বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নিজের ভাষায় অনুবাদ করেছেন এক ত্রিপুরা তরুণ; টিকিয়ে রাখতে চাইছেন ককবরক ভাষাটিকে।
Published : 19 Oct 2022, 01:24 AM
ত্রিপুরাদের ভাষা আছে, কিন্তু তার লিখিত রূপ দিতে নেই হরফ; ফলে ভাষা হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার নয়। সেই ভবিষ্যৎ যেন না আসে, তারই উদ্যোগ নিয়েছেন যুবরাজ দেববর্মা। শ্রীমঙ্গলের ডলুছড়ার এই ত্রিপুরা তরুণ তার মাতৃভাষা ককবরকে অনুবাদ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’।
রোমান হরফে প্রায় দুই বছরে এই অনুবাদটি করেছেন যুবরাজ। তার এই উদ্যোগকে মাতৃভাষা টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে একটি বড় কাজ হিসেবে দেখছে ত্রিপুরা সম্প্রদায়। যুবরাজেরও ইচ্ছা, তার ভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য এমন আরও অনুবাদ করার।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞান বিভাগ থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করা এই তরুণ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বই হচ্ছে ভাষা-সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।
“ভারতীয় উপমহাদেশে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ, আমাদের ভাষাও তাই। কিন্তু কম মানুষের ভাষা হওয়ায় তার চর্চা কম। তাই ককবরককে টিকিয়ে রাখতে আমি বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী আমাদের ভাষায় অনুবাদ করেছি।”
বাংলাদেশে মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বাস। সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ থাকে পার্বত্যাঞ্চলের তিন জেলাতেই। এছাড়া বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা, রাজবাড়ি, চাঁদপুর, ফরিদপুরে ত্রিপুরাদের কিছু বসতি রয়েছে। সব মিলিয়ে দেশে ত্রিপুরার সংখ্যা দুই লাখের কাছাকাছি বলে ধারণা পাওয়া যায় সরকারি তথ্যে।
ত্রিপুরাদের ভাষার নাম ‘ককবরক’। এ ভাষার কোনো নির্দিষ্ট হরফ এখন নেই। আছে শব্দ, উচ্চারণ, প্রবাদ-প্রবচন অর্থাৎ ভাব প্রকাশের সব অনুষঙ্গ। এই ভাষার হরফ নিয়ে আছে নানা বিতর্ক, পৌরাণিক আখ্যান। কেউ বলেন, এ ভাষার হরফ হারিয়েছে কালের বিবর্তনে। আবার কেউ কেউ বলে কোনোকালেই এই ভাষার কোনো হরফ ছিল না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক প্রশান্ত ত্রিপুরার “নিজের মাতৃভাষা ‘ককবরক’ নিয়ে আমার কিছু কথা” শীর্ষক এক লেখায় উঠে আসে হরফ হারিয়ে যাওয়ার পুরান-কথা।
ত্রিপুরাদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনি অনুসারে একদা তাদের নিজস্ব হরফ ছিল, যা লেখা ছিল কোনো এক উদ্ভিদের পাতায়। দুর্ভাগ্যবশত সেই পাতাগুলো খেয়ে ফেলে এক ছাগল, ফলে ত্রিপুরারা তাদের হরফ চিরতরে হারিয়ে ফেলে। এই কাহিনিতে বিশ্বাসী ত্রিপুরারা এখনও বলি দেওয়া ছাগলের নাড়িভুড়িতে তাদের হারানো হরফ দেখার চেষ্টা করে!
জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরার দেওয়া তথ্য বলছে, ককবরক ভাষাকে প্রথম আলোর মুখ দেখান একজন বাঙালি। পার্বত্যাঞ্চলে বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষায় শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য কাজ করছে জাবারাং নামে উন্নয়ন সংগঠনটি।
প্রতি ১৪ দিনে হারাচ্ছে একটি করে ভাষা: ইউনেস্কো
মথুরা ত্রিপুরা বলেন, “ত্রিপুরাদের ভাষার ব্যাকরণকে ‘ককবরমা অং ত্রৈপুর ব্যাকরণ’ বইতে প্রথম বাংলায় লিখিত রূপ দিয়েছিলেন ত্রিপুরা রাজপরিবারের উজির দৌলত আহম্মদ। তার লেখা বইটি ১৩০৭ ত্রিপুরাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল, যা খ্রিস্টীয় সন গণনায় হয় ১৮৯৭ সাল। এর তিন বছর পর ১৯০০ সালে ত্রিপুরা রাজপরিবারের ঠাকুর রাধামোহন দেববর্মণ ‘ককবরকমা’ নামে একটি ‘ককবরক’ ব্যাকরণ রচনা করেন। এই দুই ব্যক্তিকে ককবরক ভাষার পুরোধা ব্যক্তি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।
“কিন্তু এতেও ককবরক ভাষার হরফ উদ্ধার হয়নি। ককবরক ভাষার লিখিত রূপের ইতিহাস দেখতে গেলে হাঁটতে হবে ইতিহাসের খ্রিস্টীয় প্রথম শতক হতে মধ্যযুগ পর্যন্ত। এই ভাষা নিয়ে যেসব প্রাসঙ্গিক লেখা পাওয়া যায়, সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, কলমা নামের এই ভাষার একটি নিজস্ব লিপি ছিল। তবে এই লিপির কোনো নমুনা এখন আর পাওয়া যায় না। কলমা হরফে লেখা ত্রিপুরার রাজাদের ইতিহাস বা বংশলিপির কথা প্রায়ই উল্লেখ করা হয়। ‘রাজরত্নাকর’ নামের ত্রিপুরা রাজাদের কাহিনিনির্ভর একটি গ্রন্থও কলমা লিপিতে রচিত হয়েছিল । ত্রিপুরার ইতিহাস ‘রাজমালা’ গ্রন্থটিও এই সময়ে কলমা লিপিতে লেখা হয়েছিল বলে জানা যায়। এই দুই গ্রন্থের কোনো কপি এখন আর পাওয়া যায় না।”
ত্রিপুরারা যেখানে দীর্ঘদিন এই অঞ্চলের রাজকার্যে ছিল সেখানে তাদের নিজেদের ভাষা হারিয়ে যাওয়ার কারণ কী? এর পেছনে অনেক গবেষক ত্রিপুরা রাজপরিবারের মাতৃভাষার প্রতি অনাগ্রহকে দায়ী করেন।
মথুরা ত্রিপুরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের হরফ সেভাবে উন্নত হয়নি। আমি প্রায়ই বলি, আমাদের রাজারা জাতিগোষ্ঠীতে ত্রিপুরা হলেও তারা তাদের মাতৃভাষাকে তেমন প্রচার করেননি। ফলে রাজত্ব থাকাকালীন এই ভাষার তেমন প্রসার হয়নি। রাজকার্যের ভাষা তারা রেখেছিলেন বাংলা।”
তবে এই অভিযোগ মানতে নারাজ, ত্রিপুরাদের ভাষা নিয়ে গবেষণা করা শিক্ষক ও লেখক ড. আজাদ বুলবুল।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ককবরক ভাষার হরফ ত্রিপুরা রাজাদের বেখেয়ালে বা সচেতন কোনো আগ্রাসনে হারিয়ে গেছে, তা আমি বিশ্বাস করতে চাই না।
“আমার গবেষণা বলে, এই ভাষার কোনো হরফ কোনোকালেই ছিল না। ত্রিপুরারা তাদের ধর্ম, ইতিহাস, বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে, কাজেই ভাষা বর্ণমালাও বাঁচিয়ে রাখতে পারার কথা। এমন অনেক ভাষা আছে, যেসব ভাষার হরফ নেই, কিন্তু ভাষা টিকে আছে।”
তাহলে কীভাবে চলছে ককবরক ভাষার চর্চা?
মথুরা ত্রিপুরা বলেন, “ভারত স্বাধীনের পর ত্রিপুরাদের ভাষা বিশেষ করে ককবরককে ত্রিপুরা রাজ্যের সরকারি ভাষা করার জন্য অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৮ সালের ১৯ জানুয়ারি ককবরককে সেখানে রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
“২০০০ সালে ভারতে একটি ওয়ার্কশপ হয় সেখানে বাংলাদেশে থাকা ত্রিপুরাদেরও ডাকা হয়েছিল। সেখানে আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী আছি, তাদের কিছু মানুষ গিয়েছিলাম। সেখান থেকে মূলত আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হয়, আমাদের যেহেতু নিজস্ব হরফ নেই, নতুন করে হরফ বানাতে গেলে আমাদের অনেক সময় লাগবে। প্রস্তাব আসে যে বাংলা বা রোমান যে হরফে আমরা ভালো লিখতে পারি, সে হরফেই আমরা নিজেদের ভাষা লিখবো। তবে আমরা অফিসিয়ালি লিখলে রোমান হরফেই লিখব বলে সিদ্ধান্ত হয়।”
ভাষার আকুতি নিঃশ্বাসের মত: মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা
সেই সিদ্ধান্ত অনুসরণ করেই বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র অনুবাদ রোমান হরফে লিখেছেন রোমান হরফে লিখেছেন যুবরাজ দেববর্মা।
এই অনুবাদকর্মে আত্মনিয়োগের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, “ক্যাম্পাস জীবন থেকেই আমার একটা ইচ্ছে ছিল আলাদা কিছু করার, যাতে আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখা যায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রচলনের ঘোষণা দিয়েছেন, শিক্ষানীতি প্রণয়ন হয়েছে, কিন্তু স্কুলগুলোতে এখনও তা পৌঁছায়নি।
“করোনার কঠিন সময়ে আমার মাকে হারাই। মা মারা যাওয়ার পর আমি অনেক বিষণ্ন হয়ে পড়ি, হতাশা ঘিরে ধরে। তখন আমার এক আত্মীয় হতাশা কাটাতে আমাকে রাঙামাটি নিয়ে যান। সেখানে সপ্তাহখানেক কাটানোর সময় আমি বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী বইটি হাতে পাই। তখনই বইটি ককবরকে অনুবাদের চিন্তা আসে আমার মাথায়।”
হরফ না থাকা একটি ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে কী কী সমস্যায় পড়েছিলেন যুবরাজ?
তিনি বলেন, “আমাদের এই ভাষার অনেক অভিধান আছে আগরতলায়। আমি বইটি অনুবাদের সময় দেখেছি, বাংলাও যেমন এই বিশ্বায়নের যুগে একেবারে মৌলিক নেই। ঠিক একই অবস্থা ককবরকের। আমাদের এই ভাষাটা তো আরও অনেক প্রান্তিক, অনেক কম মানুষের ভাষা। ফলে অনেক শব্দ মিশেছে, সব শব্দ আমাদের ভাষায় পাওয়া সম্ভবও না। আমার ছোটবেলা থেকে এই ভাষা নিয়ে আগ্রহ ছিল, আর মায়ের কাছ থেকে এই ভাষার অনেক প্রবাদ-প্রবচন জানা ছিল। ফলে, শব্দ নিয়ে আমার তেমন অসুবিধে হয়নি।”
অনুবাদ তো করেছেন, এখন তা বই হিসেবে প্রকাশের জন্য ইউপিএলের (ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড) সঙ্গে আলোচনা চলছে যুবরাজের।
ইউপিএলের পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ অনুবাদটি প্রকাশ করতে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের অনুমোদনের ব্যাপার আছে। সুতরাং, এখনই কোনো ঘোষণা দেওয়া যাচ্ছে না। সিদ্ধান্ত হলে আমরা জানিয়ে দেব।”
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এরই মধ্যে বিশ্বের নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ত্রিপুরা ভাষায়ও অনুবাদে অনাগ্রহী নন বলে জানা গেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কিউরেটর নজরুল ইসলাম খানের কথায়।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের পক্ষ থেকে ছেলেটিকে (যুবরাজ দেববর্মা) ‘ককবরক’ ভাষায় পারদর্শী তৃতীয় কাউকে দিয়ে অনুবাদটি চেক করানোর কথা বলা হয়েছে। চেক করা হলে আমরা দায়িত্ব নিয়েই এটি ছাপাবার ব্যবস্থা করব।”
এখনও প্রকাশ না হলেও যুবরাজের এই উদ্যোগের প্রশংসা কুড়াচ্ছে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের মধ্যে।
মথুরা ত্রিপুরা বলেন, “সে যে অনুবাদটি করেছে, এটি আমাদের ভাষা বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে একটা বড় কাজ। কারণ, ভাষা বিকাশের ক্ষেত্রে অনুবাদ কর্ম একটি বড় অবদান রাখে।
“যেহেতু আমাদের ভাষা সেভাবে বিকশিত হয়নি, সেহেতু আমরা যদি বাংলা সাহিত্য বা লেখা আমাদের ভাষায় অনুবাদ করি এবং প্রচার করি, তবে বাংলা ভাষার অলংকারগুলো আমাদের ভাষা বিকাশে আরও বড় ভূমিকা রাখবে।”
সবার সহযোগিতায় নিজের এই অনুবাদের বইটি প্রকাশ পাবে, সেই আশায়ই এখন বসে আছেন যুবরাজ।