আগেভাগেই যুদ্ধ শুরু করে দেওয়ার এই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল বলেই মনে করেন ১ নম্বর সেক্টরের এই কমান্ডার।

তিনি বলেন, “আমি যদি যুদ্ধ না শুরু করতাম, তাহলে পাকিস্তানের ইকবাল শফির বাহিনী তো ঢুকে যেত, ঢুকলে তো আমাদের বাঁচার কোনো পথ ছিল না। কারণ তাদের সৈন্য সংখ্যা আমার চেয়ে ছয় গুণ। তখন আমি কি নিয়ে যুদ্ধ করব, আমার সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। কাজেই আমি মনে করি, আমি সঠিক ছিলাম। এই জায়গাটাকে বিকল্পভাবে চিন্তা করার কোনো অবকাশ নাই।

“এটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, কিন্তু ওয়াইজ ছিল। কারণ আমি জানতাম তারা আক্রমণ করবে। কাজেই আমি জেনে শুনে যদি অপেক্ষা করি যে আমাকে আগে আক্রমণ করবে তারপরে দেখব আমি, সেটা ওয়াইজ না।”

সঠিক সময়ে এমন বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভিন্নও হতে পারতে বলে মনে করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সাবেক এই সভাপতি।

“২৪ এবং ২৫ মার্চ চট্টগ্রামে যদি আমি যুদ্ধ শুরু না করতাম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কী হত, কেউ বলতে পারে না। এটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ত। ফলে আমি মনে করি আমরা সময়োচিত, উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছি। এর বিকল্প আমি কিছু ভাবতেও পারি না, চিন্তাও করতে পারি না।”