সোমবার আগের ভাড়াতেই চড়েছেন যাত্রীরা। বৃহস্পতিবার এনবিআরের সঙ্গে বৈঠকে বসতে যাচ্ছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।
Published : 01 Jul 2024, 08:42 PM
যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় শুরু না হলেও মেট্রোরেলের ভাড়ায় ভ্যাটমুক্ত সুবিধা প্রত্যাহার করে নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর। তবে ভাড়ার ওপর এই টাকা কীভাবে আদায় হবে, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারছে না তদারক সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি (ডিএমটিসিএল)।
ভ্যাট আদায় হলে কীভাবে নেওয়া হবে, সে বিষয়ে আগামী ৪ জুলাই এনবিআরের সঙ্গে বসতে যাচ্ছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। ডিএমটিসিএল এই মন্ত্রণালয়েরই অধীন।
এনবিআর বলছে, বর্তমান ভাড়া থেকেই মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে। আর মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ অনুযায়ী মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে ভ্যাটের টাকা অগাস্টের ১৫ তারিখের মাঝে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
তবে যারা একক যাত্রার টিকেট কেনেন, তাদের কাছ থেকে ছোট ছোট অঙ্কের ভ্যাট কীভাবে আদায় হবে, সে বিষয়ে কোনো জবাব নেই ডিএমটিসিএলের কাছে। তারা ভ্যাটমুক্ত সুবিধা বহাল রাখতে এনবিআরকে অনুরোধ করেছে, সরকারের সঙ্গেও যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে।
গত এপ্রিল থেকেই মেট্রোরেলের টিকেটে ভ্যাট আরোপের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। ১ জুলাই থেকে ভ্যাটমুক্ত সুবিধা প্রত্যাহার হয়ে গেছে ১৫ শতাংশ ভাড়া বাড়বে, এমন সংবাদ আসার পর যাত্রীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়াও ছিল।
তবে নতুন অর্থবছরের প্রথম দিন সোমবার যাত্রীদের বাড়তি কোনো ভাড়া দিতে হয়নি। আগের মতোই সর্বনিম্ন ২০ টাকা ও সর্বোচ্চ ১০০ টাকায় তারা গন্তব্যে গেছেন।
তবে ডিএমটিসিএল আদায় করুক বা না করুক ভ্যাট অব্যাহতি না থাকায় মেট্রোরেলের সেবা ও টিকিটের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে স্পষ্ট করেছেন এনবিআরের প্রথম সচিব (মূসক নীতি) মোহাম্মদ হাসমত আলী।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেহেতু এখনও এনবিআর থেকে কোনো বিশেষ আদেশের মাধ্যমে নতুন করে অব্যাহতি দেওয়া হয়নি, সুতরাং আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সোমবার থেকে মেট্রোরেলে ভ্যাট আরোপিত হয়েছে।”
ভাড়া না বাড়ায় ভ্যাটের টাকা কি তবে ডিএমটিসিএল নিজেই দিয়ে দেবে?- এই প্রশ্নে সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভ্যাট বসলে সেটা তো ডিএমটিসিএল দেবে না। অবশ্যই জনগণকে দিতে হবে।”
তাহলে সামনে কি ভাড়া বাড়ছে?- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে মিটিং ডাকা হয়েছে। এ বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হবে তারপর জানা যাবে।”
ভাড়া বাড়লে কত বাড়বে, খুচরা টাকা পরিশোধই বা কীভাবে
বর্তমান ভাড়া অনুযায়ী সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা, এবং সর্বোচ্চ ১০০ টাকা। ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসলে সর্বনিম্ন ভাড়া কত হবে তা নিয়েও রয়েছে শঙ্কা।
মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ অনুযায়ী ভ্যাটের অর্থ ভাড়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হয়।
অর্থাৎ ডিএমটিসিএলের যদি বর্তমান অর্থ তাদের জন্য নিশ্চিত করতে হয় এবং এর সঙ্গে ১৫ শতাংশ টাকা যুক্ত থাকে, তাহলে সর্বনিম্ন ভাড়া হবে ২৩ টাকা ৫২৯ পয়সা এবং সর্বোচ্চ ভাড়া হবে ১১৭ টাকা ৬৫ পয়সা।
সুতরাং ভ্যাটসহ ২০ টাকার ভাড়া হবে ২৩ টাকা ৫২৯ পয়সা, ৩০ টাকার ভাড়া ৩৫ টাকা ২৯ পয়সা, ৪০ টাকার ভাড়া ৪৭ টাকা ০৬ পয়সা, ৫০ টাকার ভাড়া হবে ৫৮ টাকা ৮২ পয়সা, ৬০ টাকার ভাড়া হবে ৭০ টাকা ৫৯ পয়সা, ৭০ টাকার ভাড়া হবে ৮২ টাকা ৩৫ পয়সা, ৮০ টাকার ভাড়া হবে ৯৪ টাকা ১২ পয়সা, ৯০ টাকার ভাড়া হবে ১০৫ টাকা ৮৮ পয়সা, ১০০ টাকার ভাড়া হবে ১১৭ টাকা ৬৫ পয়সা।
যাদের এমআরটি পাস আছে, তাদের কাছ থেকে স্বয়ংক্রিয় উপায়ে টাকা কাটা হবে বলে বাড়তি আদায় নিয়ে কোনো জটিলতা হবে না, কিন্তু যারা একক যাত্রার টিকেট কাটবেন, তাদের ক্ষেত্রে হবে জটিলতা।
একক যাত্রার টিকেট নিতে হয় কাউন্টারে অথবা টিকেট ভেন্ডিং মেশিন থেকে। টিকেটের চেয়ে বেশি টাকা মেশিনে দেওয়া হলে সেই টাকা ফেরত পেতেন যাত্রীরা। ১০ টাকার নিচে কোনো নোট এই মেশিন থেকে আজ পর্যন্ত বের হয়নি।
ভ্যাট বসলে একক যাত্রায় টিকেট কিনতে গিয়ে যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়তে পারেন খুচরা টাকার অভাবে। এছাড়াও এই পয়সার হিসেব কীভাবে যুক্ত হবে সেটি নিয়েও আছে জটিলতা।
তাহলে কী হবে?
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "খুচরা টাকা পয়সা তো আর মেশিন বুঝবে না। তাছাড়া ভ্যাট যুক্ত হওয়ার পর খুচরা টাকা পয়সা মেশিনের মাধ্যমে আদায় করা সহজ বিষয় না।
"আগামী বৃহস্পতিবার এনবিআরের সঙ্গে এ বিষয়টা কীভাবে সহজ করা যায়, এর জন্য বৈঠক করব। বৈঠকে সমন্বিত একটা ব্যবস্থায় আমরা পৌঁছাতে পারব বলে আশা করছি।”
এর আগ পর্যন্ত পূর্বের ভাড়া বহাল থাকবে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, "ভ্যাট নির্ধারণ করেছে এনবিআর, এটা কবে থেকে আদায় করবে সেটা তাদের বিষয়। আমরা সবার স্বার্থ বিবেচনা করে সমন্বিত একটা ব্যবস্থায় আসতে চাচ্ছি।"
ভ্যাট প্রসঙ্গে আলোচনা যেভাবে
বাংলাদেশে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সব ধরনের পরিবহনেই যাত্রীদের ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। মেট্রো ট্রেনও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, ফলে এই নীতিতে এখানেও ভ্যাট বসার কথা।
তবে ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে যাত্রীদের কথা চিন্তা করে মেট্রোরেলের ভাড়ায় ভ্যাট অব্যাহতি দেয় এনবিআর।
তবে গত ৪ এপ্রিল ডিএমটিসিএলকে চিঠি দিয়ে এনবিআর জানায়, জুলাই থেকে মেট্রোরেলের সেবা ও টিকিটে ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী ভ্যাট না বসাতে ডিএমটিসিএলের চিঠির জবাবে এনবিআর জানায়, উন্নয়নের চাহিদা অনুযায়ী রাজস্ব আয় বাড়াতে সব খাতেই কর ছাড় কমানো হচ্ছে। তাই এ খাতের ভ্যাট অব্যাহতি বাড়ানো হবে না।
ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে মেট্রোরেলের ভাড়া এমনিতেই বেশি। তার ওপর এই ভ্যাট আরোপের প্রসঙ্গটি আসার পর যাত্রীদের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া আসে।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেই মেট্রোরেলে ভ্যাটের পক্ষে নন। জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন।
গত ৫ এপ্রিল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে সড়ক মন্ত্রী বলেন, “এ সম্পর্কে (ভ্যাট) আমরা কিছু জানি না। এটা আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করব। গণপরিবহণের একটি বিশেষ সেবাধর্মী পরিবহন মেট্রোরেল, মানুষ এর সুফল পাচ্ছে।
"আর আমরা এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তও নিইনি। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কোনো সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে হুট করে কারা এ ধরনের খবর দিল আমি জানি না।”
এরপর ১৯ মে ঢাকায় আরেকটি অনুষ্ঠানে কাদের জানান, মেট্রোরেলে ভ্যাট বসানোর সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পুনর্বিবেচনা করতে তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন।
পৃথিবীর কোন দেশে মেট্রোরেলের সেবায় ভ্যাট আছে সেই প্রশ্ন রেখে সেদিন সড়ক মন্ত্রী বলেন, “ভারতের মেট্রোরেলেও ভ্যাট নেই। তাহলে আমরা কেন ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসাব?”