একাত্তরের সম্মুখ সমরে: পথ দেখালো জয়দেবপুর

তখনও আসেনি ২৫ মার্চের কাল রাত, তবে বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করার সব আয়োজন এগিয়ে নিচ্ছিল পাকিস্তান সরকার। একইসঙ্গে চলছিল সম্ভাব্য প্রতিরোধ এড়াতে বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা।

মাসুম বিল্লাহ কাজী নাফিয়া রহমান ও সাজিয়া আফরিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Dec 2017, 11:15 AM
Updated : 9 Dec 2017, 06:42 AM

পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা তখন পড়েন দোটানার মধ্যে। তখনও তারা বিদ্রোহ করেননি, তাই পাকিস্তানি কমান্ডারদের নির্দেশ সরাসরি অমান্য করা সম্ভব ছিল না। আবার অস্ত্র জমা দিলে ভবিষ্যতে যে কঠিন পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে, তা তারা ঠিকই আঁচ করতে পারছিলেন।

এই পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসে সাধারণ মানুষ। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে পাকিস্তানি প্রচেষ্টা তারা ভণ্ডুল করে দেয়। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ গাজীপুরের জয়দেবপুরের সেই ঘটনা ছিল যুদ্ধ শুরুর আগে সাধারণ মানুষের প্রথম প্রতিরোধ।

তৎকালীন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক কে এম সফিউল্লাহ সে সময় ছিলেন জয়দেবপুর ব্যারাকে। টান টান উত্তেজনার প্রতিটি মুহূর্ত তার কাছে এখনও জীবন্ত।

কত পরিকল্পনা  আর সতর্ক পদক্ষেপে সেদিন কৌশলগত বিজয় এসেছিল- তা তিনি তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৪৬তম বার্ষিকীর আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে।

বাঙালির স্বাধীনতার লড়াইয়ে বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত এই মুক্তি সেনানী এখন সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের চেয়ারম্যান।

বাংলার ইতিহাসে আগুন ঝরা মার্চের সেই সব দিনে সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরাও সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলেন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের দিকে। পূর্ব বাংলায় তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধের মঞ্চ।

 

১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা হলে পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পেতে থাকে। এক পর্যায়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসারদের যোগাযোগ স্থাপিত হয়।

সফিউল্লাহসহ অনেক সেনা সদস্যই সত্তরের সেই নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সফিউল্লাহর দায়িত্ব ছিল জয়দেবপুর, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, রাজেন্দ্রপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুর এলাকায়।

“আমি দেখেছি, ওইখানে মানুষ কত আগ্রহ করে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে। ফলাফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছে আওয়ামী লীগ। ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পেয়েছে।”

কিন্তু বিজয়ী দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে পাকিস্তানিরা, ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনও স্থগিত করা হয়।

সে সময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আটটি ব্যাটালিয়নের পাঁচটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানে।  তারা যাতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে, সেজন্য পাকিস্তানিরা সেনা সদস্যদের বিভিন্ন জায়গায় বদলি করে তাদের মধে বিচ্ছিন্নতা তৈরির চেষ্টা করে।

সফিউল্লাহর সঙ্গে থাকা বাঙালি সেনাদের অল্প কয়েকজনকে জয়দেবপুরে রেখে বাকিদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও রাজেন্দ্রপুরে। তাতেও ভরসা করতে না পেরে এক পর্যায়ে ভাওয়াল রাজবাড়িতে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান সরকার।

সফিউল্লাহ বলেন, মার্চের শুরুতে যখন পার্লামেন্ট স্থগিত করা হল, তখন তিনি টাঙ্গাইলে। তার অধীনস্ত সৈন্যরা সে সময় ‘কিছু করার’ জন্য মুখিয়ে ছিল।

কিন্তু বাঙালি সেনারা কিছু করতে গেলে তা হবে রাষ্ট্রদ্রোহিতা; যার সাজা ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলা বা ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু। তাই কথা বলার সময় ছিল অনেক রাখঢাক, তবে ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ঠিকই চলছিল।

এমন সময় আসে অস্ত্র জমা নেওয়ার নির্দেশ। বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে কালক্ষেপণের কৌশল গ্রহণ করেন। পাকিস্তানিরাও বিষয়টি বুঝে ফেলে।

পরিদর্শনের কথা বলে এক কোম্পানি সেনা নিয়ে ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে হাজির হন ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব। তার আসল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি সেনাদের নিরস্ত্র করা।

খবর পৌঁছে গিয়েছিল বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাদের কাছেও। যে কোনো পরিস্থিতি সামাল দিতে শুরু হয় ‍যুদ্ধ প্রস্তুতি। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দপ্তর ভাওয়াল রাজবাড়ির চারদিকে বসানো হয় মেশিনগানসহ বিভিন্ন ভারী অস্ত্র।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দিন। কে এম সফিউল্লাহর অ্যালবাম থেকে

জয়দেবপুরে সেদিন ছিল হাটবার। হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে কেউ কেউ নজর রাখছিলেন ব্যারাকের দিকে। বাঙালি সেনাদের নিরস্ত্র করার চেষ্টার খবর পৌঁছেছিল তাদের কাছেও।

ভাওয়াল রাজবাড়ির ফটকে পৌঁছে জাহানজেব যে প্রস্তুতি দেখলেন, তার কাছে তা ছিল অভাবনীয়। বিস্মিত, অপ্রস্তুত ব্রিগেড কমান্ডার এর কারণ জানতে চাইলেন রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক সফিউল্লাহর কাছে।

সফিউল্লাহকে তখন নিতে হয় নতুন কৌশল। হাটের ভিড়ের দিকে ইংগিত করে তিনি বলেন, তারা আছেন শত্রুদের ঘেরাওয়ের মধ্যে, যে কোনো সময় আক্রান্ত হতে পারেন; সেজন্যই আত্মরক্ষার প্রস্তুতি।

সেই মুহূর্তের কথা স্মরণ করে সফিউল্লাহ বলেন, “এমন সময় খবর এল, জয়দেবপুরে প্রাসাদের দিকে ঢুকতে যে রেলগেট, ওখানে মালগাড়ির ওয়াগন ঠেলে দিয়ে হাটের লোকজন ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে।”

বাঙালি সেনাদের তখন নতুন পরীক্ষায় ফেললেন ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব। তাদের ব্যারিকেড অপসারণের নির্দেশ দিলেন তিনি।

বাঙালি সেনারা তখন দ্বিধায় পড়ে গেলেন। জাহানজেব ব্যারিকেড সরাতে বলেছেন, কিন্তু তার চাওয়া ছিল বাঙালির রক্ত। নিজের দেশের মানুষের ওপর গুলি চালানো কীভাবে সম্ভব?

সফিউল্লাহ বলেন, “আমরা জনগণকে অনেক সাবধান করেছি, কিন্তু তারা ওখান থেকে সরেনি। শেষ পর্যন্ত আমাদের গুলি করতে হয়েছে। এক পর্যায়ে আমরা বাংলায় বলেছি, গুলি করো কিন্তু মাথার ওপর দিয়ে করো।”

বাঙালি সেনারা অবরোধকারীদের মাথার উপর দিয়ে গুলি করতে শুরু করলে জাহানজেব ফের নির্দেশ দেন- ‘মেরে ফেল’।

“শেষ পর্য‌ন্ত আমাদের গুলি করে মানুষ মারতে হয়ছে। এতে দুইজন মারা যায় এবং দুইজন আহত হয়। ওখান থেকে আমরা গেট খুলে দিলাম এবং ট্রেনটাও সরিয়ে দিলাম।”

জয়দেবপুরে প্রথম প্রতিরোধের স্মৃতিস্তম্ভ জাগ্রত চৌরঙ্গী

সফিউল্লাহ বলেন, “পরে আমার কাছে বিগ্রেডিয়ার জানতে চেয়েছিল- কত রাউন্ড গুলি খরচ হয়েছে, আর ক্যাজুয়ালিটি কত? আমি তখন বলেছিলাম, ৬৩টি গুলি খরচ হয়েছে, দুজন মারা গেছে, দুজন আহত হয়েছে।

“সে তখন আমাকে বলে ফেললে- ‘এত অল্প লোকক্ষয়ের জন্য এত গুলি খরচ!’”

সফিউল্লাহ বলেন, “বিগ্রেডিয়ার সেদিন দেখেছিল, তাদের আদেশে আমরা বাঙালি মারতে পারব কিনা। কিন্তু তারা বুঝে গেল, আমাদের দ্বারা বাঙালি মারা যাবে না।”

সাধারণ মানুষের সেই আত্মত্যাগের সেই ঘটনা স্মরণ করে তিনি বলেন, “জয়দেবপুরের মানুষ জেনেছিল যে আমাদের নিরস্ত্র করা হবে। আমাদের সাথে তাদের যোগাযোগ ছিল। ওইদিন তাদের সমর্থন না থাকলে আমরা সাহস করতে পারতাম না।”

সেদিন জনতার সেই প্রতিরোধের পর বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করতে ব্যর্থ হয় পাকিস্তানিরা। জয়দেবপুর থেকে ফিরে যেতে হয় জাহানজেবকে।

সাধারণ জনগণ সেদিন পাকিস্তানিদের দেখে খেপে গিয়েছিল জানিয়ে সফিউল্লাহ বলেন, “আওয়ামী লীগের নেতা হাবিবুল্লাহ, এখনকার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, তখনকার শ্রমিক নেতা বিএনপির নজরুল ইসলাম খান আমাদের সমর্থন দিয়েছিল। আর সাধারণ মানুষ তো ছিলই।

“ওই এলাকার মানুষ বুঝে গিয়েছিল- আমরা তাদের সাথে আছি। এ কারণে সামর্থ্য অনুযায়ী তারা আমাদের সাহায্য সহযোগিতা করেছে। আমরা সশস্ত্র ছিলাম, আর তারা ছিল নিরস্ত্র। কিন্তু তারা আমাদের সমর্থন করতে দ্বিধা করেনি। আমরা তাদের ব্যবহার করতে চাইনি। কারণ তাদের আমরা অস্ত্র দিতে পারিনি। কিন্তু তাদের সাহস আর সমর্থনেই আমরা বিদ্রোহ করতে পেরেছিলাম।”

জয়দেবপুরের প্রতিরোধ পরে সারাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। ঢাকাসহ সারা দেশে স্লোগান উঠেছিল- ‘জয়দেবপুরের পথ ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’।