একাত্তরের সম্মুখ সমরে: দুরবিন টিলায় ‘মনের যুদ্ধ’

সমর কৌশলের বিচারে একাত্তরে মৌলভীবাজারের বড়লেখায় দুরবিন টিলার যুদ্ধ ছিল এক অসম লড়াই- পাকিস্তানি বাহিনীর দেড়শ সৈনিকের বিপরীতে মাত্র আটজন বাঙালির মরিয়া চেষ্টা। সেই যুদ্ধে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় পরে সিলেট অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত করতে বড় ভূমিকা রাখে।

মাসুম বিল্লাহ কাজী নাফিয়া রহমান ও সাজিয়া আফরিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Dec 2017, 06:59 AM
Updated : 7 Dec 2017, 09:04 AM

১৯৭১ সালের ২০ নভ্ম্বের বড়লেখায় সম্মুখ সমরে অংশ নেওয়া মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীন দ্বিতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর উপ অধিনায়ক কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরের ভাষায়, দুরবিন টিলায় আসলে হয়েছিল মনের যুদ্ধ।

স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের ৪৬তম বার্ষিকী সামনে রেখে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দুরবিন টিলার যুদ্ধের আদ্যোপান্ত তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধের এই বীর প্রতীক।

আজকের ৬৬ বছর বয়সী কাজী সাজ্জাদ আলী জহির তখন কুড়ি বছরের টগবগে তরুণ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারি কোরে কমিশন পাওয়ার পর তার পোস্টিং হয়েছিল শিয়ালকোটে। সেখান থেকে পালিয়ে ভারত হয়ে তিনি চলে আসেন দেশে; সেপ্টেম্বরে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। 

সাজ্জাদ আলী জহিরের পরিচালনায় মুক্তিবাহিনীর দ্বিতীয় গোলন্দাজ ব্যাটারি ৮ নম্বর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নেয়। বিভিন্ন পাহাড়ে বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষা বুহ্য নাড়িয়ে দেয় তারা।

 

মুক্তিযুদ্ধে সেই ভূমিকার জন্য স্বাধীনতার পর তাকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে তিনি অবসরে যান লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে।

দুরবিন টিলা যুদ্ধের সেই স্মৃতি রোমন্থনে এই মুক্তিযোদ্ধা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা ছিল একটি মনের যুদ্ধ। মনের যুদ্ধে আমরা তাদের থেকে অনেক বেশি বলিয়ান ছিলাম। আমার মুক্তিযোদ্ধারা আরো অনেক বেশি সাহসী হয়ে গিয়েছিল।”

মুক্তিযোদ্ধাদের ওই গোলন্দাজ দলটি সেদিন পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের অংশে ঢুকে একটি ছোট পাহাড়ে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানিদের ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। তাতে পাকিস্তানিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদেরও ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। আহতদের বাদ দিয়ে লড়াই চালানোর মত যোদ্ধার সংখ্যা নেমে আসে আটজনে। ততক্ষণে গোলাবারুদের পরিমাণও কমে এসেছে।

এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী ঠিক পিছনে চলে এলে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয় সাজ্জাদ আলী জহিরকে। তার বাহিনী পিছু হটবে? নাকি অবস্থান ধরে রেখে লড়াই চালিয়ে যাবে?

“এই স্থান যদি আমরা ত্যাগ করি, এই স্থানটা পাকিস্তানিরা দখল করলে পেছনে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান খুব দুর্বল হয়ে যাবে, তাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হবে।”

মরণপণ সেই যুদ্ধে স্থান ত্যাগ না করার সিদ্ধান্ত নেন সাজ্জাদ আলী জহিররা। পাকিস্তানিরা পাহাড়ে ওঠার চেষ্টা করলে শুরু হয় তুমুল গোলাবর্ষণ; সেই সঙ্গে গ্রেনেড নিক্ষেপ আর মেশিনগানের গুলি।

তুমুল ওই আক্রমণে বড় ধরনের ক্ষতি মেনে পিছু হটতে হয় হানাদার বাহিনীকে। সাজ্জাদ আলী জহির বলেন, আসলে সেদিন তুমুল গোলাবর্ষণের কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বুঝতে না পেরে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়।

একাত্তরে কাজী সাজ্জাদ আলী জহির। ছবি: বাংলাদেশবিডি ডট অর্গ

যুদ্ধের কৌশলগত দিক দিয়ে দুরবিন টিলার বিজয় ছিল মুক্তিবাহিনীর জন্য বড় সাফল্য। সাজ্জাদ আলী জহিরদের সেই বিজয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য একটি দলও সেদিন পাকিস্তানিদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়।

“আমাদের সামনে বাঁ দিকে অবস্থান নিয়েছিল আট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, তাদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ করেছিল পাকিস্তানিরা, তাদের পেছন থেকে ঘেরাও করে ফেলেছিল। তখন আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তাদের উপর যেন গোলাবর্ষণ করি, যেন তাদেরকে পেছনে হটতে বাধ্য করি।

“আমি নিজেই কামানের উপর হাত দিয়ে গোলা ছুড়ছিলাম। প্রথম গোলাটা পড়ে পাকিস্তানিদের মাথার উপরে। তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল।”

মুক্তিবাহিনীর এরকম এক একটি সাফল্যের ধারাবাহিকতায় আসে চূড়ান্ত বিজয়। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ করে।

পরে দুরবিন টিলা যুদ্ধে পাকিস্তানিদের নেতৃত্ব দেওয়া ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা হয়েছিল সাজ্জাদ আলী জহিরের। পাকিস্তানি ওই সেনা কর্মকর্তা বলেছিলেন, গোলাবর্ষণের ধরন দেখে তাদের মনে হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধারা বোধহয় সংখ্যায় কয়েকশ। এজন্য তারা আর এগোনোর সাহস করেনি।

“আমি তখন বললাম, আমার কাছে মাত্র আটজন ছিল। তোমরাতো নিশ্চই দেড়শ দুইশ ছিলে? সে বলে- ‘হ্যাঁ, ১৪৫ জন ছিলাম আমরা। যদি জানতাম তোমার কাছে আটজন থাকবে, তাহলে নিশ্চই আমরা আবার অগ্রসর হয়ে তোমাদের ধ্বংস করতাম’।”