“আইনের বাইরে গিয়ে এমন পরিস্থিতি কখনই কাম্য নয়। ‘মব জাস্টিসের’ নামে নৈরাজ্য কখনই গ্রহণযোগ্য নয়,” বলেন সমাজবিজ্ঞানের এক অধ্যাপক।
Published : 19 Sep 2024, 01:17 AM
গণ আন্দোলনে সরকার পতনের পর পুলিশের ‘নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে’ বিভিন্ন এলাকায় একদল মানুষের একজোট হয়ে ‘বিচার’ করে ফেলার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা নিয়ে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে, যা ‘মব জাস্টিস’ নামে পরিচিতি পেয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে, আইন কোনোভাবেই হাতে তুলে না দেওয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছে। কিন্তু যারা এসব কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার তেমন উদাহরণও দেখা যাচ্ছে না।
এসব ঘটনায় সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি, আইনের শাসনের প্রতি অনীহা এবং ভবিষ্যতে ‘প্রতিশোধ স্পৃহা’ তৈরি করতে পারে বলে শঙ্কিত একজন অপরাধ বিশেষজ্ঞ। তিনি যে কোনো মূল্যে এসব ঠেকানোর তাগিদ দিয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ধরনের ঘটনাগুলো বিচারিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করবে। একটা বিচারে গেছেন, বিচারটাকে যদি বিশ্বাস না করেন, নিজেরাই ‘মব জাস্টিস’ করতে থাকেন, তাহলে বিচার ব্যবস্থার আর দরকার কী?”
ছাত্র-জনতার প্রবল গণ আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকেই এই ঘটনাগুলো ঘটছে; প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে আক্রমণ হচ্ছে, মাজারে মাজারে হামলা হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাউকে কাউকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ‘অভিযানে’ যেতে দেখা যাচ্ছে, এর মধ্যে তুমুল আলোচনা হচ্ছে কক্সবাজার সৈকতে কয়েকজন নারীকে হেনস্তার ঘটনাটি নিয়ে।
মোহাম্মদ ফারুকুল ইসলাম নামের এক যুবক কয়েকজন সঙ্গী সাথীকে নিয়ে একটি দল গড়ে তুলে একাকী ভ্রমণে যাওয়া নারীদের লাঞ্ছনা করে ফেইসবুকে ভিডিও পোস্ট করার পর তুমুল সমালোচনার মুখে তাকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
এরও আগে ঢাকার শ্যামলীতে ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মী সন্দেহে কয়েকজন নারীকে মারধর করে এইচ এম রাসেল সুলতান নামের এক ব্যক্তি নিজের ফেইসবুক আইডিতে ভিডিও প্রকাশ করে। তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার পর সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সংবাদ মেলেনি।
এ নিয়ে তোলপাড় হলেও মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান বিষয়টি জানেন না বলে দাবি করেছেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমি ভিডিওটি দেখিনি। কিন্তু আমার কাছে এ বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ নিয়ে আসেনি। অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের জেরে দেশজুড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের হেনস্তা করে পদত্যাগে বাধ্য করার ঘটনাতেও হচ্ছে সমালোচনা। আক্রোশের জেরে আদালতে পুলিশের সামনেই আসামিদের উপর হামলার অনেক ঘটনা ঘটানো হয়েছে, এই প্রবণতা অবশ্যও এখন কমেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে সেটির জন্য প্রচলিত আইন আছে। আইন অনুযায়ী সবকিছু হলেই সমাজে স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে। আইনের বাইরে গিয়ে এমন পরিস্থিতি কখনই কাম্য নয়। ‘মব জাস্টিসের’ নামে নৈরাজ্য কখনই গ্রহণযোগ্য নয়।”
গত ৮ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র প্রতিনিধিদের বৈঠকেও বিষয়টি উঠে আসে।
সেই আলোচনার পর প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম ব্রিফিংয়ে বলেন, “মব জাস্টিসের বিষয়ে সরকারের অবস্থান খুব স্পষ্ট। কোনোভাবে হতে দেওয়া যাবে না।…কেউ অপরাধ করে থাকলে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার সুযোগ নেই।”
এরপর ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বলেন, “কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কেউ সমাজে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করলে আমরা তাকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসব।”
আরও পড়ুন: আইন নিজের হাতে নিলে শাস্তি পেতে হবে: ইউনূস
তবে সতর্কতা, হুঁশিয়ারির মধ্যেও বিষয়গুলো যে থেমে নেই, সেটি যেমন স্পষ্ট, তেমনি সরকারের কঠোর পদক্ষেপের নমুনাও খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।
এসব ঘটনায় জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “জবরদস্তি করলে তো আর কোনো সভ্য সমাজ হল না। এগুলো কর্তৃপক্ষের নজরে এনে পদক্ষেপ নিতে হবে।”
আলোচিত ঘটনাগুলোর বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা সরকারের নির্লিপ্তিতার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, “এটা তো একটা শৈথল্যের প্রমাণ দেবে। সরকারের হাতে অনেক কাজ আছে। এটাকেও তো অগ্রাধিকারে আসার কথা। শৃঙ্খলা মানতে হবে সব জায়গায়। কোনো খাতে জবরদস্তি চলবে না।”
‘মব জাস্টিস’ নিয়ে সরকারের তরফেও যেখানে উদ্বেগ প্রকাশ হচ্ছে, সেখানে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই কেন, এই প্রশ্নে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর বক্তব্য জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
তবে গত ৪ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে এক প্রশ্নে সাংবাদিকদেরকে তিনি বলেন, “পুলিশের ইমেজ আস্তে-আস্তে কিন্তু উন্নত হচ্ছে। আমার কাছে এ রকম কোনো কিছু নাই যে আমি এক দিনে সব উন্নতি করে ফেলব। এটা আস্তে আস্তে হবে।
“আমি তো একদিনে এটা কিছু পারব না। সময় দিতে হবে। আস্তে-আস্তে আমি এটা ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
এ বিষয়ে বুধবার রাতে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "কিছু উশৃঙ্খল ঘটনা ঘটছে, তবে আমরা খবর পেলেই ছুটে যাচ্ছি এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা এসব বিষয়ে তৎপর রয়েছি। আমাদের জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করে এমন কোন ঘটনার বিষয় জানালেও আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছি।"
কক্সবাজারের নারী হেনস্তার ঘটনায় একজন ছাড়া গ্রেপ্তার নেই কেন-এই প্রশ্নে তিনি বলেন, "গ্রেপ্তার একটা চলমান প্রক্রিয়া। অনেক ঘটনায় মামলা হচ্ছে, পর্যায়ক্রমে জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।"
শিক্ষক হেনস্তা চলছেই
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের হেনস্তা করে পদত্যাগে বাধ্য করার ঢালাও ঘটনাগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনাও আসেনি সংবাদমাধ্যমে।
গত ১০ সেপ্টেম্বর নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার খেলনা ইউনিয়নের রেড়িতলা একাডেমিতে পদত্যাগে বাধ্য করতে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষিকা জিন্নাতুন পারভীন ডলি ও তার স্বামী আশরাফুল হককে শ্রেণিকক্ষে দড়ি দিয়ে বেঁধে দিনভর নির্যাতন করা হয়।
সেনাবাহিনী ও পুলিশ গিয়ে নির্যাতনের শিকার দুই শিক্ষককে উদ্ধার করে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা শেষে তাদেরকে ভর্তি করা হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করেন।
সপ্তাহ ঘুরলেও এ ঘটনায় মঙ্গলবার পর্যন্ত মামলা হয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন ধামইরহাট থানার ওসি বাহাউদ্দীন ফারুকী।
এর আগে ৫ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরের সালথা উপজেলার যদুনন্দী নবকাম পল্লী কলেজে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে অধ্যক্ষ মো. ওবায়দুর রহমানের কাছ থেকে জোর করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: সিগারেটের প্যাকেট থাকায় পদত্যাগ করতে চাপ, কর্মকর্তা অসুস্থ
জবরদস্তিতে পদত্যাগ, স্ট্রোক করে অধ্যক্ষ 'ভালো নেই'
সেই রাতে ভুক্তভোগী ওবায়দুর সালথা থানায় মামলা করেন যাতে মামলায় প্রধান আসামি করা হয় কলেজের পাশের বাসিন্দা যদুনন্দী এলাকার কাইয়ুম মোল্যাকে, আসামি হিসেবে নাম আছে আরও ৯ জনের।
সালথা থানার এসআই সুজন বিশ্বাস মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। আসামিরা আদালত থেকে আগাম জামিন নিয়ে আসার কথা শোনা যাচ্ছে। তবে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই।”
২৮ অগাস্ট নওগাঁর হাঁপানিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের চাপের মুখে অধ্যক্ষ নুরুল ইসলামের পদত্যাগ করার পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
নওগাঁ জেনারেল হাসপাতাল ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হয়ে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে।
নওগাঁ সদর থানার ওসি জাহিদুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মামলাই হয়নি, গ্রেপ্তার হবে কীভাবে? শুনেছি ওই শিক্ষক এখন সুস্থ আছেন। তবে তিনি পরে আর আমাদের কাছে আসেননি।”
মাজারে হামলা, সরকারের ‘বার্তার’ পরও ব্যবস্থা নেই
দেশজুড়ে একের পর এক মাজারে হামলা, ভাঙচুরের মধ্যে গত ১৪ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এক বার্তায় বলা হয় “এ সকল হামলার সাথে জড়িতদের অতি দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
পরের দিন শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় ডিসিদেরকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয় ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। কিন্তু গত তিন দিনে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এমন কোনো তথ্য আসেনি সরকারের কোনো সংস্থার তরফে। অথচ এই হামলাগুলো সমালোচনা তৈরি করছে ইসলাম ধর্মের অনুসারীসহ সবার মাঝে।
গত ৯ সেপ্টেম্বর রাতে আক্রমণ হয় সিলেটের হযরত শাহপরাণের (রহ.) মাজারে। একদল লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে আক্রমণ করে এবং ভাঙচুর চালায়।
ঘটনার আট দিন পর মঙ্গলবার শাহপরাণ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ না দেওয়ায় মামলাও হয়নি। তবে শুনেছি স্থানীয়দের মাধ্যমে বিষয়টির সুরাহা হয়েছে।”
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বার্তা আসার দিনই ১৪ সেপ্টেম্বর সিলেটের শাহপরাণ (রহ.) থানার খাদিমপাড়া এলাকায় শাহ সুফি আব্দুল কাইয়ুমের মাজার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এই হামলার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে ফেইসবুকে।
আরও পড়ুন: মাজারের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় ডিসিদের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ
সিরাজগঞ্জে আরেক মাজার ভাঙচুর, হাড়গোড়ও তুলে নিল
শাহপরাণ থানা এলাকার একটি 'মাজার' ভেঙে ফেলা হয়েছে
হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার মদনপুর এলাকায় দেওয়ানবাগ মাজারেও। সেখানে লুটপাট করে আগুনও দেওয়া হয়।
সোনারগাঁ উপজেলার সনমান্দি ইউনিয়নে আয়নাল শাহ দরগা নামে পুরোনো একটি মাজার ভেঙে ফেলা হয়েছে।
নোয়াখালী পৌরসভার লক্ষ্মী-নারায়ণপুর এলাকার ফকির চাড়ু মিজি শাহ্ (র.) মাজারে (দরগাহ বাড়ির মাজার) হামলা হয়েছে ১৪ সেপ্টেম্বর।
একই দিনে গাজীপুর মহানগরের পোড়াবাড়ি এলাকায় দুপুরে শাহ সুফি ফসিহ উদ্দিন (র.) মাজারে ভাঙচুর-লুটপাটের পর তাতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
সিরাজগঞ্জে তিন জায়গার মাজারে হামলার খবর পাওয়া গেছে এখন পর্যন্ত। সদর উপজেলার শিয়ালকোল ইউনিয়নের শ্যামপুর গ্রামে ‘হযরত বড়পীর গাউসুল আজম দরবার শরীফে হামলা-ভাঙচুর চালানোর পর তিনটি কবর খুঁড়ে সেখান থেকে হাড়গোড়-মাথার খুলিও নিয়ে গেছে একদল সশস্ত্র লোক। দুটি খানকা ও একটি রান্নাঘর ভাঙচুর করা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ সদর থানার ওসি হুমায়ুন কবির বলেন, “এখন পর্যন্ত মামলা হয়নি, কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।”
২৯ অগাস্ট কাজিপুর উপজেলার মনসুর নগর ইউনিয়নের বামনজানি বাজারের পাশে ‘আলী পাগলার মাজার’ এবং ৩ সেপ্টেম্বর সদর উপজেলার কালিয়া হরিপুর গ্রামের ‘ইসমাইল পাগলার মাজার’ ভাঙচুর করা হয়।
এর মধ্যেই রাজধানীর গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজারে হামলা হতে পারে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে হামলা ঠেকাতে সেখানে কয়েকশ মানুষ অবস্থান নেয়।
এই হামলার মধ্যে গত সোমবার মহানবী (স.) এর জন্মদিন ঈদে মিলাদুন্নবীর আয়োজনকে ঘিরে সংঘাত হয়েছে, প্রাণহানিও হয়েছে, কিন্তু পুলিশের ব্যবস্থা গ্রহণের তথ্য আসেনি।
এসব ঘটনায় ধর্ম নিয়ে উন্মাদনা ও বিভক্তি বেড়ে যেতে পারে শঙ্কায় আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ শফিক আহমেদ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির সুযোগ নাই। একটা রাষ্ট্রে বিভিন্ন মতের, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ থাকবে। ওয়াহাবি এবং সালাফি মতাদর্শের মুসলমানরা মাজারকে বাতিল মনে করে। কিন্তু তারাই এসব হামলা করছে কি-না, অথবা অন্য কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে কি-না সেটিও খতিয়ে দেখা উচিত।
”তবে যারাই এগুলো করে থাকুক, এটা ইসলামের মূল চেতনার পরিপন্থি, ইসলামে এমন হামলা চালানোর সুযোগ নেই।”
প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা
গত ৭ সেপ্টেম্বর রাতে রাজশাহীর বিনোদপুর বাজারে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
২০১৪ সালে একটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা তার ওপর হামলা চালিয়ে তার এক পা কেটে নেওয়ার পাশাপাশি অন্য পা ও হাতের রগ কেটে দেয়।
আরও পড়ুন: ঈদে মিলাদুন্নবী: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংঘর্ষে আহত ২০
কিশোরগঞ্জে জশনে জুলুসের মধ্যে সংঘর্ষ, নিহত ১
অঙ্গহারা মাসুদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রের স্টোর কিপার পদে কর্মরত ছিলেন।
পেটানোর পর গুরুতর আহত হয়ে বোয়ালিয়া থানার হাজতে শুয়ে থাকা অবস্থায় আহত মাসুদ তার শিশু বাচ্চার কথা বলে পানি খেতে চেয়েছিলেন।
তিন বা চার দিন আগে কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছিলেন সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতা। সেই শিশুর জন্য ওষুধ কিনতে গিয়ে হামলার শিকার হন। ১০ বছর আগে যে ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা হামলা করেছিলেন, সেই সংগঠনের নেতাকর্মীরাই এবারও হামলা করেছে বলে অভিযোগ আছে।
মাসুদকে হত্যার ঘটনায় ৮ সেপ্টেম্বর নগরীর মতিহার থানায় মামলা করেন তার বড়ভাই মো. বেহেস্তী।
মতিহার থানার ওসি মো. আরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন, তারা কাউকে গ্রেপ্তার করেননি।
আরও পড়ুন: রাবির সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মাসুদ হত্যার ঘটনায় মামলা
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাজশাহীতে ছাত্রলীগ করত ছেলেটা। ২০১৪ তে তার পায়ের রগ কেটে দেয়। তারপর থেকে সে রাজনীতির সাথেও সংশ্লিষ্ট ছিল না, তাকে যে পিটিয়ে মারার মত ঘটনা ঘটেছে এটা একটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এটা যতটা না গণপিটুনি, বর্ণনাগুলো পড়ে আমার কাছে মনে হয়েছে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।”
এই ঘটনার রেশ না কাটতেই ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই নারকীয় হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বুধবার একদল শিক্ষার্থীর হাতে মারধরের শিকার হয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম মারা গেছেন। একইদিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চোর সন্দেহে পিটিয়ে ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ এক যুবককে মেরে ফেলা হয়।
ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সদস্য এবং সমর্থকদেরকে গ্রেপ্তার করে আদালতে নেওয়ার পরও হামলা হয়েছে ‘দলবদ্ধ’।
ঢাকায় সাবেক মন্ত্রী দীপু মনির ওপর, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের ওপর সিলেটে হামলা হয়েছে। এ হামলায় বিচারপতি মানিকের অণ্ডকোষ ফেটে যায়। ঢাকায় একাধিক সাংবাদিককে পেটানো হয়েছে।
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “যারা ঘটনা ঘটাচ্ছে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোটা খুবই জরুরি।”
প্রতিশোধ স্পৃহা তৈরি করবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, “মব জাস্টিস কখনোই ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে না। এখন যিনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তিনিও আরেকটা সুযোগের অপেক্ষায় থাকবেন। একটি মব আরও অনেকগুলো মব বয়ে নিয়ে আসে। ‘সে আমার ক্ষতি করেছে, তাহলে নিজের বিচার নিজেই করব’- একটি সমাজে এ ধরনের প্রবণতা বেশি থাকলে সমাজে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
“কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে সেটির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন, কিন্তু সে জায়গায় না গিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া মোটেও কাম্য নয়।”
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “একসঙ্গে অনেকগুলো মানুষ একত্র হয়ে ব্যক্তিগত ক্ষোভ-প্রতিহিংসার জায়গা থেকে অন্যের উপর আক্রমণ করছে। এ ধরনের ঘটনা সেসব সমাজেই বেশি হয়ে থাকে যেসব সমাজ বিশ্বাসভিত্তিক বেশি এবং জ্ঞানভিত্তিক কম।”
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন “এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পেছনে মূল কারণ পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা। …শুরুর দিকে কিছুটা সক্ষমতার ঘাটতিও ছিল, নৈতিক অবস্থানও দুর্বল ছিল। তারা যে গ্রেপ্তার করতে যাবে, নিজেরাই তো আন্দোলনের সময় অভিযুক্তের পর্যায়ে পড়ে যাচ্ছিল। সুযোগটাও কম ছিল শুরুর দিকে। কিন্তু এখন পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটছে। এখন এই অজুহাত চলবে না।”