এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করে এক মাসের মধ্যে প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছে।
Published : 04 Jul 2024, 10:55 PM
মেট্রোরেলের ভাড়ার ওপর ভ্যাট আরোপের পরও আদায়ের জটিলতা বিষয়ক প্রশ্নে সিদ্ধান্তে আসতে পারল না সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং অর্থ মন্ত্রণালয়।
দুই মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বসে উপায় খুঁজতে না পারার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদেরকে এক মাসের মধ্যে এই উপায় খুঁজতে বলা হয়েছে। ছোট অঙ্কের এই ভাড়ায় ভ্যাট আদায় সম্ভব কি না, সেই প্রশ্নেরও জবাব খুঁজবে তারা।
মেট্রোরেলে সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা আর সর্বোচ্চ ১০০ টাকা। ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ হলে এমআরটি পাস নিয়ে চলাচলকারী যাত্রীর কাছ থেকে ভ্যাটের অর্থ আদায় কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু যারা একক যাত্রার টিকেট কিনে চলাচল করেন, তাদের কাছ থেকে খুচরা অর্থ আদায় ভীষণ কঠিন। কারণ, বাজারে এক বা ২ টাকার এত নোটের প্রচলন নেই, আবার ভ্যাট আদায় হবে পয়সার হিসাবেও।
হিসাব নিকাশের এমন জটিলতার মধ্যে গত ১ জুলাই থেকে ভ্যাট মওকুফ সুবিধা প্রত্যাহার করে নিয়েছে এনবিআর। ফলে ভাড়ার ওপর থেকে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর হিসেবে দাবি করবে তারা।
গত ৪ এপ্রিল মেট্রোরেল পরিচালনাকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি- ডিএমটিসিএলকে চিঠি দিয়ে এনবিআর জানায়, জুলাই থেকে মেট্রোরেলের সেবা ও টিকিটে ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে, যদিও ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে যাত্রীদের কথা চিন্তা করে মেট্রোরেলের ভাড়ায় ভ্যাট অব্যাহতি দেয় রাজস্ব আদায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানটি।
স্বাভাবিকভাবে ধারণা ছিল, অর্থবছরের প্রথম দিন ১ জুলাই থেকে ভ্যাট হিসেবে বাড়তি অর্থ আদায় শুরু হবে। কিন্তু যাত্রীরা আগের ভাড়াতেই চলাচল করতে থাকে।
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক ও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী সেদিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, বৃহস্পতিবার তারা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেবেন।
এই বৈঠক হয়েছে, তবে ভ্যাট আদায় নিয়ে জটিলতা নিয়ে প্রশ্নের সমাধান হয়নি।
সচিব আমিন উল্লাহ নুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "খুচরা টাকা পয়সা তো আর মেশিন বুঝবে না। তাছাড়া ভ্যাট যুক্ত হওয়ার পর খুচরা টাকা পয়সা মেশিনের মাধ্যমে আদায় করা সহজ বিষয় না। তাই আমরা আন্তঃমন্ত্রণালয়ের একটি কারিগরি কমিটি করেছি।”
এ কমিটির প্রধান করা হয়েছে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালককে। এনবিআরের দুইজন, ডিএমটিসিএলের দুইজন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ও বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের একজনকে এর সদস্য করা হয়েছে।
সড়ক সচিব বলেন, “এই কমিটি একমাসের মাসের মধ্যে মেট্রোরেলের টিকিটের ওপর কীভাবে ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত করা যায় সে বিষয়ে প্রস্তাব দেবে। যদি ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত না করা যায়, সেক্ষেত্রে তারা ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রস্তাব করবে।”
এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব (মূসক বিধি) মো. বদরুজ্জামান মুন্সী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাষ্ট্রের স্বার্থেই এখানে ভ্যাট বসেছে। সরকারের রাজস্ব বাড়লেই কেবল সরকার মেট্রোরেলের মত অন্যান্য আরও জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাড়াতে পারবে। কোনো উপায়ে ভ্যাট আদায় করা যাবে সেটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।”
বর্তমান আইন বলছে, বর্তমান ভাড়া থেকেই মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে। আর মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ অনুযায়ী মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে ভ্যাটের টাকা অগাস্টের ১৫ তারিখের মাঝে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
জটিলতা যেখানে
বর্তমান ভাড়া অনুযায়ী সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা, এবং সর্বোচ্চ ১০০ টাকা। ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসলে সর্বনিম্ন ভাড়া কত হবে তা নিয়েও রয়েছে শঙ্কা।
মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ অনুযায়ী ভ্যাটের অর্থ ভাড়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হয়।
অর্থাৎ ডিএমটিসিএলের যদি বর্তমান অর্থ তাদের জন্য নিশ্চিত করতে হয় এবং এর সঙ্গে ১৫ শতাংশ টাকা যুক্ত থাকে, তাহলে সর্বনিম্ন ভাড়া হবে ২৩ টাকা ৫২৯ পয়সা এবং সর্বোচ্চ ভাড়া হবে ১১৭ টাকা ৬৫ পয়সা।
সুতরাং ভ্যাটসহ ২০ টাকার ভাড়া হবে ২৩ টাকা ৫২৯ পয়সা, ৩০ টাকার ভাড়া ৩৫ টাকা ২৯ পয়সা, ৪০ টাকার ভাড়া ৪৭ টাকা ৬ পয়সা, ৫০ টাকার ভাড়া হবে ৫৮ টাকা ৮২ পয়সা, ৬০ টাকার ভাড়া হবে ৭০ টাকা ৫৯ পয়সা, ৭০ টাকার ভাড়া হবে ৮২ টাকা ৩৫ পয়সা, ৮০ টাকার ভাড়া হবে ৯৪ টাকা ১২ পয়সা, ৯০ টাকার ভাড়া হবে ১০৫ টাকা ৮৮ পয়সা, ১০০ টাকার ভাড়া হবে ১১৭ টাকা ৬৫ পয়সা।
একক যাত্রার টিকেট নিতে হয় কাউন্টারে অথবা টিকেট ভেন্ডিং মেশিন থেকে। টিকেটের চেয়ে বেশি টাকা মেশিনে দেওয়া হলে সেই টাকা ফেরত পেতেন যাত্রীরা। ১০ টাকার নিচে কোনো নোট এই মেশিন থেকে আজ পর্যন্ত বের হয়নি।
ভ্যাট বসলে একক যাত্রায় টিকেট কিনতে গিয়ে যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়তে পারেন খুচরা টাকার অভাবে। এছাড়াও এই পয়সার হিসাব কীভাবে যুক্ত হবে সেটি নিয়েও আছে জটিলতা।
ভ্যাট প্রসঙ্গে আলোচনা যেভাবে
বাংলাদেশে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সব ধরনের পরিবহনেই যাত্রীদের ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। মেট্রো ট্রেনও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, ফলে এই নীতিতে এখানেও ভ্যাট বসার কথা।
তবে ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে যাত্রীদের কথা চিন্তা করে মেট্রোরেলের ভাড়ায় ভ্যাট অব্যাহতি দেয় এনবিআর।
তবে গত ৪ এপ্রিল ডিএমটিসিএলকে চিঠি দিয়ে এনবিআর জানায়, জুলাই থেকে মেট্রোরেলের সেবা ও টিকিটে ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী ভ্যাট না বসাতে ডিএমটিসিএলের চিঠির জবাবে এনবিআর জানায়, উন্নয়নের চাহিদা অনুযায়ী রাজস্ব আয় বাড়াতে সব খাতেই কর ছাড় কমানো হচ্ছে। তাই এ খাতের ভ্যাট অব্যাহতি বাড়ানো হবে না।
ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে মেট্রোরেলের ভাড়া এমনিতেই বেশি। তার ওপর এই ভ্যাট আরোপের প্রসঙ্গটি আসার পর যাত্রীদের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া আসে।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেই মেট্রোরেলে ভ্যাটের পক্ষে নন। জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন।
গত ৫ এপ্রিল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে সড়ক মন্ত্রী বলেন, “এ সম্পর্কে (ভ্যাট) আমরা কিছু জানি না। এটা আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করব। গণপরিবহণের একটি বিশেষ সেবাধর্মী পরিবহন মেট্রোরেল, মানুষ এর সুফল পাচ্ছে।
"আর আমরা এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তও নিইনি। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কোনো সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে হুট করে কারা এ ধরনের খবর দিল আমি জানি না।”
এরপর ১৯ মে ঢাকায় আরেকটি অনুষ্ঠানে কাদের জানান, মেট্রোরেলে ভ্যাট বসানোর সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পুনর্বিবেচনা করতে তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন।
পৃথিবীর কোন দেশে মেট্রোরেলের সেবায় ভ্যাট আছে সেই প্রশ্ন রেখে সেদিন সড়ক মন্ত্রী বলেন, “ভারতের মেট্রোরেলেও ভ্যাট নেই। তাহলে আমরা কেন ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসাব?”
আরও পড়ুন:
মেট্রোরেলে ভ্যাট কি বসছে, খুচরা টাকা কীভাবে দেবে মানুষ?
মেট্রো ভাড়ায় ভ্যাট বসলেও আদায় নিয়ে ধোঁয়াশা
মেট্রোরেলে ভ্যাট কে দিল, 'জানেন না' ওবায়দুল কাদের