চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার সেই কর্মকর্তা একদিন হাসপাতালে কাটিয়ে বাসায় ফিরেছেন। তবে ভয়ে অফিসে যাচ্ছেন না।
Published : 21 Aug 2024, 09:48 PM
এক সরকারি কর্মকর্তার অফিসের ড্রয়ারে দুই প্যাকেট সিগারেট খুঁজে পেয়ে একদল তরুণ তাকে পদত্যাগ করতে চাপ দেওয়ার পর সেই কর্মকর্তা অসুস্থ হয় পড়লে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছে।
গত সোমবার ঘটনাটি ঘটেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভায়। একদিন হাসপাতালে থেকে সেই কর্মকর্তা বাসায় ফিরেছেন। তবে তিনি এখন কর্মস্থলে যাচ্ছেন না।
তরুণদের সেই দল পৌরসভার আরও দুই কর্মকর্তাকে সাদা কাগজে ’পদত্যাগপত্র’ লিখতে বাধ্য করেছেন। ভয়ে তারাও অফিসে যাচ্ছেন না।
এই তরুণদের নেতৃত্বে ছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের উপদেষ্টা পরিচয় দেওয়া ইসমাইল হোসেন সিরাজী।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছেন, ছাত্র জনতার চাপের মুখে তিনি তাদেরকে ‘শান্ত করতে’ এই কাজ করেছেন।
কী হয়েছিল সেখানে
এই ঘটনার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে ফেইসবুকে। এতে দেখা যায় একদল তরুণ এসে পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী তৌফিক ইসলামের কক্ষে ঢুকে হই চই করতে থাকে।
একজন বলতে থাকেন, “অফিসে সিগারেটের গন্ধ, ভিডিও কর, ভিডিও কর।”
ভিডিওতে দেখা যায়, প্রকৌশলী তৌফিককে সিরাজী বলেন, “আপনার টাকা দিয়ে মাদক খান, গন্ধে কেউ ঢুকতে পারে না।”
সিরাজী তার সঙ্গে থাকা তরুণদেরকে জিজ্ঞেস করেন, “ওই গন্ধ হচ্ছে?”
সঙ্গীরা সমস্বরে জবাব দেন, “হচ্ছে।”
সিরাজী বলেন, “অফিসে মাদক! আমরা বাংলাদেশকে মাদক মুক্ত করতে চাই। তারই ধারাবাহিকতা হবে একে অফিস থেকে এখনই পদত্যাগ করে চলে যেতে হবে।”
তিনি ওই কর্মকর্তাকে ধমকাতেও থাকেন।
এরপর এই কর্মকর্তাকে দাঁড় করিয়ে তার পকেটে তল্লাশি করা হয়। কিন্তু কিছু পাওয়া যায়নি। এরপর তাকে দাঁড় করিয়ে সিগারেটের প্যাকেট দুটি তার দুই কলারে পিন দিয়ে সেঁটে দেওয়া হয়।
তখন সেই কর্মকর্তা কাঁপতে থাকলে তাকে বসানো হয়। এরপর একজন গ্লাসে করে পানি পান করান। তখনও তিনি কাঁপতে শুরু করলে একজন বলতে থাকেন, “এই ছেড়ে দে, ছেড়ে দে।”
পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা মামুন অর রশিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তৌফিকুল ইসলাম এই ঘটনায় ‘অজ্ঞান’ হয়ে পড়েছিলেন। পরে অফিসের লোকজন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
ওই তরুণরা কী বলছিলেন, তা বুঝতে না পারার কথা জানিয়েছেন তৌফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, “ওরা যে কী বলছিল বুঝতে পারছিলাম না। দুই তিন মিনিট পরেই জ্ঞান হারিয়েছিলাম। ভয় পেয়েছিলাম, অনেকগুলো ছেলেপুলে…
“তারা বলেছিল পদত্যাগ করতে, আমি তো জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি।”
মঙ্গলবার হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “ডাক্তার দুই দিন বিশ্রাম নিতে বলেছে। দুইটা টেস্ট দিয়েছে, রাজশাহী গিয়ে করাব।”
সাদা কাগজে পদত্যাগপত্র লিখে সই দুজনের
নির্বাহী প্রকৌশলীর কক্ষে যাওয়ার আগে পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা মামুন অর রশিদ ছাড়াও হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা আহসান হাবীবের কক্ষে গিয়ে তাদেরকে সাদা কাগজে পদত্যাগপত্র লিখতে বাধ্য করানো হয়।
মামুন অর রশিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তারা এসেছিল মেয়রকে নাকি পদত্যাগ করাবেন। মেয়র কি আমাদের আন্ডারে কাজ করে নাকি?”
এই পৌরসভার মেয়র ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা মোখলেছুর রহমান, যিনি সরকার পতনের পর ১৮ অগাস্ট তার কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। এরই মধ্যে তিনিসহ দেশের সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়রদেরকে অপসারণ করা হয়েছে।
তারা আপনাকে কী বলেছিলেন?- এই প্রশ্নে মামুন বলেন, “বলে আপনারা পদত্যাগ করেন, হ্যানতেন।”
পরে কী করলেন?
ঘটনার বর্ণনায় নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন “বাধ্য হয়ে যা বলছে তাই করতে হবে। তারা যেভাবে আক্রমণাত্মক ছিল, এখন তো জান বাঁচানো মুশকিল। স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে কি জান বাঁচবে?”
এই কর্মকর্তা বলেন, এই ঘটনা জানতে পারার পর ডিসি অফিসের উপপরিচালক (স্থানীয় সরকার) দেবেন্দ্রনাথ ওরাও তাকে কল করে তার অফিসে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি যাননি।
কেন যাননি-এই প্রশ্নে জবাব এল, “আমরা খুব নিরাপত্তাহীনতায় আছি। জীবনই বাঁচে না। বলেছি, “যদি আপনাদের কাছে যাই আবার যদি আক্রমণ করে, তাহলে কে নিরাপত্তা দেবে? আপনার কাছে গেলে ভাববে কমপ্লেইন করতে গেছি।
“তখন তো আবার আক্রমণ করতে পারবে। তখন সে বাঁচাবে? পুলিশ তো নিজেই বিপন্ন।”
মেয়র অপসারিত হওয়ার পর দেবেন্দ্রনাথ ওরাও এখন চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার প্রশাসক হয়েছেন।
সাদা কাগজে পদত্যাগপত্র লিখিয়ে যে সই নেওয়া হয়েছে, তাতে কি পদত্যাগ হয়ে যাবে?- এই প্রশ্নে মামুন অর রশিদ বলেন, “না, এভাবে পদত্যাগ হয় নাকি?”
তাহলে অফিস করছেন না কেন- এই প্রশ্নে মামুন অর রশিদ বলেন, “পরিবেশ তো নাই কাজ করার। ভীষণ খারাপ লেগেছে।”
সিরাজী যা বলছেন
এই ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে তরুণদের নেতৃত্ব দেওয়া ইসমাইল হোসেন সিরাজী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা পৌরসভায় গিয়েছিলেন মেয়রের খোঁজে। মেয়রকে মন্ত্রণালয় থেকে বরখাস্ত করলেও তিনি সেখানে আছেন বলে খবর পেয়েছিলেন।
আগে শোক দিবস ১৫ অগাস্টের জন্য খরচ, ব্যানার ফেস্টুন এই অফিস থেকেই দেওয়া হত বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
তৌফিক ইসলামের কক্ষে কী হয়েছিল- এই প্রশ্নে সিরাজী বলেন, “সেখানে অনেক ছেলে ছিল। আমার রাগ হয়েছে সিগারেটের প্যাকেট দেখে। তখন পদত্যাগের বিষয়ে হই চই হচ্ছিল।
“তিনি টয়লেটে গাঁজা বা সিগারেট খাচ্ছিলেন।… তখন মানুষের চাপে বলেছি।”
সাদা কাগজে পদত্যাগপত্র লিখিয়ে নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “আমাদেরকে যারা আন্দোলনে দমন নিপীড়ন করেছে, তাদেরকে তারা টাকা পয়সা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।
“ওই অফিসটা দুর্নীতির আখড়াও। ছাত্র বিপ্লব হওয়ার পরে উপস্থিত জনগণ ও ছাত্ররা চাপ দিচ্ছে। তখন আমি তাদেরকে শান্ত করতে এই কাজ করেছি।”
এভাবে কি সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ হয়?- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “না, ওটা তো মন্ত্রণালয় দেখবে। আমি পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য বলেছি।”
কোনো রাজনৈতিক পরিচয় আছে কি না- এই প্রশ্নে সিরাজী ‘না’ সূচক জবাব দিয়ে বলেন, “আমি রাজনীতি ঘৃণা করি।”
নিজেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর সমন্বয়ক বলে পরিচয় দেন সিরাজী। জানান, নিজেরও দুটি সংগঠন আছে, এগুলো হল মহানন্দা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং আদিনা ফজলুল হক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।