এবার বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে পিবিআই প্রধানের মামলা

হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগে বাবুলের করা মামলার আবেদন খারিজ হওয়ার দুই দিনের মাথায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ মামলা করলেন অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Sept 2022, 02:35 PM
Updated : 27 Sept 2022, 02:35 PM

চট্টগ্রামের মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যাকাণ্ড নিয়ে ‘মিথ্যা ও অসত্য তথ্য’ প্রচার করার অভিযোগে তার স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার, তার বাবা, ভাইসহ চারজনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান বনজ কুমার মজুমদার।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকার ধানমণ্ডি থানায় এ মামলা করা হয় বলে পিবিআইয়ের এক বার্তায় জানানো হয়।

মামলার আসামিরা হলেন: বাবুল আক্তার, তার বাবা আব্দুল ওয়াদুদ, ভাই হাবিবুর রহমান লাবু এবং প্রবাসী ইউটিউবার ইলিয়াছ হোসাইন, যিনি এক সময় দেশে সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলেন।

মিতু হত্যা মামলায় ‘স্বীকারোক্তি আদায়ে’ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ তুলে এর আগে পিবিআই প্রধানসহ ছয় পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলার আবেদন করেছিলেন বাবুল আক্তার।

সেই আবেদন আদালত খারিজ করে দেওয়ার দুই দিনের মাথায় বাবুলের বিরুদ্ধে এ মামলা করলেন অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার।

ছয় বছর আগে মিতু হত্যার ঘটনায় তার স্বামী বাবুল আক্তার যে মামলা করেছিলেন, সেই মামলায় তার বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র দিয়েছে পিবিআই। ২০২১ সালের মে মাসে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে তিনি কারাগারে আছেন।  

পিবিআই প্রধানের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, কারাগারে আটক থাকা সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা মামলার তদন্ত ‘ভিন্নখাতে প্রবাহিত করাসহ’ বাংলাদেশ পুলিশ ও পিবিআইয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য দেশে ও বিদেশে অবস্থারত আসামিদের নিয়ে ‘অপরাধমূলক বিভিন্ন অপকৌশল এবং ষড়যন্ত্রের’ আশ্রয় গ্রহন করছেন।

এ মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে প্রবাসী ইউটিউবার ইলিয়াছ হোসাইনকে। এরপরেই বাবুল আক্তারের ভাই, তার বাবা এবং শেষে বাবুল আক্তারকে রাখা হয়েছে আসামির তালিকায়।

যা আছে মামলায়

এজাহারে বলা হয়েছে, “বাবুল আক্তার, তার ভাই ও বাবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্ররোচনায় কথিত সাংবাদিক ইলিয়াছ হোসাইন বিদেশে পলাতক থাকা অবস্থায় গত ৩ সেপ্টেম্বর তার ফেইসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে ‘স্ত্রী খুন, স্বামী জেলে: খুনি পেয়েছে তদন্তের দায়িত্ব’ শিরোনামে ৪২মিনিট ২১ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ক্লিপ প্রকাশ করেন।

“ওই ভিডিওতে বিভিন্ন মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্যের মাধ্যমে তদন্তাধীন মিতু হত্যা মামলার তদন্তকে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করাসহ তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার লক্ষ্যে প্রচার করা হয়।”

পিবিআইপ্রধান বলছেন, “দেশের ভাবমূর্তি এবং দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার উসকানি, বাংলাদেশ পুলিশ এবং পুলিশের বিশেষায়িত তদন্ত সংস্থা পিবিআই ও বিশেষ করে আমার মান-সম্মান ও সুনাম ক্ষুণ্ন করার জন্য মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করেছে আসামিরা। যার জন্য দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে।”

প্রচারিত ভিডিওর কয়েকটি অংশ উদ্ধৃত করে বনজ কুমার মজুমদার মামলায় বলেছেন, “ইলিয়াছ হোসাইন পুলিশকে ‘ভারতীয় বাহিনী’, মুসলমান পুলিশ সদস্যরা ‘সংখ্যালঘু’, ‘চামার কুমারদের দাপটে দাড়ি টুপি ওয়ালারা খুবই অসহায়’– এ ধরনের মন্তব্য করেছেন।

“যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি এবং বাংলাদেশের সাথে বন্ধুপ্রতীম দেশ ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করার, রাষ্ট্রের হিন্দু- মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা, বিদ্ধেষ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট এবং অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপপ্রয়াস করা হয়েছে।”

পিবিআই প্রধান তার মামলায় বলেছেন, ২০১৬ সালে ২৫ জানুয়রি চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারের বাহার মার্কেটে স্বর্ণের গুদামে অভিযান চালানো নিয়ে ইলিয়াছ তার ইউটিউবে প্রচার করেছেন যে, বাবুল আক্তার সেখানে অভিযান চালান এবং বনজ কুমার মজুমদার ফোন করে অভিযান বন্ধ করতে বলেন। সেই সাথে ৫০ লাখ থেকে কোটি টাকা ঘুষের প্রস্তাব দেওয়া হয় বাবুল আক্তারকে।

“অভিযানে বাবুল আক্তারের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান ছিল না এবং সে অত্র মামলার বাদী, সাক্ষী কিংবা তদারকি অফিসারও ছিলেন না। তবে জানা গেছে, বাবুল আক্তার অভিযানের শেষ মুহূর্তে হাজির হয়েছিলেন।” 

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে যে সময়ের কথা ওই ভিডিওতে বলা হয়েছে, সেসময় বনজ কুমার মজুমদার চট্রগ্রামে কোনো দায়িত্বে ছিলেন না, কর্মরত ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশে যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক দক্ষিণ) হিসেবে।

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রামের পুরাতন টেলিগ্রাফ রোডের বাসার সামনে থেকে মৃদুল চৌধুরী নামের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে অপহরণের ঘটনা ধরে ইলিয়াছ তার ভিডিওতে দাবি করেন, ওই ব্যবসায়ীকে বাবুল আক্তার উদ্ধার করেন। সে সময় চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার বনজ কুমার মজুমদার এবং একজন সাংবাদিকসহ একটি ‘বিশেষ ধর্মের’ বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা ওই ঘটনায় ‘জড়িত’।

ওই তথ্য সম্পর্ণ মিথ্যা, ভিত্তিহীন দাবি করে পিবিআই প্রধান মামলায় বলেছেন, “মূলত সিএমপির কোতোয়ালি থানার এসআই কামরুজ্জামান সেদিন মৃদুল চৌধুরীকে কুমিল্লার বুড়িচং এলাকা থেকে উদ্ধার করেন। আর বাবুল আক্তার এটার সাথে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত ছিলেন না।

পিবিআইতে বনজ কুমারকে ‘মুকুটহীন সম্রাট’ আখ্যায়িত করে পুলিশের একজন নারী কর্মকর্তাকে জড়িয়ে মন্তব্য করা হয় ইলিয়াসের ভিডিওতে। সে বিষয়টি তুলে ধরে বনজ কুমার তার এজাহারে বলেছেন, “আসামি বাবুল আক্তার সুস্থ মস্তিস্কে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে খুন করে খুনের ঘটনাকে আড়াল করার জন্য সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন বক্তব্যগুলোর মাধ্যমে জনসম্মুখে আমার মানহানি ও পিবিআই এর মত একটি বিশেষায়িত তদন্ত সংস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপপ্রয়াস করেছে।”

বাবুল আক্তারের ভাই হাবিবুর রহমান লাবুর বক্তব্যও ইলিয়াসের ওই ভিডিওতে দেখানো হয়। সেখানে তিনি অভিযোগ করেন, পিবিআই বাবুলকে ‘নির্যাতন করে বিভিন্ন বইয়ের পাতায় এবং সাদা কাগজে পিবিআই এর বলা কথা লিখতে বাধ্য করেন’ এবং বনজ কুমার ‘পরিকল্পিতভাবে বাবুল আক্তারকে ফাঁসানোর চেষ্টা’ করেছেন।

বনজ কুমার তার মামলায় বলেছেন, বাবুল আক্তারকে একজন নারী এনজিও কর্মকর্তা ২৯টি এসএমএস পাঠিয়েছিলেন, যা মিতু দেখে ফেলায় বাকবিতণ্ডা হয়। এর জেরে হত্যা করা হয় মিতুকে।

“খুনের ঘটনাকে আড়াল করার জন্য আসামি ইলিয়াস হোসাইনকে দিয়ে বানানো ওই ভিডিওতে সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন বক্তব্য প্রদান করেছেন লাবু।”

বনজ কুমার মজুমদার মামলায় বলেন, “ওই চারজনসহ অজ্ঞাতপরিচয় আসামিরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ২৫()/২৮(২)/২৯/৩১(২) ততসহ ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৬(২) ও ২৫(উ) ধারায় অপরাধ করেছেন।”

Also Read: মামলা আর নিরাপত্তা: বাবুল আক্তারের দুই আবেদনই খারিজ

Also Read: মিতু হত্যা: বাবুল আক্তারের মামলায় তার বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র

Also Read: এবার কারাগারে ‘জীবনের নিরাপত্তা’ চেয়ে বাবুল আক্তারের আবেদন

Also Read: পিবিআই প্রধানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে ‘হেফাজতে নির্যাতনের’ অভিযোগ বাবুল আক্তারের

Also Read: বাবুল আক্তার ‘অত্যন্ত চতুর’: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

বাদী থেকে আসামি

২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় মিতুকে প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

হত্যাকাণ্ডের পর নগরীর পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে একটি মামলা করেছিলেন সে সময় পুলিশ সুপার পদে থাকা বাবুল আক্তার।

মিতু হত্যা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে খোদ বাবুলের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়ে ২০২১ সালের ১২ মে তার করা মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পিবিআই। এরপর সেদিনই বাবুলসহ ৯ জনকে আসামি করে নতুন হত্যা মামলা করেন মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন।

আইনি জটিলতার কারণে এ বছরের ২৫ জানুয়ারি মোশাররফ হোসেনের করা মামলায় আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পিবিআই। ৬ মার্চ সেই চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে বাবুলের করা মামলার তদন্ত শেষ করতে বলে আদালত।

এরপর বাবুলকে প্রধান আসামি করে গত ১৩ সেপ্টেম্বর আাদালতে অভিযোগপত্র দেয় পিবিআই। সেখানে বলা হয়, ‘পরকীয়ার ঘটনা জেনে যাওয়ায়’ সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার তার ‘সোর্সদের দিয়ে’ স্ত্রী মিতুকে ‘খুন করান’ বলে উঠে এসেছে পিবিআইয়ের তদন্তে।

মামলার অন্য আসামিরা হলেন- মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম, আনোয়ার হোসেন, এহতেশামুল হক ভোলা, শাহজাহান মিয়া, কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুছা ও খায়রুল ইসলাম ওরফে কালু। এদের মধ্যে মুছা ও কালু পলাতক।

অভিযোগপত্র জমা পড়ার আগে আগে গত ৮ সেপ্টেম্বর পিবিআই প্রধানসহ ছয় পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলার আবেদন করেন বাবুল আক্তার।

অভিযোগে বলা হয়, মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যার ঘটনায় গত বছরের ১২ মে তার স্বামী বাবুল আক্তারের করা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পিবিআই। একই দিনে আরেকটি হত্যা মামলা করেন তার শ্বশুর। সে মামলায় বাবুলকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।

২০২১ সালের ১০ থেকে ১৭ মে পর্যন্ত ওই মামলায় তাকে ‘আটকে রেখে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য হ্যান্ডকাফ পরিয়ে, ঘুমাতে না দিয়ে, গোসল করতে না দিয়ে অজু করার পানি না দিয়ে নির্যাতন করার’ অভিযোগ আনা হয় বাবুলের আর্জিতে।

সেখানে বলা হয়, এক নম্বর আসামির (বনজ কুমার) ‘নির্দেশে’ বাবুলকে ‘অন্যায়ভাবে আটকে রেখে ভয়ভীতি দেখিয়ে লাঞ্ছনাকর আচরণ ও নির্যাতন’ করা হয়েছে। নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ এর ১৫(১) ও ৫ (২) ধারায় এ অভিযোগ করা হয় আর্জিতে।

বনজ কুমার মজুমদার ছাড়াও পিবিআইর চট্টগ্রাম জেলার এসপি নাজমুল হাসান, চট্টগ্রাম মহানগরের এসপি নাঈমা সুলতানা, পিবিআইর তৎকালীন পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা, পিবিআই চট্টগ্রাম জেলার সাবেক পরিদর্শক এ কে এম মহিউদ্দিন সেলিম ও পিবিআই পরিদর্শক কাজী এনায়েত কবিরকে সেখানে আসামি করা হয়।

বাবুলের মামলার আবেদনের পর কারাগারে তার নিরাপত্তা চেয়ে ১২ সেপ্টেম্বর আরেকটি আবেদন করা হয় আদালতে।

ওই মামলার আসামিদের ‘নির্দেশে ও প্ররোচনায়’ গত ১০ সেপ্টেম্বর দুপুরে ফেনী মডেল থানার ওসি নিজাম উদ্দিন ফেনী কারাগারে প্রবেশ করে বাবুল আক্তারের কক্ষে দীর্ঘ সময় ধরে তল্লাশি চালান বলে সেখানে অভিযোগ করেন বাবুল।

এ বিষয়ে শুনানি শেষে চট্টগ্রামের মহানগর দায়রা জজ জেবুননেছা বেগম গত ২৫ সেপ্টেম্বর বাবুলের দুটো আবেদনই খারিজ করে দেন।