ইতোমধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ পিছিয়েছে ১১৪ বার।
Published : 14 Jan 2025, 02:57 PM
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলায় চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান এবং সাময়িক বরখাস্তকৃত অতিরিক্ত ডিআইজি মশিউর রহমানকে জেলগেইটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
তদন্তকারী সংস্থাটির আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ৮ জানুয়ারি এ আদেশ দেন ঢাকার মহানগর হাকিম ইমরান আহম্মেদ।
তাদের জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চেয়ে সেদিন আবেদন করেছিলেন পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজিজুল হক।
এই তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, “এ মামলার তদন্তের স্বার্থে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে এখনো জিয়াউল ও মশিউরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। তবে শিগগিরই জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ে রদবদলের ধারাবাহিকতায় গত ৬ অগাস্ট জিয়াউল আহসানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সবশেষ তিনি টেলিযোগাযোগ নজরদারির জাতীয় সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হকার শাহজাহানকে হত্যার অভিযোগে ঢাকার নিউ মার্কেট থানার মামলায় ১৫ অগাস্ট রাতে খিলক্ষেত থেকে জিয়াউল আহসানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে তিনি কারাগারে আছেন।
আর নিউ মার্কেট থানার হত্যা মামলায় পুলিশ কর্মকর্তা মশিউর রহমান গ্রেপ্তার হন গত ১৯ সেপ্টেম্বর। ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার ‘দাপুটে ডিসি’ হিসেবে পরিচিত এই কর্মকর্তা দীর্ঘদিন গুলশান বিভাগে দায়িত্ব পালন করেন। ২০২২ সালে তাকে গুলশান বিভাগ থেকে সরিয়ে লালবাগ বিভাগের (গোয়েন্দা) দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পরে তিনি অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। সরকার পতনের পর তাকে ডিবি থেকে চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া করা বাসায় খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর ও রুনি।
সাগর সে সময় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল মাছরাঙা টিভিতে আর রুনি এটিএন বাংলায় কর্মরত ছিলেন। হত্যার ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলী রোমান শেরেবাংলা থানায় মামলা করেন।
ওই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন এক যুগেও দাখিল হয়নি। আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ পিছিয়েছে ১১৪ বার। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ২৭ জানুয়ারি দিন ঠিক করেছে আদালত।
গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত ৩০ সেপ্টেম্বর মামলার তদন্তের দায়িত্ব থেকে র্যাবকে বাদ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে সেদিন উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠন করে এ তদন্ত কাজ সম্পন্ন করতে ছয় মাস বেঁধে দেয় হাই কোর্ট।
এর তিন সপ্তাহ বাদে গত ২৩ অক্টোবর আলোচিত এ হত্যা মামলার তদন্ত কাজ শেষ করতে টাস্কফোর্স গঠন করে সরকার।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সংশ্লিষ্ট পরিপত্রে বলেছে, “ছয় মাসের মধ্যে টাস্কফোর্স তার প্রতিবেদন হাই কোর্টে দাখিল করবে। টাস্কফোর্স প্রয়োজনে সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবে।”
২০১২ সালে সাগর-রুনিকে হত্যার রাতে সেই ফ্ল্যাটে তাদের সঙ্গে ছিল একমাত্র সন্তান পাঁচ বছর বয়সী মাহির সরওয়ার মেঘ। তাকে উদ্ধৃত করে পুলিশ তখন জানিয়েছিল, খুনি ছিল দুজন।
আলোড়ন সৃষ্টি করা ওই হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর বছরের পর বছর গড়ালেও হত্যা রহস্যের কিনারা হয়নি।
হত্যার পর রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন রুনির ভাই নওশের রোমান। বিভিন্ন সময়ে মোট আটজনকে এ মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। পরে দুজন জামিনও পান।
তারা হলেন- রুনির বন্ধু তানভীর রহমান, বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবির, রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু ওরফে মাসুম মিন্টু, কামরুল হাসান অরুন, পলাশ রুদ্র পাল, তানভীর ও আবু সাঈদ।
প্রথমে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ আলোচিত এ হত্যা মামলার তদন্তে নামে। চার দিন পর তদন্তের ভার দেওয়া হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে।
তারা রহস্যের কিনারা করতে না পারায় হাই কোর্টের নির্দেশে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল তদন্তভার র্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
দায়িত্ব পেয়ে ডিএনএসহ অন্যান্য বায়োমেট্রিক পরীক্ষার জন্য ঘটনাস্থল থেকে বটি, পরিধেয় কাপড়সহ বেশ কিছু বস্তু পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবেও পাঠায় র্যাব। কিন্তু এতদিনেও তার ফল প্রকাশ করা হয়নি।
তদন্ত প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা নিহত সাংবাদিক দম্পতির পরিবার এবং পেশাজীবীদের মধ্যে হতাশা ও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এই মামলার দ্রুত ন্যায়বিচার পাওয়ার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।
এর আগে বিভিন্ন সময় সাবেক সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এই হত্যাকাণ্ডের কূলকিনারা করার আশা দিলেও সুফল মেলেনি।
শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার পতন হলে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এই হত্যার বিচারের আশ্বাস দিয়ে বলেন, এই বিচার করা না হলে তারা জাতির কাছে দায়ী থাকবেন।
আর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ গত ২১ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে বলেন, “আমরা দেখেছি চাঞ্চল্যকর সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত রিপোর্ট দেওয়ার জন্য ইতোমধ্যে শতাধিকবার সময় নেওয়া হয়েছে। এটা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না।
“তদন্ত কাজেই যদি একাধিক বছর সময় লেগে যায়, সে মামলার বিচারকাজ পরিচালনা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। কেননা সময়ের আবর্তে মামলার অনেক সাক্ষী ও সাক্ষ্য হারিয়ে যায়।”