বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনের বিধান হলে উদ্বেগ কমবে বলে প্রতিমন্ত্রী আশ্বাস দিলেও এর খসড়ায় সে রকম কিছু দেখছেন না নারী অধিকার কর্মীরা।
Published : 18 Mar 2017, 08:38 PM
ওই খসড়া অনুযায়ীই বিধান চূড়ান্ত হলে তা যৌন নিপীড়কদের আরও বেপরোয়া করে তুলবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সংসদে পাস হওয়া বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনে মেয়ে ও ছেলেদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স আগের মতো ১৮ ও ২১ বছর বহাল থাকলেও ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ কম বয়সেও বিয়ের সুযোগ তৈরি হয়।
আইনের বিশেষ বিধানে বলা হয়, “এই আইনের অন্যান্য বিধানে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো নারীর সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশনাক্রমে এবং মাতা-পিতার সম্মতিক্রমে বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণক্রমে বিবাহ সম্পাদিত হইলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে না।”
এই আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ার শুরু থেকে আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন নারী অধিকার ও উন্নয়ন কর্মীরা। সংসদে বিলটি পাস হওয়ার তাতে সই না করতে রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ জানান তারা।
এই প্রেক্ষাপটে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেছিলেন, আইন নিয়ে এখন যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে তা বিধি হলে কমে আসবে।
গত ১১ মার্চে আইনে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পরদিন খসড়া বিধান নিয়ে নারী অধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে মন্ত্রণালয়।
ওই খসড়া বিধিমালায় বিশেষ পরিস্থিতি হিসেবে বলা হয়, “প্রেমের সম্পর্কের কারণে ছেলে/মেয়ের বিয়ে এবং গর্ভবতী/মা হওয়া; অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের নিকটবর্তী আত্মীয় না থাকা এবং ভরণ-পোষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দুঃসাধ্য হলে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিয়ের সুযোগ থাকবে।”
এই ‘বিশেষ পরিস্থিতি’ মেয়ে শিশুদের জীবন মারাত্মক ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেওয়ার পাশাপাশি অপরাধীদের ‘লাগামহীন’ করে তুলবে বলে মনে করছেন ‘নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশি কবির।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটি অভিভাবক ও সমাজের যারা আছে তাদের পক্ষে, তাদের অবস্থা চিন্তা করে করা হয়েছে। এখানে শিশু বা মেয়েটির অবস্থা চিন্তা করা হয়নি।
“যদি শিশুটি ভুল করে সেজন্য কি তাকে পুরো জীবন মাশুল দিতে হবে? তার পড়াশুনা, জীবনচর্চা, স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা, শারীরিক গঠন- সবকিছু বিসর্জন দিতে হবে? শিশু মেয়েটি তার জীবনটা কীভাবে গড়বে? যেহেতু সে ভুল করেছে, সেজন্য জোর করে বাবা-মা তাকে বিয়ে দিয়ে দিবে?”
এই বিধান ক্ষমতাবানদের আরও বেশি নারী নির্যাতনে উৎসাহিত করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন খুশি কবির।
তিনি বলেন, “এর মাধ্যমে ধর্ষক, উত্ত্যক্তকারী ও যারা ক্ষমতায় আছে তারা বা তাদের ছেলেদের আরও বেশি সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। তাদের শাস্তি দেওয়া যাবে না, না ধর্ষণ না অপহরণ করুক- তাদের হাতে ব্ল্যাংক চেক তুলে দেওয়া হচ্ছে।
“গ্রাম-গঞ্জে অধিকাংশ মানুষ থাকে, বস্তিতে দরিদ্ররা থাকেন। এ শ্রেণির বাবা-মার সমাজে কথা বলার অবস্থা নেই, তারা সঠিকভাবে ভূমিকা নিতে পারেন না। অনেক সময় আমরা পিছনে থেকে সাহায্য করলেও তারা কেইস করেন না। অপরাধীরা ছাড় পেয়ে যায়।
“আর এই সুযোগটি দেওয়া হলে মেয়েদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। আর সেই সব ছেলেদের আরও উৎসাহিত করা হবে।”
খুশি কবির বলেন, “মানবাধিকার নিয়ে, নারীদের নিয়ে যারা কাজ করছে প্রত্যেকেই এতে আপত্তি জানিয়েছে। তাহলে প্রত্যেকেই কি ভুল বুঝছে? তাহলে সঠিকভাবে আমাদের বুঝাতে তারা সময় নিক। এটি মারাত্নক ঝূঁকিপূর্ণ কাজ হচ্ছে।”
এই বিশেষ বিধান কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় মন্তব্য করে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন বলেন, “এটি প্রচলিত আইনের সাথে অসামঞ্জস্য। এটি ধর্ষণকারীর সাথে বিয়ের সুযোগ তৈরি করে দিবে।”
তিনি বলেন, “ছেলে-মেয়ের সম্মতি ও সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিতে হবে। কিন্তু বিশেষ বিধানে ছেলে-মেয়ের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করা হচ্ছে। এটি কেবল ব্রিটিশ আইন না, মুসলিম আইনেও সাংঘর্ষিক। কারণ মুসলিম আইনেও বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক সাবালকই নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
“প্রেগন্যান্ট হলে প্রেমের বিয়ে এলাউ হবে না? অন্যদিকে জোর করে বিয়ে দিলে তা এলাউ হবে? দুটোর কোনোটাই যুক্তিসঙ্গত না। এর সম্মতি ও সিদ্ধান্ত কে দিচ্ছে? মেয়েটি যার সাথে প্রেম করছে, বাবা-মা না চাইলে সে অপরাধী হয়ে যাবে? আবার বাবা-মা জোর করে বিয়ে দিলে তা গ্রহণযোগ্য হয়ে যাবে?
“মেয়েটিকে ধর্ষণ করা হলেও বাবা-মার সম্মানের জন্য তা সহ্য করতে হবে? অন্যদিকে মেয়েটির নিজের সম্মতি মানা হবে না? এটা কীভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ তা বুঝা মুশকিল।”
এছাড়া ছেলে-মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়সে যে ব্যবধান রয়েছে তা বৈষম্যমূলক মন্তব্য করে এর বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
সারা হোসেন বলেন, “এই আইন নিয়ে সাংবিধানিক প্রশ্ন তোলার সময় এখনো আছে। বিধিমালায় ফাইনালি কী আসে, তা জেনে একসাথে তা করা যাবে।”
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলীও আইনের বিশেষ বিধানের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা বলেছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিশেষ ধারাটি নিয়ে আমরা কেইস করব।”
শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে খসড়া বিধির সমালোচনা করে তিনি বলেন, “যেদিন বিধিমালা নিয়ে আমরা বসলাম, সেদিন মন্ত্রণালয়ের সচিবরা আমাদের বলেছেন এটি ড্রাফট। প্রাথমিকভাবে এটি করা হয়েছে। কিন্তু ড্রাফটে যারা এসব লিখতে পারে, তারা কেমন মানসিকতার?
“বিশেষ বিধানে বলা হয়েছে, যে কোনো ছেলে-মেয়েই যদি নিজেরা বিয়ে করে ফেলে তাদের বাচ্চা হয়ে যায় বা প্রেগন্যান্ট হয়, তবে অভিভাবকের অনুমতি নিয়ে তারা বিয়ের রেজিস্ট্রেশন করে ফেলতে পারবে।
“আরেকটি বিষয় হচ্ছে যে শিশু বা অপ্রাপ্তবয়সীদের অভিভাবক না থাকলে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়া যাবে। অভিভাবক না থাকলে তো তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব সরকারের। এটি তো আমাদের সংবিধানের সাথেও সাংঘর্ষিক।”