যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাও ৩০ কোটি ডলার পাচারে জয়ের ‘সম্পৃক্ততার’ প্রমাণ পেয়েছে বলে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের ভাষ্য।
Published : 24 Dec 2024, 11:38 PM
শেখ হাসিনা এবং তার ছেলে, বোন ও ভাগ্নির বিরুদ্ধে কী ধরনের দুর্নীতির তথ্য দুদকের হাতে এসেছে, তার একটি ধারণা পাওয়া গেছে সরকারপ্রধানের দপ্তরের দেওয়া এক সারসংক্ষেপে।
দুদকের বরাত দিয়ে ওই সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, বিভিন্ন ‘উন্মুক্ত সূত্র’ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের ‘আর্থিক অনিয়ম’ হয়েছে।
“রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তির মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব আহমেদ ওয়াজেদ (জয়) এবং ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আত্মসাৎ করেছেন, যা পাচার করা হয়েছে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে।”
কীভাবে ওই অর্থ ‘পাচার’ করা হয়েছে, সে বিষয়েও একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের সারসংক্ষেপে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, “শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির বিষয়ে দুদকের করা একটি সারসংক্ষেপ প্রতিবেদন আমরা দিয়েছি। এই বিষয়ে কাজগুলো মাত্র শুরু হয়েছে। আরো বিস্তারিত কাজ আপনারা সামনে দেখতে পাবেন। এ বিষয়ে কাজ করা আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে রয়েছে।“
বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “উনি একটা চোরতন্ত্র জারি করেছিলেন এখানে, সেই চোরতন্ত্রে কারা কারা এই মহাচুরিতে জড়িত ছিল, এটা বাংলাদেশের মানুষ জানতে চায় এবং এটা জানানোটা আমাদের একটা নৈতিক দায়িত্ব।”
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ অগাস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা, এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।
সেদিন শেখ হাসিনার সঙ্গে তার বোন শেখ রেহানাও দেশ ছাড়েন। শেখ হাসিনার ছেলে এবং তার সাবেক উপদেষ্টা জয় আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র্র প্রবাসী। আর রেহানার মেয়ে টিউলিপ যুক্তরাজ্য সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ২০১৩ সালে যখন রাশিয়ায় চুক্তি স্বাক্ষর হয়, হাসিনার সঙ্গে জয়, রেহানা ও টিউলিপও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তাদের ছবিও সে সময় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
গ্লোবাল ডিফেন্স কর্প নামের একটি ওয়েবসাইটের বরাত দিয়ে রূপপুর প্রকল্প থেকে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের ৫০০ কোটি ডলার ‘দুর্নীতির’ অভিযোগ নিয়ে গত নভেম্বর মাসে দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
সেসব প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এক রিট মামলার পর হাই কোর্ট এ বিষয়ে দুদকের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। দুদকও তখন শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরুর ঘোষণা দেয়। আর এই অনুসন্ধানের জন্য গঠন করা হয় পাঁচ সদস্যের একটি দল।
এছাড়া শেখ হাসিনা এবং তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে ৩০ কোটি ডলার পাচারের আরেকটি অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক।
দুদকের মুখপাত্র ও মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে অনুসন্ধান দল রেকর্ডপত্র ও দালিলিক প্রমাণাদি সংগ্রহের কাজ করছেন।”
এর অংশ হিসেবে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে অফশোর ব্যাংকিং হিসাব ও পরিচয়পত্র সংক্রান্ত নথি সংগ্রহের জন্য একাধিক দপ্তরে চিঠি পাঠানোরও উদ্যোগ নিয়েছে দুদক।
দুদকের বরাতে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের সারসংক্ষেপে বলা হয়, “রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, যা মূলত বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটানোর মহৎ লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল, এখন এই গুরুতর অভিযোগের কারণে তা বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। ঘুষ, অব্যবস্থাপনা, অর্থপাচার এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ স্বচ্ছতা এবং সরকারি অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রকল্পটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।”
সেখানে বলা হয়, টিউলিপ সিদ্দিকের চাচা তারিক আহমেদ সিদ্দিক বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন। তার স্ত্রী ও মেয়ে প্রচ্ছায়া লিমিটেড (নিবন্ধন সনদ নম্বর সি-৭৫৬৫৯/০৯, তারিখ ২৫ মার্চ ২০০৯) নামের একটি ‘ভুয়া কোম্পানির’ অংশীদার। ওই কোম্পানি ‘ডেসটিনি গ্রুপ নামের একটি চিট ফান্ড কোম্পানির’ সঙ্গে যুক্ত ছিল।
অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রচ্ছায়া লিমিটেড যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রায় ৯০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার করেছে। ওই অর্থ দিয়ে যুক্তরাজ্যে জুমানা ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড প্রোপার্টিস লিমিটেড (নিবন্ধন সনদ নম্বর ৭৪১৭৪১৭, তারিখ ২৫ অক্টোবর ২০১০) নামের একটি কোম্পানিও খোলা হয়েছে।
“বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির এমপি টিউলিপ সিদ্দিক রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সেই সাক্ষাতের পর থেকে মস্কোর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক বজায় রেখেছেন”
দুদক শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখার ঘোষণা দেওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাজ্যেও তোলপাড় শুরু হয়।
শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার নেতৃত্বাধীন সরকারে আর্থিক সেবাবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর (সিটি মিনিস্টার) দায়িত্বে আছেন। অর্থাৎ, ব্রিটেনে আর্থিক খাত থেকে দুর্নীতি দূর করাও তার দায়িত্বের অংশ।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস জানিয়েছে, দেশটির মন্ত্রিসভা কার্যালয়ের প্রোপ্রাইটি অ্যান্ড এথিকস টিম (পিইটি) রাশিয়ার সঙ্গে মধ্যস্থতার অভিযোগ নিয়ে গত বৃহস্পতিবার টিউলিপকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। লেবার পার্টির এই এমপি দাবি করেন, এসব অভিযোগ ‘মিথ্যা’ এবং ‘পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ওঠা এসব ‘দুর্নীতিতে’ জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, এগুলো ‘একদম ভুয়া’ এবং ‘উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা’।
অভিযোগের বিষয়ে রয়টার্সকে তিনি বলেন, ”সরকারি কোনো প্রকল্প থেকে আমি কিংবা আমার পরিবার, কেউই কোনো দেশের থেকে অর্থ নেইনি। এ ধরনের কোনো ঘটনার সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততাও নেই।”
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বসবাসরত জয়ের দাবি, “এক হাজার কোটি ডলারের কোনো প্রকল্প থেকে কোটি কোটি ডলার আত্মসাৎ করা সম্ভব নয়। আমাদের অফশোর কোনো ব্যাংক হিসাবও নেই।
“আমি ৩০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে থাকি। আমার খালা (শেখ রেহানা) ও খালাতো বোনেরাও প্রায় একই সময় ধরে যুক্তরাজ্যে থাকেন। এসব দেশে আমাদের ব্যাংক হিসাব আছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের কেউই কখনো এত অর্থ দেখিনি।”
শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত আনতে সম্প্রতি ভারত সরকারকে চিঠি দেওয়ার তথ্য দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এ বিষয়ে জয় বলেন, শেখ হাসিনার দেশে ফেরার বিষয়ে তাদের পরিবার কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি এবং নয়া দিল্লিও তাকে অন্য কোথাও আশ্রয় নেওয়ার কথা বলেনি।
এর আগে বাংলাদেশে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মান্টিটস্কিও রূপপুর প্রকল্পের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের ৫০০ কোটি ডলার ঘুষ দেওয়ার অভিযোগকে ‘গুজব’ ও ‘মিথ্যা’ বলে উড়িয়ে দেন।
গত ২৫ অগাস্ট অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে রুশ রাষ্ট্রদূত বলেন, “নির্দ্বিধায় বলতে পারি, এটি গুজব ও মিথ্যা। এ বিষয়ে আমাদের কোম্পানি রোসাটম (রূপপুর প্রকল্পে যারা কাজ করছে) ইতিমধ্যে বিবৃতি দিয়েছে।”
দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে শেখ হাসিনার কোনো ভাষ্য আওয়ামী লীগের ফেইসবুক পেইজে আসেনি। তারিক আহমেদ সিদ্দিকের প্রতিক্রিয়াও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানতে পারেনি।
৩০ কোটি ডলার পাচারের অভিযোগ
শেখ হাসিনা ও তার ছেলে জয়ের বিরুদ্ধে ৩০ কোটি ডলার যুক্তরাষ্ট্রে পাচারের আরেকটি অভিযোগের অনুসন্ধান করছে দুদক।
ওই অভিযোগে বলা হয়, সজীব আহমেদ ওয়াজেদ (জয়) এর নাম অর্থপাচারে সন্দেহভাজন হিসেবে প্রথম উঠে আসে ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বনাম রিজভি আহমেদ মামলায়।
“পরে যুক্তরাষ্ট্রের একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালিত তদন্তে সজীব ওয়াজেদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের আর্থিক অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসে।
“তদন্তে উঠে আসে, হংকং ও কেম্যান দ্বীপপুঞ্জে সজীব ওয়াজেদের নামে বিভিন্ন অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে স্থানীয় একটি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ও নিউ ইয়র্ক এবং যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থপাচার করা হয়েছে।”
সংক্ষিপ্তসারে বলা হয়েছে, “যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাও তাদের লন্ডন প্রতিনিধি মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করে এবং সজীব ওয়াজেদের অর্থপাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ পায়। এছাড়াও মার্কিন বিচার বিভাগের সিনিয়র ট্রায়াল অ্যাটর্নি লিন্ডা স্যামুয়েলস স্পেশাল এজেন্ট লা প্রেভট এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং প্রমাণ পান যে, বাংলাদেশ থেকে ৩০ কোটি ডলার যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে।”
শেখ হাসিনা ও জয়ের বিরুদ্ধে মোট ৮০ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ নিয়েও দুদকের অনুসন্ধানের কথা বলা হয়েছে ওই সারসংক্ষেপে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং বিশেষ আশ্রয়ন প্রকল্পসহ নয়টি প্রকল্পে এই দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে। শেখ রেহানা ও টিউলিপ সিদ্দিকের নামও সেখানে এসেছে।
দুদকের অনুসন্ধান দল ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন অফিস এবং ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর থেকে হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের পরিচয়পত্র সংক্রান্ত প্রাথমিক নথি সংগ্রহ করেছে। তাদের নামে চলমান অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সম্পর্কিত তথ্য দিতে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকেও (বিএফআইইউ) অনুরোধ করেছে।