ট্রাইব্যুনালের নতুন তিন বিচারকের নাম সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল।
Published : 14 Oct 2024, 08:11 PM
হাই কোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারকে চেয়ারম্যান করে আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করছে অন্তর্বর্তী সরকার।
তিন সদস্যের এ ট্রাইব্যুনালে তার সঙ্গী হচ্ছেন হাই কোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল সোমবার সচিবালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের কথা জানান।
তিনি বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে হাই কোর্টের দুইজন বিচারক এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজকে নিয়ে মানবতাবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধ বিরোধী ট্রাইব্যুনাল গঠনে আইন মন্ত্রণালয়ের অংশের কাজ শেষ হয়েছে।”
পুনর্গঠিত আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান গোলাম মর্তূজা মজুমদার ও শফিউল আলম মাহমুদকে ছয় দিন আগে হাই কোর্টের বিচারক করা হয়। আইন মন্ত্রণালয় সেদিন ২৩ জনকে হাই কোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। পরদিন তারা শপথ নেন।
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুবনাল গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এখন ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের চালানো দমন পীড়নকে ‘গণহত্যা’ বিবেচনা করে এ আদালতে বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে গঠিত এ ট্রাইব্যুনালেও পরিবর্তন আসছে।
উপদেষ্টার ঘোষণার পর আইন মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, সোমবারই এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে আসিফ নজরুল বলেন, ”বিচারকাজ শুরু করার ব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যা করার ছিল তার একটা বড় ধাপ সম্পন্ন হয়েছে। অচিরেই বিচারকাজ শুরু হয়ে যাবে।
”বিচারকাজের প্রি-ট্রায়াল স্টেজ, অর্থাৎ আলামত সংগ্রহ করা ও তদন্ত করা শুরু হয়েছে। প্রসিকিউশন ও ইনিভেস্টিগেশন টিম অনেক ক্রেডেবল আলামত সংগ্রহ করেছেন। বিচারিক কাজ অচিরেই শুরু হবে।”
গত জুলাই মাসে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এক পর্যায়ে সরকার পতন আন্দোলনে রূপ নেয়। ছাত্র-জনতার তুমুল সেই আন্দোলনের মধ্যে ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্র আন্দোলনের সময় সংগঠিত হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনায় বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় কয়েকশ মৃত্যুর ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে বিবেচনা করে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ কয়েক ডজন মানুষের বিরুদ্ধে বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে এরইমধ্যে বেশ কিছু অভিযোগ জমা পড়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ট্রাইব্যুনালে রদবদলের অংশ হিসেবে পুলিশের সাবেক দুইজন ও চাকরিরত আটজন কর্মকর্তার সমন্বয়ে তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করেছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তাজুল ইসলামকে প্রধান প্রসিকিউটর করা হয়েছে। তার সঙ্গে নতুন প্রসিকিউটরও যোগ দিয়েছেন।
নতুন তদন্ত সংস্থা গঠনের মাধ্যমে আগেরটি বাতিল হয়ে গেছে এবং আগের প্রসিকিউটররা ট্রাইব্যুনাল থেকে সরে গেছেন।
বর্তমানে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. আবু আহমেদ জমাদার এবং সদস্য এ.এইচ.এম. হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া ও বিচারপতি কে.এম. হাফিজুল আলম।
আরও পড়ুন
ছুটির পর ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হবে: আইন উপদেষ্টা
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম
স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়; আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ।
২০১২ সালের ২২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুটিকে একীভূত করে আবার একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ নামে একটি ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ চলছে।
এ আদালত থেকে এ পর্যন্ত ৫১ মামলার রায় এসেছে; দণ্ডিত ১৩১ আসামির মধ্যে ৯১ জনকে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড।
ট্রাইব্যুানালের কাজ শুরুর প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, “ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানকালে যে নির্মম গণহত্যা ঘটেছে, এক হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। হাজার হাজার ছাত্র জনতাকে আহত করা হয়েছে, কেউ চিরদিনের জন্য দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন, অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। এই অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত দুই এক দিনের মধ্যে এক্টিভেটেড হয়ে যাবে।”
আইন মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে সব ধরনের সহায়তা অব্যাহত রাখার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “যেমন যদি বলা হয় প্রসিকিউশন টিমের সদস্য বাড়ানো দরকার সেটা করব, কখনও যদি মনে করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আরেকটা ট্রাইব্যুনাল দরকার সেটা করা হবে।”
বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ
ট্রাইব্যুনাল ভবনের সংস্কার কাজ শেষ হলে বিচারপতিরা চলতি মাসেই বসতে পারেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান আইন উপদেষ্টা।
সুষ্ঠু ও আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন বিচারের জন্য আইনে সংস্কার আনার কথা তুলে ধরে আসিফ নজরুল বলেন, “আওয়ামী লীগ আমলে আইনের যে অবস্থা ছিল সেটাকে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছি। অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে আইনের সংশোধনীতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছি।
”আসামি পক্ষ যেকোনো দেশের আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবেন। আন্তর্জাতিক যে কোনো মানবাধিকার সংগঠন অবজার্ভার হিসেবে থাকতে পারবে। আসামি পক্ষকে যথেষ্ট পরিমাণ ডিউ প্রসেস অনুসরণের জন্য সুযোগ দেওয়ার বিধান রেখেছি।“
ডিজিটাল সাক্ষ্য যথেষ্ট পরিমাণে আমলে নেওয়ার ব্যবস্থা করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “অপরাধের যে ডেফিনেশন আছে সেটাও রোম স্ট্যাটিউট (রোম সংবিধি) অনুযায়ী করার চেষ্টা করেছি। অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ড্রাফটটা চূড়ান্ত করেছি। এই মাসের মধ্যেই সংশোধনীটা চূড়ান্ত হয়ে যাবে।
”তবে সংশোধনীর জন্য বিচার আটকে নাই। বিচার বর্তমান আইন অনুযায়ী শুরু হয়ে যাবে।”
যাদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ তাদের ফিরিয়ে আনার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “জুলাই-অগাস্ট গণহত্যার সময় যারা দায়ি ছিল বলে যৌক্তিকভাবে মনে করা হয় তাদের অনেকেই পালিয়ে গেছেন বা আত্মগোপনে আছেন। পলাতকদের বিচার করার বিধান এই আইনে রয়েছে।
“উনারা যদি দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের বন্দি প্রত্যার্পন চুক্তি আছে, তাদেরকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করব।”
সংগঠনের বিচার প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা বলেন, বিগত যে আওয়ামী লীগ সরকার ছিল তার নিজেরাই সংবিধান সংশোধন করে সংগঠনকে শাস্তি দেওয়ার বিধান করে গেছে। অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনায় অধিকাংশই বলেছে সংগঠনকে শাস্তি দেওয়ার বিধান রাখা উচিত।
”ফাইনাল যে ড্রাফটা করেছি সেটা সবার সঙ্গে মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত করব। সংগঠনের শাস্তির বিধান থাকবে। তবে সেটা কী ধরনের শাস্তি সেটা উনাদের মতামতের ভিত্তিতে ঠিক করব।”
গুমের অভিযোগের মামলাগুলোর বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “গুম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশনে বাংলাদেশ পক্ষভূক্ত হয়েছে। আমাদের এখানে গুমের নির্ধারিত আইন নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে গুমের অপরাধ সংযোজন করেছি।
”আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার সময় গুমের বিচার করার স্কোপ থাকবে।”