“আমাদের তো এরকম কোনও দুর্বলতা নেই। এরকম দুর্বলতা থাকলে তথ্য চেপে রাখার কথা, যেটা আগেও হয়েছে বিভিন্ন সময়,” বলেন তিনি।
Published : 06 Dec 2024, 12:46 AM
কাউকে ধরে নিয়ে ‘আয়নাঘরে’ দীর্ঘদিন আটকে রাখার অভিযোগের বিষয়ে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ তোপের মুখে পড়লেও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারে সেরকম ‘বন্দিশালা’ বা ‘গুম-খুনের চর্চা নেই’ বলে মন্তব্য করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম।
বর্তমান সরকারকে ‘স্বচ্ছ’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেছেন, “খুন, গুম, আয়নাঘর- এই সংস্কৃতি তো এখন আর নাই। সরকার শুধরানোর চেষ্টা করছে। তাহলে আমরাই বা কেন তথ্য চেপে রাখব। আমাদের তো এরকম কোনো দুর্বলতা নেই। এরকম দুর্বলতা থাকলে তথ্য চেপে রাখার কথা, যেটা আগেও হয়েছে বিভিন্ন সময়।”
তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে পুলিশ প্রধান হিসেবে নিজেকে ‘উন্মুক্ত’ রাখার কথাও তুলে ধরেন আইজিপি।
তিনি বলেন, “আমার তো দীর্ঘদিনের পুলিশের চাকরি। আসলে এরকম (তথ্য চেপে রাখা) হয়েছে এটা সত্যি। তবে আমি যতদিন আছি, আমি চেষ্টা করব আপনাদের কাছে খোলাখুলি থাকতে।”
পুলিশ সদর দপ্তরে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছিলেন দুই সপ্তাহ আগে দায়িত্ব নেওয়া আইজিপি।
তার কাছে জানতে চাওয়া হয়- পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এখন সাংবাদিকদের তথ্য দিতে ‘গড়িমসি’ করা হয়, পুলিশের ওয়েবসাইটে সাধারণ অপরাধ পরিসংখ্যান নেই।
জবাবে বাহারুল আলম বলেন, “আমি টেলিফোনে অপরিচিত নম্বরও ধরি। এর মধ্যে অনেক সাংবাদিকের সঙ্গেও কথা হয়েছে। ওই জায়গাটায় আমার কোনো দ্বিধা নেই, আমি মনে করি পুলিশের অন্য কারও থাকা উচিৎ না।
“আর এই সরকার তো স্বচ্ছ। এখন তো এরকম চেপে রাখার কিছু নেই যে এটা প্রেসকে জানানো যাবে না, এরকম কিছু নেই।”
সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি থাকার আশঙ্কা প্রকাশ করে মঙ্গলবার বিদেশি নাগরিকদের বাংলাদেশে ভ্রমণের বিষয়ে সতর্কতা জারি করে যুক্তরাজ্য। তবে সেরকম কোনো শঙ্কা না দেখলেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন আইজিপি।
তিনি বলেন, “আমরা এরকম কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। যেহেতু তারা দিয়েছে এবং তাদের গোয়েন্দা আমাদের চেয়ে ভালো, সেজন্য আমরা ওটাকে গুরুত্ব দিচ্ছি।
“আমরা কিন্তু সজাগ আছি এসব ব্যাপারে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এরকম কথা বলা হচ্ছে যে, এখানে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বাড়ছে, আসলে সরকারিভাবে এরকম পৃষ্ঠপোষকতা তো কারও প্রতি হয়নি।”
আগের সরকারে ‘জঙ্গি হিসেবে’ গ্রেপ্তার অনেকের জামিন পাওয়াদের প্রসঙ্গে এক সাংবাদিক জানতে চান- তারা আদৌ জঙ্গি কি না, আর পুলিশ বিষয়টিকে কীভাবে দেখছে।
জবাবে পুলিশপ্রধান বলেন, “আসলে আদালত যদি জামিন দিয়ে থাকেন বা খালাস দিয়ে থাকেন, তাহলে আদালতের যে রায়টা সেটাই চূড়ান্ত। আমরা যাই বলি না কেন ওটাকেই আমরা শ্রদ্ধা করব। আমরা এর বাইরে অন্য কিছু বলতে যাব না।”
ক্ষমতার পালাবদলের পর সংখ্যালঘু নিপীড়ন নিয়ে নানা অভিযোগ আর চট্টগ্রামে সনাতনী জাগরণী জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের গ্রেপ্তারের পর সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ভারতের সঙ্গে ‘কূটনৈতিক বৈরিতা চলছে’।
প্রতিবেশী দেশের কর্মকাণ্ড নিয়ে ‘বিড়ম্বনার’ কথা তুলে ধরে সার্বিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সবার সহযোগিতা কামনা করেন আইজিপি বাহারুল আলম।
‘কয়দিন আগেই যাকে গুলি করেছি, এখন তারা আস্থা রাখবে কেন’
তুমুল গণআন্দোলনে ক্ষমতার পালাবদলের পরিস্থিতিতে মাঠপর্যায়ের পুলিশকে পুনরায় সক্রিয় করে তোলার কাজকে ‘অনেক কষ্টসাধ্য’ বলে মনে করেন আইজিপি।
গণআন্দোলনে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “কয়দিন আগেই তো আমি তাকে গুলি করে মেরেছি। এখন তারা আস্থা রাখবে কেন। এই জায়গা থেকে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে (পুলিশের) জনবান্ধব হওয়া তো একটা ‘হারকিউলিয়ান টাস্ক’ (বিশাল কষ্টসাধ্য কাজ)।
“পুলিশের অনেক কর্মকর্তাই দায় এড়াতে পারেন না। তবে পুলিশের অনেক কর্মকর্তাকে মামলায় আসামি করা হয়েছে নানা কারণে। আসামি হলেই অবশ্য পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।”
সম্প্রতি হাসপাতাল ঘুরে আন্দোলনে আহতদের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি সেদিন নিটোরে (পঙ্গু হাসপাতাল) গেলাম। আমাকে বলছে, ‘স্যার আমাকে কেন গুলি করলেন। আমি তো শুধু ভ্যান চালাই। আমি তো কোনো সাত-পাঁচে নাই’।
“এই প্রশ্ন শুনে আমার তো কোনো জবাব নেই। আমি বলেছি, আমার কোনো জবাব নেই, আমি তোমার কাছে শুধু ক্ষমা চাইতে এসেছি।”
আন্দোলনে ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে ভূমিকা পালনের অভিযোগ ওঠা বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার নাম তুলে ধরে এক সাংবাদিক জানতে চান, তাদের সন্ধানে কোনো নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে কি না?
জবাবে আইজিপি বলেন, “যাদের নাম বললেন, আমরা গণমাধ্যমে অনেক তথ্য পেয়েছি। আমাদের নিজস্ব তদন্ত প্রক্রিয়াও চলমান আছে।
“তাদের প্রত্যেকের অবস্থান আমরা যে বের করতে পেরেছি, তা নয়। আমরা প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। তারা যদি দেশের ভেতরে থাকেন আর অবস্থান চিহ্নিত করতে পারি, তাহলে অবশ্যই গ্রেপ্তার করব। যদি বাইরে থাকেন তাহলে সেটারও আইনি প্রক্রিয়া আছে।”
পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে আরেক প্রশ্নের জবাবে বাহারুল আলম বলেন, “তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে আমরা তখনই বলব, যখন মামলা ক্লোজ করা হবে। তবে সাধারণভাবে আপনাদের যা ধারণা, আমারও কিন্তু একই ধারণা। কেউই দায় এড়াতে পারবেন না।
“আপনারাই তো দেখেছেন, তারা কেউ কেউ তো সশরীরে থেকে কমান্ড করেছেন। তাহলে তাদের দায় অবশ্যই আছে। কিন্তু আমাকে আইনগত প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্য প্রমাণ দিয়ে দেখাতে হবে যে কে, কাকে, কী বলেছে অথবা ওয়্যারলেসের রেকর্ড আছে। এসব যোগাড় করে কোর্টকে দিলে তখন কোর্ট বিশ্বাস করবে। এমনিতে যতই আমি বলি, কোর্ট বিশ্বাস করবে না।”
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া পুলিশ সদস্যের সংখ্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদের দুই লাখ ১৩ হাজার পুলিশের মধ্যে কতজন ছাত্র-জনতার বিপক্ষে ছিল, এটা আসলে বের করা কঠিন।”
মাঠ পর্যায়ে পুলিশ আরও সচল হতে কতদিন লাগবে, জানতে চাইলে আইজিপি বলেন, “এটা কিন্তু অনেক বড় কাজ। এটা এক-দুই দিনে যে হবে, এরকম কোনো টাইমলাইন বলা কঠিন। মানুষের সহায়তা না পেলে এটা করা কঠিন।”
পুলিশের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, “দুদক অনেকের বিষয়ে কাজ করছে। আমাদের কাছ থেকে তথ্য নিচ্ছে।”
পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার ব্যাপারে আইজিপি বলেন, “এই উদ্যোগ পুলিশ সংস্কার কমিশন নিয়েছে। তারা সুপারিশ পেশের সময় দীর্ঘ ও প্রণিধানযোগ্য সুপারিশ দেবে, যেন আমরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত না হই। আমিসহ পুরো পুলিশ বাহিনীর এই দাবি। আমার বিশ্বাস এই সরকারের পক্ষেই সম্ভব এটা করা।”
‘নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত নয় পুলিশ’
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পুলিশের প্রস্তুতি নিয়ে এক প্রশ্নে পুলিশপ্রধান বলেন, “নির্বাচনের ওই স্টেপটাতে আমরা এখনও যেতে পারিনি। কারণ মূল যে কাজটা পুলিশ ফোর্সটাকে ‘ওয়ার্কেবল’ করা, তাদের মনোবল, কাজের স্পৃহা ফিরিয়ে আনা, মানুষের আরেকটু কাছে নিয়ে যাওয়া, তারা যেন আস্থা পায়- ওই জায়গাটায় আমরা যেতে চাই।”
বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে হতাশা-ক্ষোভ থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “সেই জায়গাটা আমরা দেখতে চাই। এরপর নির্বাচনের বিষয়টা দেখব। তবে একটা জিনিস আমি আপনাকে ‘ব্ল্যাংক চেক দিতে পারি’ যে, নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য যে পুলিশি সাহায্য সেটা করার পূর্ণ সাহায্য আমাদের আছে।
”তিনটা তত্ত্বাবধায়ক আমলে তিনটা নির্বাচন হয়েছে আপনারা তো দেখেছেন, আমরা পারি।”