পুড়ল বঙ্গবাজার: এক আগুনে ছাই হল হাজারো স্বপ্ন

বঙ্গবাজারের হাজারো ব্যবসায়ী ঈদকে সামনে রেখে নতুন পুঁজি খাটিয়েছিলেন, আগুনে তাদের সর্বস্ব গেছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 April 2023, 07:47 PM
Updated : 4 April 2023, 07:47 PM

“ভাই কিছুই নাই। ছাই আর ছাই। আমি শূন্য হয়ে গেছি,” আর্তনাদ করছিলেন রফিকুল ইসলাম। তার চোখের সামনে তখন জ্বলছিল বঙ্গবাজার মার্কেট; পুড়ছিল তার দুটি দোকান। জিন্স প্যান্টের দুটি দোকানে রফিক ঈদ উপলক্ষে তুলেছিলেন নতুন কাপড়; সবই পুড়েছে।

পাশেই আহাজারি করছিলেন মাসুদ আলী- “৪০ লাখ টাকার মালামাল ছিল, সব কিছু পুইড়া গেছে। ক্যাশ ড্রয়ারে ৪০ হাজার টাকা রাইখা আইছিলাম। আমি পথে বসে গেছি, আমার কিছুই নাই।”

ব্যাংক থেকে ১২ লাখ টাকা আর সমিতি থেকে আরও কিছু টাকা ঋণ নিয়ে সোমবার রাতেই ১৪ লাখ টাকার মালামাল তুলেছিলেন মাঈনুদ্দিন আহমেদ। পোশাকগুলো তো পুড়েছেই, এখন ঋণ পরিশোধ কীভাবে হবে, সে নিয়ে দুশ্চিন্তায় এই ব্যবসায়ী।

রফিক, মাসুদ কিংবা মাঈনুদ্দিনের মতো বঙ্গবাজারের হাজারো ব্যবসায়ী ঈদকে সামনে রেখে নতুন পুঁজি খাটিয়েছিলেন, মঙ্গলবারের আগুনে তাদের সর্বস্ব গেছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন বঙ্গবাজারের মূল মার্কেটে রয়েছে চারটি ইউনিট- বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, গুলিস্তান ইউনিট, মহানগর ইউনিট ও আদর্শ ইউনিট। টিন আর কাঠে নির্মিত এই মার্কেটে দোকানের সংখ্যা ২ হাজার ৩৭০টি। এগুলোর সবই এখন পুড়ে ছাই।

বঙ্গবাজারের উত্তর পশ্চিম কোণে সাততলা এনেক্সকো টাওয়ার, তার পূর্ব পাশে মহানগর কমপ্লেক্স মার্কেটও (পুলিশ সদর দপ্তর লাগোয়া) পুড়েছে। আগুন বঙ্গবাজারের পশ্চিম পাশের সড়কের অপর প্রান্তের দুটি মার্কেটেও ছড়ায়। এই কয়েকটি মার্কেট মিলিয়ে ৫ হাজারের মতো দোকান রয়েছে; তারও অধিকাংশ পুড়েছে।

ভয়াবহ এই আগুন বঙ্গবাজারের পূর্ব পাশের পুলিশ সদর দপ্তরের সীমানাও ছাড়ায়। সেখানে পাঁচ তলা একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয় আগুনে, সেই ভবনে ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ পুড়েছে। ওই ভবনের পাশের পুলিশ ব্যারাকও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার এক পর্যায়ে জাতীয় জরুরি সেবা নাম্বার ৯৯৯ এর সেবা কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। তা সচল হয় নয় ঘণ্টা পর।

Also Read: বঙ্গবাজারে আগুন: ৯ ঘণ্টা পর সেবায় ফিরল ৯৯৯

Also Read: বঙ্গবাজারে আগুন: পুলিশ সদর দপ্তরে পুড়েছে ডিএমপির নিয়ন্ত্রণ কক্ষ

সকাল ৬টায় আগুনের সূত্রপাত হওয়ার পর বাতাস থাকায় দ্রুতই তা ছড়িয়ে পড়ে। একে একে আগুন নেভাতে যোগ দেয় ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিট। বিমান বাহিনী ও সেনাবাহিনীও যোগ দেয় সেই কাজে, ছিল পুলিশ, র‌্যাব, আনসারও। পানি আনতে নামে হেলিকপ্টারও।

সাড়ে ৬ ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার ঘোষণা দিলেও তারপরও বিভিন্ন স্থানে শিখা দেখা যাচ্ছিল। এমনকি রাতেও দুটি স্থানে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে, তা নেভাতে কাজ করছিলেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।

আগুন নিভতে দেরি দেখে এক পর্যায়ে জনতা ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরেও হামলা চালায়। বঙ্গবাজারের দক্ষিণ পাশের সড়কের ঠিক উল্টো পাশেই এই বাহিনীর সদর দপ্তর।

এই হামলার কারণে আগুন নেভানোর কাজ বিঘ্নিত হয় বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। সেই সঙ্গে দূর থেকে পানি আনা, মার্কেটের বিভিন্ন পাশ তালাবদ্ধ থাকা, চলাচলের পথ উন্মুক্ত না থাকাকে আগুন নেভাতে দেরির কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।

অগ্নিকাণ্ডে বিপুল সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হলেও কারও প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি। তবে আগুন নেভাতে গিয়ে ও হামলায় আটজন আহত হওয়ার খবর দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

কীভাবে এই আগুন লাগল, সে বিষয়ে কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস।

অগ্নিকাণ্ডে ৫ হাজারের মতো ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে একটি হিসাব দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের উঠে দাঁড়াতে ৭০০ কোটি টাকা প্রয়োজন বলে দাবি করেছেন।

অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে আট সদস্যের কমিটি করেছে ডিএসসিসি। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের আশ্বাস দিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান।

এই অগ্নিকাণ্ডে ব্যবসায়ীদের বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহমর্মিতা জানিয়েছেন। আগুনের বিষয়ে ভবিষ্যতে সবাইকে সতর্ক থাকার অনুরোধ তিনি করেছেন বলে জানান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

তিন যুগ পুরনো বঙ্গবাজার মার্কেট ১৯৯৪ সালে এক অগ্নিকাণ্ডে ছাই হয়ে গিয়েছিল। তারপর নতুন করে গড়ে উঠেছিল এই মার্কেট, তিন দশক পর আবার একই পরিণতি ঘটল।

এমন আগুন আগে ‘দেখেননি’ আলাউদ্দিন

গুলিস্তানে টিনশেডের একটি দোকান ছিল মো. আলাউদ্দিনের। এরশাদ আমলে তাদের সেখান থেকে তুলে বঙ্গবাজারে দোকানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। এরপর থেকে বঙ্গবাজারে পাঞ্জাবির দুটি দোকান রয়েছে তার।

প্রবীণ এ ব্যবসায়ী বলেন, “ওই সময় আমি দুইটা দোকান পাই। কিন্তু অভাব-অনটনে পড়ে বিক্রি করে দিই। পরে কিছুটা স্বাবলম্বী হলে দুটি দোকান ভাড়া নিয়ে আবার ব্যবসা শুরু করি।”

১৯৯৪ সালের আগুনেও তার দোকান পুড়েছিল, তবে এবারের আগুন তার চেয়ে ভয়াবহ ঠেকেছে তার কাছে।

আলাউদ্দিন বলেন, “এমন আগুন আমি জীবনে দেখিনি। সব ছাই হয়ে যাবে, কিছুই রক্ষা পাবে না, এটা এবারই চোখের সামনে দেখলাম।”

রোজার মধ্যে সেহরির পর দোকানপাট খোলার তোড়জোড় একটু দেরিতেই শুরু হয়। তার মধ্যে সকাল ৬টা ১০ মিনিটে বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়।

রাস্তার ওপারে যেহেতু ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তর, তাই মিনিট দুইয়ের মধ্যে আগুন নেভাতে ছুটে আসে অগ্নি নির্বাপক বাহিনীর একটি গাড়ি। তবে বাতাসের মধ্যে ঘিঞ্জি ওই মার্কেটে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ধাপে ধাপে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, কেরাণীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের মোট ২২টি ফায়ার স্টেশন থেকে ৪৮টি গাড়ি বঙ্গবাজারের আগুন নেভাতে যোগ দেয়। এরমধ্যে সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব-পুলিশ, আনসার বাহিনীর সদস্যরাও যোগ দেয় অগ্নি নির্বাপন ও উদ্ধার তৎপরতায়।

সাড়ে ছয় ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার কথা যখন বলা হয়, ততক্ষণে কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরি তিন তলা বঙ্গবাজার মার্কেট, আদর্শ মার্কেট ও গুলিস্তান মার্কেট পুরোপুরি ভষ্মীভূত। আগুন জ্বলার মধ্যে এই মার্কেটগুলোর বিভিন্ন দোকানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রগুলো বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হচ্ছিল, তাতে আগুন আরও বাড়ছিল।

মহানগর শপিং কমপ্লেক্সর সামনের অংশ দাঁড়িয়ে থাকলেও পেছনের অংশ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তবে দালান হওয়ায় আগুন জ্বলতে সময় লাগে এনেক্সকো টাওয়ার ও বরিশাল প্লাজায়। সেখানকার বিভিন্ন দোকানে থাকা মালামালের অনেকখানি রক্ষা করা যায়।

আগুন নেভানো ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অংশ নেয় সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের দুই হাজার সদস্য অংশ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।

যা ছিল জীবিকা, তা এখন কয়লা

রোজার ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে পাইকারি ক্রেতাদের কাছে পণ্য বুঝিয়ে দেওয়ার চাপও বাড়ছিল বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের। নতুন মালামাল তুলতে ব্যাংক, স্থানীয় সমিতি ও পরিচিতদের কাছ থেকে অর্থ ধার করে ব্যবসায় লগ্নি করেছিলেন অনেকে। আগুনে জীবিকার সেই সম্বল পুড়ে কয়লা হওয়ার কথাই বলছিলেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা।

২৬ বছর ধরে বঙ্গবাজারে দোকান চালান লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জের মিজানুর রহমান। তার টিশার্ট ও গেঞ্জির সাতটি দোকানে ১৫ জন কর্মচারী কাজ করতেন।

ঈদ উপলক্ষে ঋণ নিয়ে দোকানে মালামাল তুলেছিলেন মিজানুর। আগুন লাগার পর সেসব মালামালের কিছুই উদ্ধার করতে পারেননি বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান তিনি।

“দুই কোটি টাকা ঋণ নিয়েছি ব্যাংক ও স্বজনদের কাছ থেকে ঈদ উপলক্ষে মালামাল তুলতে। সাত দোকানে ৮-১০ কোটি টাকার মালামাল ছিল। কিন্তু এক সুতাও উদ্ধার করতে পারিনি।”

ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে দুই দশক ধরে সেখানে ব্যবসা করা শামীম আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘রাতেও বাসায় যখন যাই তখন এইহানে মার্কেট ছিল। এহন দ্যাহেন সব পুইড়া কয়লা হইছে।”

ফজরের নামাজ শেষে ঘুমিয়েছিলেন ব্যবসায়ী মাসুদ আলী, সকাল ৬টার দিকে যখন বঙ্গবাজারে আগুন লাগার খবর পান, কাছের নাজিরা বাজারের বাসা থেকে দৌড়ে গিয়ে দেখেন গোটা মার্কেট জ্বলছে।

মহানগর মার্কেটের মালিহা ফ্যাশন কর্নারের মালিক নজরুল ইসলাম জানান, তার দোকানে দেশি-বিদেশি জিন্সের ব্যাপক সমাহার ছিল। কিন্তু এখন সব পুড়ে ছাই।

বঙ্গবাজার এলাকায় এক দশক ধরে ব্যবসা করছেন ইকবাল হোসেন। তার চারটি দোকানে মেয়েদের লেহেঙ্গা, থ্রি পিসের বড় চালান ছিল।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর তিনি জানান, এনেক্সকো টাওয়ারের তিন তলা থেকে মামলামালগুলো বের করতে পারলেও আন্ডারগ্রাউন্ডের গুদাম থেকে কিছুই বের করতে পারেননি। পানিতে তার থ্রি পিসগুলো ভিজে একাকার হয়ে গেছে।

কাঠ ও টিনের তৈরি মার্কেটের আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসার পরই এনেক্সকো মার্কেটে ঢুকতে শুরু করেন ব্যবসায়ী ও দোকানের কর্মচারীরা।

দ্রুত পণ্য নামাতে তিন, চার ও পাঁচ তলা থেকে পণ্য প্লাস্টিকের বস্তায় বোঝাই করে রাস্তার উপর ফেলে রক্ষা করেন অনেকে।

বঙ্গবাজারে দোকানের মালামাল সরাতে না পারলেও এনেক্সকো ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকা দোকান থেকে মেয়েদের পোশাকের প্রায় সবটুকুই বের করে আনতে পারার কথা জানান ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন।

সেই মালামাল সাদা রঙ্গের প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে নাম লেখার সময়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কিছু তো বাঁচাইতে পারছি। কিছু আগুন নেভানোর পানিতে নষ্টও হইবো। এহন দোকান পামু কি না সেই চিন্তাও আছে।”

টি-শার্ট ও ট্রাউজারসহ ওভেন পণ্য বিক্রি করেন মহানগর শপিং কমপ্লেক্সের ব্যবসায়ী সোলায়মান হোসেন।

তিনি বলেন, “নাজিরা বাজারে বাসা থাকায় দ্রুত আসি দোকানে। আরেকটু হইলে কোনো মালামালই পাইতাম না। শপিং কমপ্লেক্সের সামনের দিকে দোকান থাকায় আগুন ও পানি যাওয়ার আগেই সব মাল বের করছি। এহন মিলাইয়া দেখবো হারাইছেনি কিছু।”

এনেক্সকো টাওয়ার ও মহানগর শপিং কমপ্লেক্স থেকে মালামাল বের করে বস্তায় ভরে মার্কার কলম দিয়ে প্রতিষ্ঠানের নাম লিখতে দেখা গেছে মালিহা ফ্যাশন কর্নারের আরেক মালিক সাইফুল ইসলামকেও।

উৎকণ্ঠায় হাজারো কর্মচারী

বঙ্গবাজারে টিন ও কাঠের তৈরি মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় দুই সাটারের একটি দোকান ছিল ব্যবসায়ী খালিদ হোসেনের। গত ১০ বছর থেকে পাইকারি পর্যায়ে জিনসের প্যান্ট বিক্রি করা দোকানটিতে কর্মচারী হিসেবে দুই বছর ধরে কাজ করছেন মোর্শেদ আলম ও হাবিব সরকার।

মোর্শেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঈদের পরের দিন বাড়ি যাওয়ার কথা বেতন ও বোনাসের বাকি টাকা নিয়ে। মালিক কিছু টাকা ঈদের কয়েকদিন আগে দিয়ে দেন। বাকি টাকাটা আমি পরে নিয়ে বাড়ি যাই। এহন বোনাস তো দূরের কথা বেতনই চাইতে পারবো না। দোকান নাই, চাকরির কী হবে কী জানি?

আরেক দোকানকর্মী লিটন মিয়া বলেন, ঈদের দুই তিন দিন আগেই বেতন-বোনাস পেয়ে বাড়ি চলে যাই। কিন্তু এবার কি হবে বুঝতে পারছি না।

বঙ্গবাজারের এ মার্কেটগুলোতে এরকম চাকরীজীবীর সংখ্যার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলেও ব্যবসায়ীরা বলছেন, হাজার চল্লিশের মতো হবেই।

এই বিশাল সংখ্যক কর্মচারীদের চাকরি ও আগামী ঈদ কেমন হবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা এখন থেকেই শুরু হয়েছে।

আঁচ লাগবে অন্য খানেও

সারা দেশের জিনস্‌, থ্রি পিচ, শাড়ি, ট্রাউজার, টি-শার্ট ও মেয়েদের পোশাকের পাইকারি মার্কেট বঙ্গবাজার। কম্বল, মশারি, লুঙ্গি, গামছাসহ বাহারি রকমের প্রায় সব পণ্যই তুলনামূলক কম দরে পাওয়া যায় এ বাজারে।

তুলনামূলক সস্তা দরে বিক্রি হওয়ায় দেশের দূর-দূরান্ত থেকে পাইকার ও খুচরা ক্রেতারা এ মার্কেটে ভিড় জমান সকাল থেকেই।

এখন পণ্য না পেয়ে এর প্রভাব রাজধানীর অন্যান্য বাজারের পাশাপাশি এলাকার বিপণী বিতানেও পড়বে বলে মনে করেন ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম।

মহানগর শপিং কমপ্লেক্সে তার দুটি দোকান পুড়ে শেষ হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এখানে তো শুধু দোকান। গোডাউন ছিল আদর্শতে (আদর্শ মার্কেটে)। কালকেও (সোমবার) মাল তুলেছি গোডাউনে। বরিশাল, নবাবগঞ্জ, পাবনা, ঈশ্বরদী, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, মাদারীপুর ও রাজবাড়ী থেকে পাইকার আসেন আমার দোকানে … সব মালামাল পুইড়া গেল।”

কম দরে তৈরি পোশাকের স্টক লটের মালামাল পাওয়া যাওয়ায় বলে রাজধানীর এ মার্কেটে বিদেশিরাও ঢু মারেন। বিদেশি ক্রেতার কাছে পণ্য বিক্রির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এ মার্কেট ঘিরেই অনেক দোভাষি আয়ের সুযোগ করেছেন। এখন তারাও পড়বেন বিপাকে।

আগে থেকেই ছিল ‘ঝুঁকিপূর্ণ’

বঙ্গবাজারের এই মার্কেটটি অগ্নি নিরাপত্তার দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার মইন উদ্দিন।

তিনি বলেন, “২০১৯ সালে বঙ্গমার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ বলে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে নোটিস টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপরেও তারা ব্যবসা চালিয়ে আসছিল। অন্য কোনো সংস্থা বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি।”

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, ২০১৯ সালে তারাও মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করলেও বঙ্গবাজার মার্কেট সমিতি হাই কোর্টে রিট আবেদন করে। তখন আদালত নতুন ভবন নির্মাণে স্থগিতাদেশ দেয়।

ব্যবসায়ীরা জানান, ১৯৮৮ সালের দিকে গুলিস্তানের অন্যান্য এলাকা থেকে পুনর্বাসনের অংশ হিসাবে বঙ্গবাজার এলাকায় পোশাক পণ্যের বিকিকিনি শুরু হয়। ১৯৯৪ সালে এই বঙ্গবাজারে একবার আগুনে ভস্মীভূত হয়েছিল।

এরপর ব্যবসা ও ব্যবসায়ী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে কাঠ ও টিনের অবকাঠামোগুলো ঘিঞ্জি ও অপরিকল্পিতভাবে একতলা দুই তলা করে বাড়তে থাকে। কিছু কিছু স্থানে তিন তলা কাঠের অবকাঠামোও দেখা যাচ্ছিল। এরমধ্যে টিনশেড ভেঙে কয়েকটি বহুতল ভবনও গড়ে ওঠে।

বঙ্গবাজার কীভাবে পরিচালিত হত- জানতে চাইলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, “এটা একেকটা একেকভাবে পরিচালিত হতো। সম্ভবত সিটি করপোরেশনের অধীনস্ত ছিল মার্কেটগুলো। আবার ব্যবসায়ী সমিতিগুলোও এখানে একটা কর্তৃপক্ষের ভূমিকায় ছিল। তবে এবিষয়ে আমিও স্পষ্ট না।”

হামলা-ভাংচুর

সকালের দিকে বিক্ষুব্ধ জনতার একাংশ পাশে ফায়ার সার্ভিস কার্যালয়ে হামলা চালাতে গেলে সংঘর্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, প্রথমে কিছু লোক পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে। একটু পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি বাড়লে পাল্টা মারধরে পিছু হটে বিক্ষুব্ধরা।

হামলাকারীদের ঢিলের আঘাতে ফায়ার সার্ভিস হেড কোয়ার্টারের ভবনের বেশকিছু কাচ ভেঙে যায়।

ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানান হয়, তাদের ১১টি গাড়ি এবং অধিদপ্তরের ভেতরে ইআরসিসি ভবন ও রিসিপশন ভবন ভাঙচুর এবং কর্মীদের মারধর করা হয়।

বাহিনীর মহাপরিচালক মাইন উদ্দিন ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, “আমাদের কর্মীরা তো নিজের জীবন দিয়ে আপনাদের রক্ষা করেন, তাদেরই কেন আঘাত করা হল? কারা আঘাত করল? এই উচ্ছৃঙ্খল লোকজন কারা? কেন তারা এমন আচরণ করল? আমাদের যেসব গাড়ি জাতীয় সম্পদ ও মূল্যবান জীবন রক্ষা করে, সেইসব গাড়ি কি উদ্দেশ্যে ভাঙচুর করা হল?”

তিনি জানান, তাদের মোট ৬৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী আগুন নিয়ন্ত্রণে অংশ নিয়েছিল। আগুন নেভাতে গিয়ে বিকাল নাগাদ ফায়ার সার্ভিসের ৮ জন আহত হয়েছেন, যারা ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন।

আগুন নেভাতে দেরির কারণ নিয়ে ফায়ার সার্ভিস মহাপরিচালক বলেন, “এখানে অনেক বাতাস, যার জন্য অনেক সময় লাগছে। জনগণের বাধার কারণে আগুন নেভানোর কাজে বিঘ্ন ঘটেছে।”

এদিকে দুপুরে অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত বঙ্গবাজার মার্কেট পরিদর্শনে গিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, বঙ্গবাজারের আগুন উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে নাশকতার অংশ হিসেবে লাগানো হয়েছে কি না, জনমনে এটা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

“ফায়ার সার্ভিসের লোক যখন আগুন নেভাতে যাচ্ছে, পুলিশ যখন মানুষকে হেল্প করতে যাচ্ছে, তখন তাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। এটা খুব অস্বাভাবিক একটা বিষয়। বিষয়টিকে তদন্ত করা হবে এবং খতিয়ে দেখা হবে। এখানে নাশকতার কোনো উদ্দেশ্য ছিল কি না, সেটিও খতিয়ে দেখে যা যা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।”

তদন্ত কমিটি, পুনর্বাসনের আশ্বাস

আগুন কীভাবে লাগল- জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলেন, “এ বিষয়টি এখন বলা সম্ভব নয়। এই ঘটনায় পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। প্রতিবেদন পাওয়ার পরে আগুন লাগার কারণ জানা যাবে।”

পাঁচ সদস্যের কমিটি করেছে ফায়ার সার্ভিস। কমিটিকে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।

বাহিনীর পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেনেন্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে সভাপতি করে গঠিত এই কমিটিতে সদস্য সচিব করা হয়েছে ঢাকা জোন-১ ঢাকার উপসহকারী পরিচালক মো. বজলুর রশিদকে।

কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- বাহিনীর ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক দিনমনি শর্মা, সিদ্দিকবাজার ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. শাহিন আলম এবং ওয়ারহাউজ ইন্সপেক্টর অধীর চন্দ্র।

অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করতে আট সদস্যের কমিটি করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। প্রতিবেদন দিতে তাদের সময় দেওয়া হয়েছে তিন দিন।

ডিএসসিসির অঞ্চল-১ এর নির্বাহী কর্মকর্তাকে আহ্বায়ক করে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, ৫ নম্বর সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা, সম্পত্তি কর্মকর্তা, ঢাকা জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি, ডিএসসিসির পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এবং প্রধান সমাজ কল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের আশ্বাস দিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবসায়ীদের ক্ষতি নির্ধারণ করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।”

  • প্রতিবেদন তৈরিতে যুক্ত ছিলেন: মর্তুজা হায়দার লিটন, কামাল তালুকদার, শেখ আবু তালেব, ফয়সাল আতিক, কাজী মোবারক হোসেন, গোলাম মর্তুজা অন্তু