“মানুষের হাতেও টেকা নাই। এই সময়েই আমাগো কপালডা পুড়ল, মার্কেটে আগুন লাগল। এহন অপেক্ষা করন ছাড়া আর কোনো গতি নাই”, বলেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী মো. বাহার।
Published : 04 Apr 2024, 08:19 AM
বঙ্গবাজারে শাড়ির দোকানটি পুড়ে যাওয়ার পর পাশের এনেক্সকো টাওয়ারে দোকান নিয়ে ধার-দেনা করে ব্যবসা শুরু করেছিলেন মো. রিপন। কিন্তু সেখানে বেচা-কেনা একেবারেই কম।
জীবন চালানোর মত টাকা জোগাড় করতেই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে জানিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, আগুন লাগার পর ক্ষতিপূরণ বা অনুদান দিতে যে তহবিল গঠনের কথা শুনেছিলেন তার একটি পয়সাও এখন পর্যন্ত পাননি।
তবে ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ১৫ কোটি এবং বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পাওয়া আরো ছয় কোটি টাকা অচিরেই ব্যবসায়ীদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। পাশাপাশি ঈদের পরেই পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজারের জায়গায় শুরু হবে বহুতল মার্কেট তৈরির কাজ। এ জন্য ঠিকাদারও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এই মার্কেটে শুধু বঙ্গবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে তালিকাভুক্ত ২ হাজার ৯৬১ জন ব্যবসায়ীকেই দোকান বরাদ্দ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
গত বছরের ৪ এপ্রিল রোজার মধ্যে আগুন লেগে ভষ্মীভূত হয় বঙ্গবাজারে। সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের একাংশ চৌকি পেতে বসছেন। ঈদের পর সেখানে ভবন নির্মাণ শুরু হলে তাদের অন্য কোথাও দোকান দেখতে হবে।
আগুনে পুড়ে ক্ষতি কেবল নয়, গত একটি বছর স্বাভাবিক অর্থপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কেউ খাচ্ছেন সঞ্চয় ভেঙে, কেউ চলছেন ধার দেনা করে। যদি অনুদানের টাকাটা ছাড় করা যেত, তাহলে কিছুটা হলেও নিস্তার মিলত, ভাষ্য তাদের।
বঙ্গবাজার দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম বলছেন, “ঈদের আগেই এই টাকাটা ছাড় হওয়ার কথা। এই ২১ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় তিন হাজার ব্যবসায়ীর মাঝে বণ্টন করে দেওয়া হবে।
“আমরা নিশ্চিত করছি যে এই বণ্টন আমরা করব না। এটা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ঢাকা দক্ষিণের মেয়র করবেন বলে আমাদের জানানো হয়েছে।”
তবে যে অর্থ পাওয়া যাবে, তা তাদের ক্ষতির তুলনায় নগণ্য। গড়ে একেকজনের ভাগে ৮০ হাজার টাকাও পড়বে না।
ব্যবসায়ী নেতা জহিরুল বলছেন, বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়ার পর আশপাশের মার্কেটগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের দোকান নিয়ে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
“বঙ্গবাজারে যার চারটা দোকান ছিল তিনি এখন একটা দোকান পেয়েছেন।”
এখন যারা বঙ্গবাজারে চৌকি পেতে বসেছেন তারা সবাই তালিকাভুক্ত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী নন বলেও জানান তিনি।
বলেন, “এদের তিনভাগের এক ভাগও তালিকাভুক্ত নয়। আমরা আগেই তালিকাভুক্ত ব্যবসায়ীদের আশপাশের বিভিন্ন মার্কেটে দোকান নিয়ে ব্যবসা করার ব্যবস্থা করেছি। যেমন: এনেক্সকো টাওয়ার, বরিশাল প্লাজা, নগর প্লাজা, সিটি প্লাজা, ফুলবাড়িয়া সুপার, জাকের প্লাজা, ঢাকা ট্রেড সেন্টার উত্তর ও দক্ষিণ মার্কেটে তারা দোকান নিয়ে ব্যবসা করছেন।”
‘তিন দিন ধইরা বিসমিল্লাও হয়নি’
বঙ্গবাজারে চৌকি পেতে বসা কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হল। তারা বলছেন, এই ঈদ মৌসুমেও বঙ্গবাজারে ক্রেতা নেই। এনেক্সকো টাওয়ারের চার, পাঁচ ও ছয়তলা জুড়ে বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন।
তারা জানাচ্ছেন বঙ্গবাজারে তারা যে স্বাভাবিক বেচাকেনা করতেন তার অর্ধেকও এখানে নেই। পুঁজি হারিয়ে ধার-দেনা করে নতুন দোকান করলেও সেখান থেকে খেয়ে পরে বেঁচে থাকাই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এনেক্সকো টাওয়ারের শাড়ি বাজারের মো. রবিন বলছেন, “আগে বঙ্গবাজারে ১০০র বেশি ড্রেসের আইটেম পাওয়া যাইত। এখানে আমাদের আইটেম নাইমা আসছে আট থেকে ১০টাতে। নতুন মার্কেটে কাস্টমার কম। খালি যেন পেটে-ভাতে চলতে পারি এখন সেই চেষ্টা কইরা যাচ্ছি। সেলের গ্রাফ যদি ধরেন সেটা একেবারে নিম্নমুখী।”
এনেক্সকো টাওয়ারের এই তলায় মূলত শাড়ির পাইকারি ও খুচরা দোকান। ঈদের আগে দামি, কম দামি- সব ধরনের শাড়িই পাইকারি বিক্রি হয় সেখানে। এবার সেটাও হয়নি বলে জানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
বিয়ের মৌসুমে এখানে বিয়ের শাড়ি, লেহেঙ্গার বেচা-বিক্রি বাড়ে। এবার সেটাও কম হয়েছে বলে জানালেন তারা।
বঙ্গবাজারে ‘কপাল পুড়েছে’ জানিয়ে ব্যবসায়ী মো. রিপন বলছেন, আত্মীয়-স্বজনের কাছ ধারদেনা আর পুরনো মহাজনদের কাছ থেকে মাল এনে দোকান সাজিয়েছেন। কিন্তু নতুন মার্কেটে ক্রেতা নেই।
বঙ্গবাজারে যে বিক্রি হতো তার অর্ধেকও নেই এখানে। তার ভাষায়, “পুঁজিও গেছে, কাস্টমারও গেছে।”
সরকার, ব্যাংক বা অন্য কোনো জায়গা থেকে সহযোগিতা পেয়েছেন কি না- এই প্রশ্নে রিপন বলেন, “একটা টাকাও পাইনি সরকারের কাছ থেকে। আর আমরা ব্যাংকেও যাই নাই। নিজেগো আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে যা পাইছি তাই দিয়া ব্যবসা চালাইতাছি।”
একই কথা বলছেন আজমির এন্টারপ্রাইজের মো. বাহারও। বঙ্গবাজারে তার শাড়ির দোকান পুড়ে যাওয়ার পর ধারদেনা করে এনেক্সকো মার্কেটে দোকান শুরু করেছেন।
বঙ্গবাজারে যে পরিমাণ বেচা-বিক্রি হত তার অর্ধেকও নাই এই মার্কেটে জানিয়ে তিনি বলছেন, “বইসা বইসা খালি লস খাইতাছি।”
তার হিসাব, প্রতিমাসে দোকান ভাড়া দিতে হয় ৩৫ হাজার টাকা। একজন কর্মচারীও রাখতে হয়েছে। সব মিলিয়ে দোকান চালাতে মাসে খরচ হয় প্রায় এক লাখ টাকার মত। কিন্তু মাস শেষে এই টাকাই ওঠে না।
“মার্কেটে কাস্টমার নাই। ঈদের বাজার, কিন্তু কোনো কাস্টমার নাই”, বলেন তিনি।
এখানে তো দামি দামি শাড়ি বেশি, সেটার তো আলাদা মৌসুম আছে। সে কারণে ক্রেতা কম কি না- এই প্রশ্নে বাহার বলছেন, “এখানে এখন সব ধরনের জামা, থ্রি-পিস, শাড়িসহ মেয়েদের কাপড় পাওয়া যায়। কিন্তু কাস্টমার নাই।
“দুপুরে সবাই ঝিমাইতাছে, ইফতারের পর দোকান বন্ধ কইরা বাড়িত যাইব গা। ঈদের মৌসুমে কী পরিস্থিতি থাকলে সন্ধ্যাবেলায় দোকান বন্ধ করতে হয় এলা সেটা আপনি বিবেচনা করেন।”
ঈদের আগের সপ্তাহে ক্রেতাশূন্য মার্কেট
মঙ্গলবার দুপুরে যখন তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল তখন পুরো এনেক্সকো মার্কেট যাকে বলে একেবারেই ক্রেতাশূন্য। সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় প্রতি দোকান থেকেই কর্মীরা জানতে চাইছিলেন ‘কী লাগবে ভাই?’।
কোনো কিছু না কিনলেও একবার পরখ করুন- যেন এমন আকুতি তাদের।
অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী মো. বাহার বলছেন, “হ্যারা কী করব। আইজ তিনদিন হইল, আমার কোনো বেচাবিক্রি নাই। একেবারে বিসমিল্লাটা পর্যন্ত করবার পারি নাই এই সপ্তাহে। বইয়া বইয়া মাছি মারি আর লস খাই।”
ব্যবসা নিয়ে কী পরিকল্পনা?- বাহার বলেন, “আর তো কিছু শিখি নাই ভাই। চাইলেই তো আর ব্যবসা ছাইড়া যাওন যায় না। এহন দ্যাশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ, মানুষের হাতেও টেকা নাই। এই সময়েই আমাগো কপালডা পুড়ল, মার্কেটে আগুন লাগল। এহন অপেক্ষা করন ছাড়া আর কোনো গতি নাই।”
ব্যাংকের কাছে গিয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “না ব্যাংকের কাছে যাইনি। এই দোকানে এহন যদি আপনি ৫০ লাখ টাকার মাল ঢুকান হুদাই বইসা বইসা লস খাইবেন। বিক্রি না থাকলে টাকা লাগাইয়া কী করুম?”
এনেক্সকো টাওয়ারের ব্যবসায়ীদের চেয়ে অবশ্য চৌকি পেতে বসা ব্যবসায়ীদের ব্যবসা তুলনামূলক ভালো যাচ্ছে। তবে ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হলেই উঠে যেতে হবে তাদের।
সেখানকার বিক্রেতা শফিকুর রহমান জানালেন, তিনি ফুলবাড়িয়া সুপারে দোকান নিশ্চিত করেছেন। এখানে যতদিন চৌকি পেতে বেচা যায়, ততদিন করবেন। কারণ, ‘দোতলা-তিনতলা মার্কেটের চেয়ে এখানে ব্যবসা ভালো।’
তিনি বলছেন, “এইহানে নতুন মার্কেটে আমাগো দোকান দিব কইছে। সেই মার্কেট কবে তৈরি শেষ হইব, সেইটা চলব কি না কত চিন্তা আমাগো। তাও মার্কেটে নিজের একটা দোকান হইব এই আশায় ব্যবসা চালাইয়া যাইতাছে অনেক ব্যবসায়ী।”
নতুন ভবন, নতুন স্বপ্ন
ব্যবসায়ী নেতা জহিরুল বলেন, “এই ঈদের পর বঙ্গবাজারের জায়গায় বহুতল মার্কেট করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নিজে এসে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন বলে আমরা আশা করছি।”
ঈদের পরেই এখানে কাজ শুরু করার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রীও। দ্রুত যাতে কাজ হয় সেজন্য অভিজ্ঞ ঠিকাদার তমা কন্সট্রাকশন্সকে ভবন নির্মাণের কাজ দেওয়া হয়েছে।
ওই জায়গাটির মালিক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সংস্থাটির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাসের জানান, ওই ভবনের নাম হবে ‘বঙ্গবাজার পাইকারি নগর বিপনি বিতান’।
১০৬ দশমিক ২৮ শতাংশ জমিতে ১০ তলা ভবনটি চারটি ব্লকে ভাগ করার পরিকল্পনা রয়েছে নগর কর্তৃপক্ষের।
পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেট, গুলিস্তান হকার্স মার্কেট, মহানগর হকার্স মার্কেট এবং আদর্শ হকার্স মার্কেটের ব্যবসায়ীদের মধ্যে বরাদ্দ করা হবে এসব দোকান।
পুড়ে যাওয়ার আগে এই চারটি মার্কেটে ২ হাজার ৯৬১টি দোকান ছিল। নতুন করে বানানো ভবনে দোকানের সংখ্যা হবে ৩ হাজার ২১৩টি, অর্থাৎ আগের চেয়ে ২৪৪টি বেশি।
এই মার্কেটে সবচেয়ে বেশি দোকান পাবেন বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেটের ব্যবসায়ীরা, ৯৪৫টি। গুলিস্তান হকার্স মার্কেট ৮৭৯টি, মহানগর হকার্স মার্কেট ৬৬০টি এবং আদর্শ হকার্স মার্কেট ৭২১টি দোকান বরাদ্দ পাবে।
ভবনের প্রথম তলায় নিচতলায় ৩৫৯টি দোকান থাকবে। দ্বিতীয় তলায় ৩৭৬টি, তৃতীয় তলায় ৩৮৬টি, চতুর্থ তলায় ৩৯৫টি, পঞ্চম তলায় ৩৯৩টি, ষষ্ঠ তলায় ৩৯৫টি, সপ্তম তলায় ৩০৫টি, অষ্টম তলায় ৩০৬টি এবং নবম তলায় ২৯৮টি দোকান করা হবে।
প্রথম তলা বাদে বাকি ফ্লোরগুলোতে একটি করে খাবারের দোকান রাখা হয়েছে।
আরো পড়ুন:
ঈদের স্বপ্ন ছাই করে দিল বঙ্গবাজারের আগুন