”আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে, দ্রুততার সঙ্গে এর কাজ শুরু হওয়া। আমরা চাই, মানুষের কষ্ট লাঘব হোক; আমরা প্রস্তুত আছি,” বলেন তিনি।
Published : 19 Feb 2025, 12:35 AM
তিস্তা নদীকে ঘিরে একটি প্রকল্প শুরুর বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সাড়া পেতে দুই বছর ধরে অপেক্ষায় থাকার কথা তুলে ধরে ‘মানুষের কষ্ট লাঘবে’ দ্রুততার সঙ্গে সেই কাজে নেমে পড়ার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন।
তিস্তা নদী রক্ষার দাবিতে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায় ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি চলার মধ্যে মঙ্গলবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “তিস্তা পাড়ের মানুষের ঝামেলার কথা আমরা জানি; তারা চায় এই প্রকল্প দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন হোক। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে কাজ অব্যাহত রাখবে চীন। আমরা তাদের উত্তরের অপেক্ষায় আছি, যাতে চীন এই প্রকল্পে সহায়তার প্রক্রিয়াগুলো শুরু করতে পারে।
“আমি তিস্তাপাড়ের মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখতে পাচ্ছি। আমরা চাই এ প্রকল্পের কাজ দ্রুত শুরু হোক, সেটা চীন করুক বা বাংলাদেশ করুক। যাতে মানুষ এটা থেকে উপকার পায়। আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে, দ্রুততার সঙ্গে এর কাজ শুরু হওয়া। আমরা চাই, মানুষের কষ্ট লাঘব হোক; আমরা প্রস্তুত আছি।”
ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি আটকে থাকার মধ্যে ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট’ শীর্ষক এ প্রকল্প হাতে নেয় বাংলাদেশ সরকার।
২০১৯ সালের জুলাইয়ে বেইজিং সফরে এটিসহ আরও কয়েকটি প্রকল্পে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সরকারের সহায়তা চেয়েছেন বলে ওেই সময় সংবাদমাধ্যমে খবর আসে।
তিস্তা প্রকল্পে নদীটির উপকূল ব্যবস্থাপনায় অবকাঠামো নির্মাণ ছাড়াও বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং গ্রীষ্মকালে পানি সংকট দূর করতে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে বলে সেসময় এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল বিবিসি।
এ প্রকল্পে চীনা কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার বিষয়ে ঢাকাকে নয়া দিল্লির উদ্বেগ জানানোর মধ্যেই বেইজিং প্রায় ১০০ কোটি ডলারের আনুষ্ঠানিক প্রকল্প প্রস্তাব জমা দেয়।
এর মধ্যেই ২০২৪ সালের মে মাসে ঢাকা সফরে এসে তিস্তা প্রকল্পে অর্থায়নে ভারতের আগ্রহের কথা জানান দেশটির তখনকার পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা। এরপর জুনে শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় তিস্তা মহাপরিকল্পনায় দেশটি যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখায়।
এর অংশ হিসেবে ভারতের একটি কারিগরি দল দ্রুত বাংলাদেশ সফর করবে বলে শেখ হাসিনার সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
সেই আলোচনার মাসখানেকের মাথায় ৫ অগাস্ট ঢাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের; দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে যান তিনি। সেই থেকে তার সেখানে অবস্থান করার মধ্যে নানা ইস্যুতে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে টানাপোড়েন চলছে দিল্লির।
‘তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন’ সোমবার থেকে উত্তরের পাঁচ জেলায় ৪৮ ঘণ্টার এই অবস্থান কর্মসূচির আয়োজন করে। মূলত বিএনপির নেতৃত্বে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলায় এ আন্দোলন হচ্ছে।
সোমবার কর্মসূচির উদ্বোধন করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং মঙ্গলবার সমাপনী অধিবেশনে বক্তব্য দেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
এর মধ্যে মঙ্গলবার বিকালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের বেইজিং সফর এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তিতে দুদেশের সম্পর্ক নিয়ে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে আসেন রাষ্ট্রদূত ইয়াও।
সংবাদ সম্মেলনে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নে এর সঙ্গে চীন সরকারের সম্পৃক্ততার নানা দিক তুলে ধরেন তিনি।
ইয়াও ওয়েন বলেন, তিস্তা রিভার কম্প্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট (টিআরসিএমআরপি) দুদেশের সরকারের সঙ্গে সরকারের (জিটুজি) প্রকল্প। চীনা ঋণে এটা বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকার চীনের সহায়তা চেয়েছে।
প্রকল্পের আদ্যোপ্রান্ত তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা অনেক বছর আলোচনা করেছি। মূলত, ২০২১ সালে বিগত সরকারের সময় থেকে আমরা অনুরোধ পেয়েছি। এরপর আমরা বাংলাদেশ থেকে প্রকল্প পেয়েছি।
“তবে আমাদের মূল্যায়নে এটা বিশাল প্রকল্প। এ কারণে আমরা বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছি ধাপে ধাপে করার জন্য। প্রথম ধাপ হিসেবে ‘বন্যা প্রতিরোধ ও মোকাবেলা প্রকল্পের’ পরামর্শ দিয়েছিল চীন। আমরা ২০২৩ সালে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) ফিডব্যাক দিয়েছি।”
এরপর দুবছর পার হলেও বাংলাদেশের দিক থেকে ‘প্রতিউত্তর’ না পাওয়ার তথ্য তুলে ধরে রাষ্ট্রদূত ইয়াও বলেন, “সুতরাং আমরা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই প্রকল্পের বিষয়ে উত্তর পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছি।”
তিস্তা প্রকল্প যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়নে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “কেননা, এটা তিস্তা পাড়ের মানুষের জন্য, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
“আমি বলতে চাই, এটা বাংলাদেশের প্রকল্প, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এটা সম্পূর্ণভাবে আপনাদের আওতাধীন। সুতরাং প্রকল্পটি নিয়ে কীভাবে কাজ হবে, তার জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।”
এর মধ্যে একটি চীনা কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশের পানি সম্পদের ‘সুরক্ষা ও সংরক্ষণ’ নিয়ে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেছিল পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। ২০২৪ সালে মেয়াদ শেষ হওয়ায় ওই এমওইউ নবায়নের কথা বলছে অন্তর্বর্তী সরকার।
তিস্তা প্রকল্পে নিয়ে করা এক প্রশ্নে এ সমঝোতা স্মারককে পৃথক হিসেবে দেখার কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রদূত ইয়াও বলেন, “এমওইউর বিষয়টি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং একটি চীনা কোম্পানির মধ্যে। এটা কয়েক বছর আগে সই হয়েছে।
“সম্প্রতি এই এমওইউ নবায়নের আলোচনা হচ্ছে, হয়ত সেখানে বিষয়বস্তুর কিছুটা এদিকওদিক করা হবে। এটা বাংলাদেশের পানি সম্পদ সুরক্ষার বিষয়ে। এটা কেবল তিস্তা নদী নিয়ে নয়, বরং বাংলাদেশের পানি সম্পদের সুরক্ষা ও সংরক্ষণ বিষয়ে। আমরা মনোযোগ জিটুজি প্রকল্প নিয়ে, কেননা এখানে সরাসরি চীন সরকার জড়িত।”
বাংলাদেশে সংস্কারে সহায়তার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ”এটা সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমাদের প্রত্যাশা বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক অংশীজন কাজটা করবে।
“এবং আমরা সংস্কার ও নির্বাচনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সফলতা কামনা করি। আমরা দেখতে চাই বাংলাদেশ ঐক্য, উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।”
কুনমিংয়ের ৩ হাসপাতলে বাংলাদেশিদের চিকিৎসা শুরু মার্চে
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবে চীনের কুনমিং শহরের তিনটি হাসপাতালকে বাংলাদেশি রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে দেশটির সরকার।
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নে রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, “চীন ইতোমধ্যে কুনমিংয়ের তিনটি হাসপাতালকে বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। আমি গতকালকেই ওই তিন হাসপাতালের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভার্চুয়াল সভা করেছি। সেখানে বাংলাদেশিদের চিকিৎসার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে।”
হাসপাতালগুলো হচ্ছে- দ্য ফার্স্ট পিপলস হসপিটাল অব ইউনান প্রভিন্স, দ্য ফার্স্ট অ্যাফিলিয়েটেড হসপিটাল অব কুনমিং মেডিকেল ইউনিভার্সিটি এবং চাইনিজ একাডেমি অব মেডিকেল সায়েন্সেস এর ‘ফুয়াই ইউনান হসপিটাল’।
বাংলাদেশি রোগীদের জন্য মেডিকেল সার্ভিস ব্যবস্থাপনাকে উন্নীতকরণ, চিকিৎসা প্রক্রিয়া স্পষ্টকরণ এবং দোভাষী দল তৈরিতে কাজ চলার কথাও বলেন চীনা রাষ্ট্রদূত। তবে কুনমিংয়ে চিকিৎসার ক্ষেত্রে খরচের বিষয়ে ধারণা দিতে পারেননি তিনি।
রোগীদের জন্য একদিনেই ভিসার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, “কোনো একটি হাসপাতাল থেকে যদি ক্লিয়ারেন্স নিয়ে আসে, আমাদের দূতাবাস আবেদন জমা দেওয়ার দিনই ভিসা দিয়ে দেবে।“
বাংলাদেশ ট্রাভেল এজেন্টদের এর সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “তারা রোগীদের প্যাকেজ সার্ভিস চালু করবে। তাদের সেই প্যাকেজে ভিসা, বিমান টিকেট, কুনমিংয়ে থাকার জায়গা, খাবার এবং চিকিৎসার খরচ অন্তর্ভুক্ত থাকবে।”
চলতি মাসের শেষ দিকে বাংলাদেশি ট্রাভেল এজেন্ট, চিকিৎসক, রোগীদের একটি দল কুনমিংয়ে যাওয়ার তথ্যও দেন তিনি। বলেন, তারা চিকিৎসার পাশাপাশি হাসপাতালের পরিবেশ দেখতে পাবে।
চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে টিকেটের দামে ছাড় পাওয়ার কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রদূত বলেন, চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স বাংলাদেশি রোগীদের সবচেয়ে কম মূল্যে টিকেট দেবে, যদি একসঙ্গে ১০ জনের দল পাওয়া যায়। চীনে এমন বড় সংখ্যায় বিদেশি রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা আগে কখনও হয়নি। ফলে, এক্ষেত্রে প্রথমদিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে।
এদিকে ঢাকায় বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বাংলাদেশের কাছ থেকে প্রকল্প প্রস্তাব এবং হাসপাতালের অবকাঠামো সংক্রান্ত পরিকল্পনার জন্য অপেক্ষায় থাকার কথা বলেন রাষ্ট্রদূত।
তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীনের পর এবার ভারতের প্রস্তাব
তিস্তা পাড়ে মানুষের মুখে মুখে পানির ন্যায্য হিস্যার স্লোগান
তিস্তা পাড়ে দিনভর মানুষের ঢল, 'আগে ছিল আশীর্বাদ, এখন অভিশাপ'