জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে বিভিন্ন প্রকাশনীর ১৩০টি বই সংগ্রহ করার তথ্য দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্টলের সংশ্লিষ্টরা।
Published : 27 Feb 2025, 12:53 AM
গবেষণাধর্মী কিছু বই কিনবেন বলে তালিকা নিয়ে বইমেলায় এসেছেন লন্ডন প্রবাসী ইলিয়াস আহমেদ। তবে মেলাপ্রাঙ্গণে ঢুকে কাঙ্খিত প্রকাশনীর স্টল পেতে কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে তাকে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, মেলায় স্টলগুলোর সারির মুখেই দিক নির্দেশনা থাকা দরকার ছিল। কোনো কোনো স্টলে নম্বরটিও ঠিকমত দেখা যায় না। এতে প্রকাশনীর স্টল খুঁজে পেতে ঝামেলা হয়।
একটু কষ্ট হলেও ঘুরে ঘুরে স্টল খুঁজে কাঙ্খিত বইগুলো সংগ্রহ করেছেন তিনি।
বইমেলায় প্রতি বছর হাজারো নতুন বই প্রকাশ হলেও সেগুলোর ঠিকঠাক পরিসংখ্যান জানাতে পারে না মেলা পরিচালনা কমিটি।
এবারও মেলার তথ্যকেন্দ্র নতুন বইয়ের যে তালিকা দিয়েছে, তার চেয়ে তিনগুণ বেশি বই প্রকাশ হয়েছে বলে মনে করছেন বই বিপণনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
দেশের ১০টির বেশি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের পাশাপাশি অনলাইনে বই বিপণনের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজনের সঙ্গে আলাপের তথ্য বলছে মেলায় আসা বইয়ের মধ্যে রাজনৈতিক বইয়ের প্রতি আগ্রহ বেশি দেখা গেছে ক্রেতাদের।
এছাড়া গবেষণা বিষয়ক বই কম বিক্রি হলেও সারাবছরই চাহিদা থাকে।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক বইয়ের চাহিদা বেড়েছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। এ ধরনের বই বিক্রি নিয়ে সন্তুষ্টির কথা বলেছেন একাধিক প্রকাশনা সংস্থার বিক্রয়কর্মীরা।
বাতিঘর এর স্বত্ত্বাধিকারী দীপঙ্কর দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক বই নিয়ে পাঠকের আগ্রহ বেড়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই রাজনৈতিক বই ভালো বিক্রি হচ্ছে। উপন্যাস, গল্প, কবিতার বইয়ের বিক্রিও ভালো।
তার প্রতিষ্ঠান ২০২৪ সালের মার্চ থেকে চলতি ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আসা নতুন বইকে বইমেলার নতুন বই হিসেবে প্রচার ও বিক্রি করছে।
এ তালিকায় ৫ হাজারের বেশি নতুন বই যুক্ত থাকার তথ্য দিয়ে বাতিঘর ডটকমের ডিজিটাল এক্সিকিউটিভ মাহবুব সেতু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মেলা চলাকালীন সময়ে ইতিহাস, ঐতিহ্য বিষয়ক বইয়েরও চাহিদা দেখা গেছে।
জুলাই আন্দোলনের বই
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এবারের মেলার প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান: নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ’। গণআন্দোলনের স্মৃতি স্মরণে আছে ‘জুলাই চত্বর’।
বইমেলা সেজেছে লাল-কালো আর সাদা রঙে; ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আন্দোলন, শোক আর আশার প্রদীপ।
মেলায় এসেছে জুলাই আন্দোলন নিয়ে বেশ কিছু নতুন বইও।
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্টলে বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে ১৩০টি বই সংগ্রহ করার তথ্য দিয়েছেন স্টলটির সংশ্লিষ্টরা।
তবে বইমেলা জনসংযোগ বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার পর্যন্ত মেলায় গণ অভ্যুথান বিষয়ক নতুন বই এসেছে ৩৩টি।
প্রথমা প্রকাশন এনেছে ছয়টি বই। এর মধ্যে আছে অন্তর্বতী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের ‘শেখ হাসিনার পতনকাল’। সাজ্জাদ শরিফের সম্পাদনা গ্রন্থ ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সাক্ষ্য’, নজরুল ইসলামের ‘স্বৈরতন্ত্র প্রতিরোধের পথ’, মহিউদ্দীন আহমদের ‘আমিই রাষ্ট্র’, আলতাফ পারভেজের ‘লাল জুলাই: চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পথ পরিক্রমা’ ও আল মাসুদ হাসানউজ্জামানের ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান: নতুন পথে বাংলাদেশ’।
আদর্শ এনেছে আহম্মদ ফয়েজের বই ‘সংবাদপত্রে জুলাই অভ্যুত্থান’ ও সালাহ উদ্দিন শুভ্র’র উপন্যাস ‘আজাদি’।
জ্ঞানকোষ এনেছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ওপর তিনটি বই। এর মধ্যে আছে- আশীফ এন্তাজ রবির ‘ট্রেন টু ঢাকা’, মাসকাওয়াথ আহসানের ‘স্যাটারিক ভার্সেস ফ্যাসিবাদবিরোধী রম্য’ ও সিরাজুল ইসলাম এফসিএর ‘নতুন দিগন্তে জেগেছে ভোর’।
অনন্যা এনেছে জি এম রাজীব হোসেনের 'দ্রোহের গ্রাফিতি’। ঐতিহ্য এনেছে আহমদ আরমান সিদ্দিকীর ‘৩৬ জুলাই ২০২৪’, মুসা আল হাফিজের ‘অভ্যুত্থানের চিন্তাশিখা’, মঈন শেখের ‘জুলাইয়ের অশেষ পাখিরা’।
বাতিঘর প্রকাশনী এনেছে মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন সম্পাদিত ‘জুলাইর গল্প’।
গবেষণা, ইতিহাস-ঐহিত্য
বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এসেছে বেশ কিছু রাজনীতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গবেষণাধর্মী বই এনেছে।
এর মধ্যে ইউপিএল এনেছে জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের ‘পলিটিক্যাল পার্টিস ইন ইন্ডিয়া’র বাংলা অনুবাদ ‘ভারতের রাজনৈতিক দল’, সারোয়ার তুষারের ‘ফিলিস্তিন: একুশ শতকের উপনিবেশের ইতিহাস’, ফারুক আহমদের ‘সিলেটের ইতিহাস: ব্রিটিশ আমল’, দিব্যপ্রকাশ এনেছে সালেহ ফুয়াদের অনুবাদে বিবিসি রেডিও থ্রির বিশেষ ধারাবাহিক ‘স্বর্ণযুগের মুসলিম বিজ্ঞানী ও চিন্তক’।
ঐতিহ্য এনেছে এবাদুর রহমানের সম্পাদনায় ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা’। আদর্শ এনেছে ‘পাহাড়ের লাল আখ্যান’; যৌথভাবে লিখেছেন সুদত্ত বিকাশ তঞ্চঙ্গা, অনন্ত সিংহ ও অংচিং। একই প্রকাশনীতে রয়েছে মোহাম্মদ আজমের ‘সাংস্কৃতিক পুঁজি ও নতুন বাংলাদেশ’।
অনন্যা এনেছে মহিউদ্দিন আহমদের দুটি বই। ‘খালেদা’ এবং ‘জামায়াতে ইসলামী: উত্থান বিপর্যয় পুনরুত্থান’।
অবসর এনেছে প্রয়াত গবেষক গোলাম মুরশিদের অসমাপ্ত আত্মজীবনী ‘আত্মকথা ইতিকথা'।
বাতিঘর এনেছে বদরুদ্দীন উমরের ‘সাম্প্রদায়িকতা, সংস্কৃতির সংকট ও সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’।
কথাপ্রকাশ এনেছে রেজানুর রহমানের ‘নায়ক প্রতিনায়ক’, বেঙ্গল বুকস থেকে প্রকাশিত হয়েছে তরুণ সরকারের ‘ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন’। সাহিত্য প্রকাশ এনেছে রফিউর রাব্বির ‘নারায়ণগঞ্জের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য’।
চৈতন্য এনেছে মো. আশ্রাফুল করিমের ‘মাজারসংস্কৃতির বহুমাত্রিক প্রভাব’, বিধান রিবেরুর ‘ক্রফো: জীবন, সিনেমা, ভাবনা’। জাগৃতিতে রয়েছে সেলিম জাহানের ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’। সময় প্রকাশন এনেছে সৈয়দা আঁখি হকের গবেষণা ‘সৈয়দ শাহ নূর: জীবনপূথি ও নূর নছিয়ত’।
আগামী প্রকাশ করেছে এ কে শেরামের ‘বাংলাদেশের মনিপুরী: ত্রয়ী সংস্কৃতির ত্রিবেণিসংগমে’, ইসহাক সিদ্দিকীর ‘বাংলাদেশের দাসতন্ত্রের ইতিহাস’, মুস্তফা মাজিদ সম্পাদিত ‘গারো জাতিসত্তা’।
আর মাত্র দুই দিন
বুধবার বইমেলার ২৬তম দিনে ১৬৬টি নতুন বই আনার তথ্য দিয়েছে মেলা পরিচালনা কমিটি।
এদিন মেলায় এসেছিলেন সাহিত্যিক রাজু আলাউদ্দিন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, এবারের মেলায় তার চারটি বই এসেছে, এর মধ্যে দুটি বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ, আর অন্য দুটি নতুন বই।
তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে আছে- 'মেক্সিকান মনীষা' (দ্বিতীয় সংস্করণ), বের হয়েছে বেঙ্গলবুকস থেকে; আরেকটি 'লাতিন আমেরিকার মন ও মনন' ( দ্বিতীয় সংস্করণ) বেরিয়েছে বাংলাপ্রকাশ থেকে।
এছাড়া নতুন বই 'পাঠের পরাগায়ন' (লাতিন আমেরিকা বিষয়ক প্রবন্ধের সংকলন) বের হয়েছে কথাপ্রকাশ থেকে। পাঞ্জেরী পাবলিকেশনস থেকে বৃহস্পতিবার মেলায় আসবে 'লক্ষ্যে উপলক্ষ্যে' বইটি। বইটি মূলত সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, রাজনীতি ও প্রযুক্তি বিষয়ে প্রবন্ধের সংকলন।
আলোচনা, গান ও কবিতা
বুধবার লেখক বলছি মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন
শিশুসাহিত্যিক ফরিদ সাঈদ ও কবি এবিএম সোহেল রশীদ।
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘জুলাই প্রজন্ম ও প্রযুক্তি: নতুন সামাজিক বন্দোবস্তের খোঁজে’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সামিনা লুৎফা নিত্রা। আলোচনায় অংশ নেন কল্লোল মোস্তফা ও এহ্সান মাহমুদ। সভাপতিত্ব করেন ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।
সাংস্কৃতিক পর্বে কবিতা পাঠ করেন শ্যামল জাকারিয়া, মানব সুরত, এ বি এম সোহেল রশীদ, ইউসুফ রেজা, রোকন জহুর, জামিল জাহাঙ্গীর, ক্যামেলিয়া আহমেদ, আশিক আকবর, নুরতার পারভীন, জেসমিন বন্যা, সোহেল আমিন বাবু, রুহুল মাহবুব, মঈন মুরসালীন ও শাহ সিদ্দিক।
সংগীত পরিবেশন করেন ইয়াসমিন মুশতারী, পুতুল দাস, এলবার্ট অনিমেষ দাস, শুক্লা ঘোষ, রুমী আজনবী, বিপুল কুমার, মৌমিতা হক সেঁজুতি, তমালিকা হালদার মলি, জান্নাত-ই-ফেরদৌসী ও দিপু সমদ্দার।
যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন কাজী মো. ইমতিয়াজ সুলতান (তবলা), গাজী আবদুল হাকিম (বাঁশি), রবিনস্ চৌধুরী (কি বোর্ড), ফিরোজ খান (সেতার), বিশ্বজিৎ সেন (মন্দিরা)।
বৃহস্পতিবার যা থাকছে
বৃহস্পতিবার ২৭তম দিনে যথারীতি মেলা শুরু হবে বিকেল ৩টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।
বইমেলার মূলমঞ্চে বিকাল ৪টায় অনুষ্ঠিত হবে ‘বাংলাদেশ বিনির্মাণ: রাষ্ট্র কাঠামো’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন রেজাউল করিম রনি। আলোচনায় অংশ নেবেন সৈয়দ নিজার। সভাপতিত্ব করবেন কাজী মারুফ।