আগুন নেভানোর সরঞ্জামের দামেও ‘আগুন’

ডলার সংকটে আমদানি বিঘ্নিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আমদানির অগ্রাধিকার তালিকায় অগ্নি নির্বাপণ সরঞ্জাম নেই। তবে অগ্নি দুর্ঘটনা বছর বছর কেবল বাড়ছেই।

কাজী মোবারক হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 March 2023, 07:04 PM
Updated : 5 March 2023, 07:04 PM

ইউক্রেইন যুদ্ধের মধ্যে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন, আমদানিতে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধিসহ নানা কারণে ‘আগুন’ লেগেছে আগুন নেভানোর সরঞ্জামের বাজারে। উপকরণ ভেদে দাম বেড়েছে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত।

ডলার সংকটে এলসি খুলতে না পারার সমস্যার কথা জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এ কারণে উপকরণ আমদানিতেও বিঘ্ন ঘটছে। ফলে বেড়ে গেছে দাম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, অগ্নি নির্বাপণ উপকরণকে আমদানির ‘অগ্রাধিকার তালিকা’য় রাখা হয়নি; যদিও ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে বছর বছর দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছেই। বাড়ছে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতিও।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, আলোচিত কয়েকটি দুর্ঘটনার পর থেকে বাজারে অগ্নি নির্বাপন উপকরণ কিনত মানুষ বেশি আসছে বটে, তবে দামের কারণে বিক্রি ‘কম হচ্ছে’। পাঁচটি উপকরণ কিনতে এসে দাম দেখে তিনটি নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

কার্বনডাই অক্সাইড, ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার, ফোম এক্সটিঙ্গুইশার, ডি এক্সটিঙ্গুইশার, ফায়ার বলের মত অগ্নিনির্বাপক উপকরণ ছাড়াও, ভাল্ব, নজেল, ফায়ার এলার্ম, হিট ডিটেক্টর, বল পয়েন্টসহ প্রায় ৫০ রকমের উপকরণ বিক্রি হয় দেশে।

এসব উপকরণের মূল বাজার পুরান ঢাকার নবাবপুরে। শহরের কোথাও কোথাও বিভিন্ন দোকানে বিক্রি হলেও বৈচিত্র্য থাকে কম। তাই ক্রেতার ভিড় নবাবপুরেই।

দেশের বেশ কিছু এলাকায় বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর পোশাক কারখানা, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি- বেসরকারি অফিস, এমনকি বাসাবাড়ির জন্য অগ্নিনির্বাবক উপকরণ কিনতে আগ্রহীদের আনাগোনা বেড়েছে এ বাজারে।

ক্রেতা বাড়লেও বিক্রি কমার ব্যাখ্যায় ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগে যেসব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি ১০ থেকে ১৫টি সরঞ্জাম সংগ্রহ করতেন, দাম বাড়ায় তারা এখন পাঁচ থেকে ছয়টি সংগ্রহ করছেন।

দাম কত বাড়ল

নবাবপুরের ফারুক মিল স্টোরের মালিক আতিকুল ইসলাম সৌম্য জানালেন, মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে তারা আগের মত এলসি করতে পারছেন না। তারপরও দাম মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল, গত বছর ডলার সঙ্কট শুরুর পর থেকে দাম অনেক বেশি বাড়তে থাকে। 

দাম কতটা বেড়েছে জানতে চাইলে ‘ইলেকট্রনিক্স সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ নামে বিক্রেতাদের একটি সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়াজ আলী চিশতি বললেন, এক বছরে দাম ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়েছে; ক্ষেত্র বিশেষে তার চেয়েও বেশি।

তার ভাষায়, গতবছর যেটা ৯০০ টাকা বিক্রি হত, সেটা এখন ১৫০০ টাকা। যেটা ১ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হত, সেটা এখন ২ হাজার ৭০০ টাকা।

নবাবপুরের বিভিন্ন দোকানে গিয়ে দেখা যায়, দুই লিটারের ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশারের দাম বেড়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আর ৫ লিটারের বেড়েছে ৫০০ বা তার চেয়ে বেশি।

আতিকুর রহমান সৌম্য জানালেন, পাঁচ লিটার কার্বন ডাই অক্সাইডের দাম আগে ছিল ২ হাজার ৩০০ টাকা, এখন ৩ হাজার ২০০ টাকা।

ভাল্ব আগে ছিল ১৫০ টাকা। সেটি এখন বিক্রি হচ্ছে আড়াইশতে। নজেল বিক্রি হত ৫০ টাকায়, এখন দাঁড়িয়েছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়। ফায়ার এলার্মের দাম আগে ছিল ৩০০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়।

সৌম্যের তথ্য বলছে, শতকরা হিসেবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে হিট ডিটেক্টরের দাম। গত বছর এই সময়ে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হত এ সরঞ্জামটি। দ্বিগুণ হয়ে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা হয়ে গেছে এখন।

আরেক ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বললেন, “যে ফায়ার বলের দাম ছিল ৪৫০ টাকা, সেটি এখন আমরা বিক্রি করছি ৭০০ করে। ১ হাজার টাকা থেকে ১২০০ টাকার ফায়ার বল এখন ১৫শ থেকে ১৬শ টাকা।” 

বাড়তি দাম ‘গলার কাঁটা’

দাম বাড়লেও বিক্রেতা সৌম্য খুশি নন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বিক্রি কমে গেছে ৫০ শতাংশ। আমরা আমদানি করতে পারছি না, আগের মাল বিক্রি করতে হচ্ছে। যে ২০টা চাচ্ছে তাকে পাঁচটা দিচ্ছি। এভাবে তো ব্যবসা হয় না।”

পূর্বাচল মেশিনারিজ মার্কেটের হাইটেক করপোরেশনের মালিক মিজানুর রহমান বলেন, “ঢাকা শহর তো ঝুঁকিপূর্ণ। তাই অগ্নি নির্বাপণ উপকরণ খুবই জরুরি। কিন্তু দ্রবমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের হাতে টাকা কম। আবার বেড়েছে উপকরণের দাম। ফলে বিক্রি কমেছে।”

বিক্রি কমার পেছনে ‘দাম বৃদ্ধি’ যে একটি কারণ, তা উপকরণ কিনতে আসা নারিন্দার বাসিন্দা ওয়াহিদুল হাসানের বক্তব্যেই স্পষ্ট। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি গুলশানের একটি ১৩ তলা আবাসিক ভবনে আগুনের ঘটনার পর অগ্নি নির্বাপক সরঞ্জামের খেঁজে বাজারে এসেছেন তিনি।

ওয়াহিদুল বলেন, “আমার চার তলা বাড়ি। চারটা এক্সটিঙ্গুইশার দরকার ছিল; ভেবেছিলাম ১২০০ টাকা করে পড়বে, এসে দেখি দেড় হাজারের নিচে দেয় না। এখন যা বাজেট, তিনটা নিয়ে যাচ্ছি।”

কেন বাড়ল দাম

অগ্নি নির্বাপণ উপকরণ বিক্রেতাদের সমিতি ‘ফায়ার ফাইটিং ইকুইপমেন্ট বিজনেস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র সভাপতি আবুল হাসনাত লরেল বলেন, “ডলার সংকটে এলসি বন্ধ হয়ে গেছে। এলসি করতে হলে শতভাগ মার্জিন দিতে হবে। এত টাকা দিয়ে ব্যবসায়ীরা আমদানি করছে না। ফলে দাম বাড়ছে। আমরা কথা বলছি সরকারের সঙ্গে। একটা সমাধান আশা করছি।”

‘ইলেকট্রনিক্স সেইফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ নামে অন্য একটি সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়াজ আলী চিশতি বলেন, “কেউ কেউ আনতে পারছেন, তবে বিশেষ করে ছোট খাটো ব্যবসায়ীরা এলসি করতে পারছেন না। আগে আনতেন ১০ জন, এখন আনেন দুই জন। এলসি করতে তিন থেকে চার মাস লেগে যায়, যার কারণে দাম বেড়ে গেছে।”

আমদানি কত?

বছরে কী পরিমাণ অগ্নিনির্বাপক উপকরণ আমদানি হয় জানতে চাইলে নিয়াজ আলী চিশতি কোনো ধারণা দিতে পারলেন না।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমার মত অনেকই আমদানি করেন। তবে কে কী পরিমাণ আমদানি করেন, এর হিসাব আমরা আলাদাভাবে রাখি না, যার যার মালের হিসাব তিনিই রাখেন। তাছাড়া হার্ডওয়ার বা ইলেকট্রিক পণ্যের আমদানিকারকরাও আনেন। ফলে হিসাব রাখা আসলে কঠিন।”

বছরে আমদানির পরিমাণ নিয়ে ধারণা দিতে পারেননি আরেক ব্যবসায়ী নেতা আবুল হাসনাত লরেলও। তিনি বলেন, “এটার সঠিক হিসাব আমাদের কাছে নেই।”  

নিরাপত্তা সরঞ্জাম নেই আমদানির অগ্রাধিকার তালিকায়

ডলারের সংকটে আমদানি বিঘ্নের বিষয়ে ব্যবসায়ীদের দেওয়া বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, পণ্য আমদানিতে অগ্রাধিকার তালিকায় অগ্নি নিরাপত্তা সরঞ্জাম নেই। তাই শতভাগ মার্জিন দিয়ে এ পণ্য আমদানি করতে হবে।

বাজারে ডলার সংকটের বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “বাজারে ডলারের ক্রাইসিস রয়েছে- এমন কোনো তথ্য কোনো ব্যাংক জানায়নি।”

অগ্নিনির্বাপক উপকরণের দাম বৃদ্ধি ও আমদানিতে বিঘ্নের বিষয়ে এক প্রশ্নে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) লেফটেনেন্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অগ্নিনির্বাপক উপকরণ মানুষের আগ্রহ এখন বেশি। আমদানি যেন বিঘ্নিত না হয়, সেটি নিশ্চিত করা উচিত।”

ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক, বাড়ছে বছর বছর

বাংলাদেশ ব্যাংক অগ্নি নির্বাপণ উপকরণকে আমদানির অগ্রাধিকারের তালিকায় না রাখলেও ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান বলছে, বছর বছর ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছেই।

২০২২ সালের তথ্য বলছে, ১২ মাসে দেশে ২৪ হাজার ১০২টি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ৯৮ জনের। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ১৩ জন। বাহিনীটির হিসাবে এসব ঘটনায় ৩৪২ কোটি ৫৮ লাখ ৫১ হাজার ৩৮৯ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়।

আগের বছর দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ৬০১টি, প্রাণ হারায় ২১৯ জন। সে বছর সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে আবাসিক ভবনে, যার সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৮১৮টি।

রান্নাঘর থেকেই আগুন লাগে ৩ হাজার ৫৪৪টি। পোশাক শিল্প ছাড়া অন্যান্য কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ছিল ৩৮২টি। ফায়ার সার্ভিসের হিসেবে ওই বছর আর্থিক ক্ষতি ছিল ৩৩০ কোটি টাকারও বেশি।

২০২০ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ৭৩টি। মৃত্যু হয় ১৫৪ জনের। এতে কাগজে কলমে ক্ষয়ক্ষতি ছিল দুই শ কোটি টাকার মতো।