অভিযোগ সুনির্দিষ্ট ও তথ্যভিত্তিক হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, বলেন দুদক কর্মকর্তা আক্তারে হোসেন।
Published : 26 Dec 2024, 05:27 PM
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের পাঁচ সদস্যের নামে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ছয়টি প্লট বরাদ্দে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে নামছে দুর্নীতি দমন কমিশন, দুদক।
দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যমকে কমিশনের এ সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিরুদ্ধে ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির’ মাধ্যমে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রাজউক এর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ‘যোগসাজশে’ নিজের ও পরিবারের ওই সদস্যদের নামে প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের ২৭ নম্বর সেক্টরের কূটনৈতিক জোনের ২০৩ নম্বর রোডের আশপাশের এলাকায় শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, ছোট বোন শেখ রেহানা এবং তার ছেলে-মেয়ে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিকের নামে প্লটগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনা ১০ কাঠার প্লট (প্লট নম্বর ০০৯) বরাদ্দ পেয়েছেন। ২০২২ সালের ৩ অগাস্ট তার নামে রাজউক বরাদ্দপত্র দেয়।
সজীব ওয়াজেদ জয় (প্লট নম্বর ০১৫) এবং মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলও (প্লট নম্বর ০১৭) ১০ কাঠা করে প্লট পেয়েছেন। জয়ের বরাদ্দপত্র ২০২২ সালের ২৪ অক্টোবর ইস্যু করা হয় এবং ১০ নভেম্বর মালিকানা সংক্রান্ত রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হয়। পুতুলের বরাদ্দপত্র ২ নভেম্বর ইস্যু করা হয়।
শেখ রেহানাও ১০ কাঠার প্লট (প্লট নম্বর ০১৩) বরাদ্দ পেয়েছেন। তার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের (প্লট নম্বর ০১১) এবং মেয়ে আজমিনা সিদ্দিকের (প্লট নম্বর ০১৯) নামেও একই পরিমাণের প্লট বরাদ্দ হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের বিষয়টি তুলে ধরে দুদকের মহাপরিচালক আক্তার বলেন, অভিযোগগুলো সুনির্দিষ্ট, তথ্যভিত্তিক ও কমিশনের তফসিলভুক্ত অপরাধ মনে হওয়ায় অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গত অক্টোবরে বোন শেখ রেহানাসহ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের ছয় সদস্যের নামে পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দে অনিয়ম নিয়ে সংবাদমাধ্যমে আসা অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে দেয় হাইকোর্ট।
একইসঙ্গে এ কমিটিকে আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে (২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে) রাজউকের প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগও তদন্ত করতে বলা হয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ অগাস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা, এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরুদ্ধে আশ্রয়ণ, বেজা ও বেপজার আটটি প্রকল্পে ২১ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানে মঙ্গলবার তথ্য চেয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে চিঠি পাঠায় দুদক।
গত ১৭ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, বোন শেখ রেহানা ও তার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।
পরদিন দুদকের উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিনকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি দলকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
দুদকের পাঁচ সদস্যের এ দল আওয়ামী লীগ সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকারের আট প্রকল্পে শেখ হাসিনাসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে ওঠা ২১ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করবে।
একই দল অনুসন্ধান করবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে ৫৯ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ।
সরকারপ্রধানের দপ্তরের দেওয়া এক সারসংক্ষেপে শেখ হাসিনা এবং তার ছেলে, বোন ও ভাগ্নির বিরুদ্ধে কী ধরনের দুর্নীতির তথ্য দুদকের হাতে এসেছে তার একটি ধারণা পাওয়া গেছে।
দুদকের বরাত দিয়ে ওই সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, বিভিন্ন ‘উন্মুক্ত সূত্র’ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের ‘আর্থিক অনিয়ম’ হয়েছে।
“রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তির মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব আহমেদ ওয়াজেদ (জয়) এবং ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আত্মসাৎ করেছেন, যা পাচার করা হয়েছে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে।”
কীভাবে ওই অর্থ ‘পাচার’ করা হয়েছে, সে বিষয়েও একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের সারসংক্ষেপে।
এছাড়া শেখ হাসিনা এবং তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে ৩০ কোটি ডলার পাচারের আরেকটি অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। অনুসন্ধান দল নথিপত্র ও দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহের কাজ করছে।
এর অংশ হিসেবে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে অফশোর ব্যাংকিং হিসাব ও পরিচয়পত্র সংক্রান্ত নথি সংগ্রহের জন্য একাধিক দপ্তরে চিঠি পাঠানোরও উদ্যোগ নিয়েছে দুদক।
দুদকের বরাতে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের সারসংক্ষেপে বলা হয়, “রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, যা মূলত বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটানোর মহৎ লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল, এখন এই গুরুতর অভিযোগের কারণে তা বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। ঘুষ, অব্যবস্থাপনা, অর্থপাচার এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ স্বচ্ছতা এবং সরকারি অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রকল্পটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।”
সেখানে বলা হয়, টিউলিপ সিদ্দিকের চাচা তারিক আহমেদ সিদ্দিক বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন। তার স্ত্রী ও মেয়ে প্রচ্ছায়া লিমিটেড (নিবন্ধন সনদ নম্বর সি-৭৫৬৫৯/০৯, তারিখ ২৫ মার্চ ২০০৯) নামের একটি ‘ভুয়া কোম্পানির’ অংশীদার। ওই কোম্পানি ‘ডেসটিনি গ্রুপ নামের একটি চিট ফান্ড কোম্পানির’ সঙ্গে যুক্ত ছিল।
অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রচ্ছায়া লিমিটেড যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রায় ৯০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার করেছে। ওই অর্থ দিয়ে যুক্তরাজ্যে জুমানা ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড প্রোপার্টিস লিমিটেড (নিবন্ধন সনদ নম্বর ৭৪১৭৪১৭, তারিখ ২৫ অক্টোবর ২০১০) নামের একটি কোম্পানিও খোলা হয়েছে।
“বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির এমপি টিউলিপ সিদ্দিক রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সেই সাক্ষাতের পর থেকে মস্কোর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক বজায় রেখেছেন।”
দুদকের অনুসন্ধান দল ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন অফিস এবং ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর থেকে হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের পরিচয়পত্র সংক্রান্ত প্রাথমিক নথি সংগ্রহ করেছে। তাদের নামে চলমান অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সম্পর্কিত তথ্য দিতে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকেও (বিএফআইইউ) অনুরোধ করেছে।
পুরনো খবর:
শেখ পরিবারের নামে রাজউকের প্লট বরাদ্দে 'অনিয়ম' তদন্তে কমিটি