সিগারেটের উচ্ছিষ্ট বা মশার কয়েল থেকে আগুন লাগতে পারে বলে ডিএসসিসির তদন্ত কমিটির ধারণা।
Published : 12 Apr 2023, 12:37 AM
বঙ্গবাজারের আগুনে ৩০৩ কোটি টাকার ক্ষতির হিসাব দিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় টিন-কাঠের বিপণিবিতান না রাখার সুপারিশ করেছে নগর সংস্থাটির তদন্ত কমিটি।
মঙ্গলবার বিকালে শেখ ফজলে নূর তাপসের কাছে দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের আদর্শ ইউনিটের তিন তলার আলমগীরের এমব্রয়ডারি টেইলার্স থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। সিগারেটের উচ্ছিষ্ট বা মশার কয়েল থেকে আগুন লাগতে পারে বলে কমিটি ধারণা করছে।
তবে নাশকতা বা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে যে আগুন লাগেনি, সে বিষয়ে যুক্তিও তুলে ধরা হয়েছে।
এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা এড়াতে কমিটি প্রতিবেদনে ১০টি সুপারিশে বিভিন্ন করণীয় সম্পর্কে তুলে ধরেছে।
ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের জানান, মঙ্গলবার বিকালে কমিটির সভাপতি ও নগর সংস্থার অঞ্চল ১ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মেরীনা নাজনীন প্রতিবেদনটি মেয়র তাপসের কাছে দাখিল করেছেন।
গত মঙ্গলবার সকালের লাগা দীর্ঘআগুনে পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজারের ঘটনার তদন্তের প্রতিবেদনটির কপি সংবাদমাধ্যমের কর্মীদেরও দেওয়া হয়।
ডিএসসিসির মালিকানাধীন ১ দশমিক ৭৯ একর জায়গায় গড়ে তোলা বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে আগুন লাগার পর নগর সংস্থাটি আট সদস্যের একটি কমিটি করেছিল।
কমিটি সরেজমিন পরিদর্শনের পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা, স্থানীয় লোকজন, ক্ষতিগ্রস্ত দোকানদার ও ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে কথা বলে
প্রতিবেদন তৈরির কথা জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অগ্নিকাণ্ডের সময় চৈত্রের খরতাপ ও বাতাসের প্রবাহ বেশি থাকায় খুব দ্রুত আগুন ছড়ায়। তাতে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি ইউনিট- বঙ্গবাজার ইউনিট, গুলিস্তান ইউনিট, মহানগর ইউনিট ও আদর্শ ইউনিট ভস্মীভূত হয়ে যায়। এসব মার্কেটে সিটি করপোরেশনের অনুমোদিত ২৯৬১টি দোকান ছিল।
বঙ্গবাজারের পূর্ব পাশে মহানগর শপিং কমপ্লেক্সের বেশির ভাগ দোকান ভস্মীভূত হয় এবং বাকিগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে তদন্ত কমিটি জানিয়েছে। বেসরকারি মালিকানাধীন এ মার্কেটের দোকান সংখ্যা ৭৯১টি।
অপরদিকে উত্তর পশ্চিম কোণের সাততলা এনেক্সকো টাওয়ারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেখানকার প্রায় সব দোকানের বীমা রয়েছে। তবে সেখানকার ক্ষতিগ্রস্ত দোকানের সংখ্যা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।
বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডে ‘নাশকতা পায়নি’ ডিএসসিসির তদন্ত কমিটি
বঙ্গবাজারে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করছে ডিএসসিসি
এনেক্সকো টাওয়ারের পরিচালক জহিরুল ইসলাম কমিটিকে বলেছেন, বীমা থাকায় এই মূহূর্তে তারা ক্ষতিগ্রস্ত তালিকা দাখিল করার চিন্তা করছেন না।
সেদিন সকালের ভয়াবহ আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বঙ্গবাজারের পশ্চিম পাশের সড়কের অপর প্রান্তের বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটের ৫৯ দোকান এবং বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্সের ৩৪ দোকান।
এনেক্সকো টাওয়ার বাদে বাকি সাত মার্কেটের ৩ হাজার ৮৪৫ দোকানের কাঠামোগত ও মালামালের ক্ষতির পরিমাণ ৩০২ কোটি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এনেক্সকো টাওয়ারের শুধু কাঠামোগত এক কোটি টাকার ক্ষতির হিসাব দিয়েছে কমিটি।
‘নাশকতা বা শর্ট সার্কিট নয়’
টিন, কাঠ ও লোহার কাঠামোতে তিনতলা বিশিষ্ট বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের কোনো কোনো ইউনিটের কিছু অংশ চারতলা পর্যন্ত উন্নীত করা হয়েছিল উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন রকমের কাপড়ের দোকানের পাশাপাশি সেখানে গুদাম ও কারখানাও ছিল। আগুনের কারণ অনুসন্ধানের জন্য মার্কেটের ছয়জন নৈশপ্রহরী ও একজন বৈদ্যুতিক মিস্ত্রির সঙ্গে কথা বলেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা।
তারা কমিটিকে জানিয়েছেন, আদর্শ ইউনিটের নৈশপ্রহরী বিল্লাল হোসেন ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে তিন তলায় আলমগীর টেইলার্সের বন্ধ শাটার থেকে ধোঁয়া দেখে চিৎকার শুরু করেন। তা শুনে ছুটে যান আরেক নৈশপ্রহরী দেলোয়ার ও বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি মামুন। তারা তিনজন মিলে ফায়ার এক্সটিংগুইশার দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু পারেননি। খুব দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। নিরাপত্তাকর্মীরা ফায়ার সার্ভিসকে জানালে ১০ মিনিটের মধ্যে ফায়ার কর্মীরা এসে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিদিন রাত ১১টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত মার্কেটের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রাখা হয়। দুর্ঘটনার সময়ও বৈদ্যুতিক সংযোগের সার্কিট ব্রেকার বন্ধই ছিল।
তবে আলাদা একটি সাবলাইনের মাধ্যমে প্রতিটি তলার লাইট, সিসি ক্যামেরা, ইন্টারনেট ও মসজিদের ফ্যান-বাতি জ্বালানোর ব্যবস্থা ছিল। আগুন লাগার পরও সেসব বাতি জ্বলছিল। সে থেকে ধারণা করা যায়, সেখানে শর্ট সার্কিটের ঘটনা ঘটেনি।
কেন নাশকতার সন্দেহ করা হচ্ছে না- সে বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগ্নিকাণ্ডের সময় বাইরের কোনো মানুষ মার্কেটে ছিল না। যে এমব্রয়ডারি টেইলার্স থেকে আগুনের সূত্রপাত বলা হচ্ছে, সেই টেইলার্সের ঠিক উপরেই চারতলায় নিরাপত্তাকর্মীদের থাকার ব্যবস্থা ছিল।
নাশকতার উদ্দেশ্যে এরকম জায়গায় হামলা চালানো অযৌক্তিক উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাশকতার উদ্দেশ্য থাকলে রাস্তার পাশের কোনো দোকানকেই টার্গেট করার কথা। আবার হানিফ ফ্লাইওভার থেকে কোনো মাধ্যমে কোনো কিছু ছুঁড়ে দিলে অবস্থানগত কারণেই তা আগুনের সূত্রপাতস্থলে পৌঁছানোর কথা নয়।
আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে যা বলছে কমিটি
প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় থাকায় দোকান মালিক, ভাড়াটিয়া, কর্মচারী, নিরাপত্তা প্রহরীসহ সবার জন্য বৈদ্যুতিক হিটার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, যেকোনো রান্নার চুলা, মশার কয়েল ব্যবহার বা ধূমপানের বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল মার্কেট সমিতি। তারপরও তালা মারা একটি দোকানে আগুন লেগেছে আর দোকানটি সরাসরি নিরাপত্তা প্রহরীদের রুমের নিচে অবস্থিত।
সাক্ষীদের ভাষ্য অনুযায়ী, চতুর্থ তলার নিরাপত্তা প্রহরীদের কক্ষের মেঝে কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি, এতে ফাঁকা বা গ্যাপ ছিল।
প্রহরীদের থাকার ঘরে অবস্থানরত কারও ধূমপানের অভ্যাস থাকলে সেখান থেকে মেঝের ফাঁকা দিয়ে তৃতীয় তলায় আগুন যাওয়ার সম্ভাবনা আছে উল্লেখ করে কমিটি বলছে, অনেক সময় ধূমপায়ীরা সিগারেট বা বিড়ি মেঝেতে ফেলে পা দিয়ে পিষে নেভানোর চেষ্টা করে। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, হোসেন পাটোয়ারী নামের এক নিরাপত্তা প্রহরীর ধূমপানের অভ্যাস ছিল। তবে সাক্ষ্য গ্রহণের সময় হোসেন জানান, তিনি ১৫-১৬ বছর আগে ধূমপান ছেড়ে দিয়েছেন।
বঙ্গবাজারে ৩৮৪৫ দোকান পুড়ে ৩০৩ কোটি টাকার ক্ষতি: তদন্ত কমিটি
পুড়ল বঙ্গবাজার: এক আগুনে ছাই হল হাজারো স্বপ্ন
বঙ্গবাজারের আগুন পুরোপুরি নিভল ৭৫ ঘণ্টা পর
তবে অন্য প্রহরীদের সঙ্গে কথা বলে কমিটি জেনেছে, ধূমপানের অভ্যাসের জন্য এক বছর আগেও মার্কেট কমিটি তাকে সতর্ক করেছিল। তাতে হোসেন সাক্ষ্যে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, হোসেন তার রাতের ডিউটি শেষে ইউনিফর্ম পরিবর্তনের জন্য প্রহরীদের কক্ষে যায়। তারপর মসজিদে নামাজ পরে সেখানেই ঘুমিয়ে যায়। সেহেরি খাওয়ার পর যদি তিনি লুকিয়ে সিগারেট খেয়ে থাকেন এবং চতুর্থ তলায় পোশাক পরিবর্তনের সময় সেটি পা দিয়ে নেভানোর চেষ্টা করে থাকেন, তাহলে কাঠের তক্তার ফাঁকা অংশ দিয়ে তা সরাসরি তৃতীয় তলায় পড়ে আগুন লাগতে পারে।
সাক্ষীদের বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, বঙ্গবাজার মার্কেটে মশার উপদ্রব ছিল। সেকারণে নিরাপত্তা প্রহরীরা মশার কয়েল ব্যবহার করতে পারেন। সেই কয়েল থেকেও তৃতীয় তলার এমব্রয়ডারি টেইলার্সে আগুনের সূত্রপাত ঘটতে পারে।
সুপারিশ
তদন্ত কমিটি পরে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে ১০টি সুপারিশ করেছে।
>> ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় কাঠের/ টিনের মার্কেট থাকা সমীচীন নয়। যদি থেকে থাকে তা দ্রুত কংক্রিট বা পাকা করার ব্যবস্থা করতে হবে।
>> মার্কেটগুলোতে পর্যাপ্ত ফায়ার এক্সটিংগুইশারসহ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এগুলো ব্যবহারের জন্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
>> নিয়মিতভাবে ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’ পরিদর্শন করে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা সচল আছে কি না তা যাচাই করে সনদ দেবে। সেই সনদ দৃশ্যমান স্থানে ঝুলিয়ে রাখতে হবে।
>> মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ডে ওয়াটার রিজার্ভার থাকতে হবে এবং এটা থেকে পাইপের মাধ্যমে যুক্ত করে মার্কেটের চারটি স্থানে ওয়াটার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
>> মার্কেটের ভেতরে চলাচলের জন্য গলি বা রাস্তার পর্যাপ্ত জায়গা রাখতে হবে।
>> বৈদ্যুতিক সংযোগ, ভোল্ট ক্যাপাসিটি ও ব্যবহারের মধ্যে সামঞ্জস্য সঠিক বা পর্যাপ্ত রয়েছে কি না, তা সর্বদা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
>> খাবারের দোকান, রেস্তোরাঁ, মসজিদ, থাকার স্থান-এসব মার্কেটের বাইরে বা এক পাশে থাকা প্রয়োজন।
>> পর্যাপ্ত নিরাপত্তা কর্মী, বিদ্যুৎ কর্মী, সচেতন ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা থাকা প্রয়োজন।
>> বৈদ্যুতিক সংযোগের জন্য মানসম্মত তার ব্যবহার করতে হবে।
>> সিটি করপোরেশন অধিভুক্ত সব জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে।
মেয়রের কাছে প্রতিবেদনটি দেওয়ার সময় করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান, কমিটির সদস্যদের মধ্যে প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আরিফুল হক, প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা আকন্দ মোহাম্মদ ফয়সাল উদ্দীন, রমনা রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুহাম্মদ মামুনুল হক এবং সংরক্ষিত আসন ৫ এর কাউন্সিলর রোকসানা ইসলাম চামেলী উপস্থিত ছিলেন।