“আমলাতন্ত্র কখনও এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে এটি রাজনৈতিক নেতা ও নাগরিকদের উপেক্ষা করে; কখনও আবার এটি রাজনীতির প্রভাবে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে।”
Published : 09 Feb 2025, 12:09 AM
জনপ্রশাসন সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রশাসনিক দায়িত্ব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের হাতে দেওয়ার সুপারিশ করেছে এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা সংস্কার কমিশন।
কারণ হিসেবে কমিশন প্রতিবেদনে বলেছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সরাসরি সরকারপ্রধানের নেতৃত্বে পরিচালিত হয় বলে এ বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়াই ’যুক্তিসংগত’।
শনিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ পাওয়া জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে এমন সুপারিশ উঠে এসেছে।
এর আগে গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে প্রতিবেদন তুলে দেয় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী। সেদিন প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ প্রকাশ করা হয়।
এদিন প্রকাশ করা পূর্ণাজ্ঞ প্রতিবেদনে জনপ্রশাসন সংস্কারের নেতৃত্বের কাঠামো কেমন হবে, সেই আলোচনায় বলা হয়, “বিগত ৫৩ বছরে দুই ডজনের বেশি কমিশন ও কমিটি গঠিত হয়। বিভিন্ন কমিশন গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সেগুলো প্রধানত দুটি কারণে পুরোপুরি বাস্তবায়ন ও টেকসই হয়নি।
“প্রথমত রাজনৈতিক নেতৃত্ব সব সুপারিশ গ্রহণ করেনি; আর যেগুলো গ্রহণ করেছিল, তা বাস্তবায়নে আন্তরিক বা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল না। দ্বিতীয়ত স্বার্থগত দ্বন্দ্বের জন্য সংশ্লিষ্ট আমলারা তা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেননি।”
এ বিষয়ে কমিশনের পর্যবেক্ষণ হল, “রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা থাকলে এবং সার্বিক পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে সংস্কার বাস্তবায়ন সহজ হয়।
“অপরদিকে সিভিল সার্ভিসকে সরকারপ্রধানের নির্দেশনায় বাস্তবায়ন কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রশাসনিক নেতৃত্ব দিতে হবে। যেহেতু মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সরাসরি সরকারপ্রধানের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়, সেহেতু সংষ্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে প্রশাসনিক নেতৃত্ব তাদেরকে দেওয়াই অত্যন্ত যুক্তিসংগত।”
২০৫ পৃষ্ঠার জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে ১৭টি অধ্যায় রাখা হয়েছে।
তুমুল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের লক্ষ্যে রাষ্ট্র সংস্কারে প্রথম ধাপে ছয়টি কমিশন করে।
গত অক্টোবরে গঠিত এসব কমিশনের চারটি ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়।
(ক্যাপশন: রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বুধবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে প্রতিবেদন তুলে দেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী।)
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীকে প্রধান করে গত ৩ অক্টোবর ১১ সদস্যের জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। ৯০ দিনের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। পরে কমিশনের মেয়াদ ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
‘আমলাতন্ত্র শক্তিশালী হয়ে নাগরিকদের উপেক্ষা করেছে’
জনপ্রশাসন কর্মচারীদের আচরণগত ও দৃষ্টিভঙ্গির সংস্কার বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, “স্বাধীনতার পর থেকে গণতন্ত্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা নির্ধারণ, সংজ্ঞায়িত বা নির্দিষ্ট করার প্রচেষ্টা ছিল সীমিত। নির্বাচিত সরকারের নীতিগত লক্ষ্য অর্জনে সহায়তার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সংরক্ষণে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা কী হবে, তা সুনির্দিষ্ট করা হয়নি।”
ফলে আমলাতন্ত্র ‘এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, এটি রাজনৈতিক নেতা ও নাগরিকদের উপেক্ষা করেছে’ বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।
এতে বলা হয়, বিভিন্ন আইন, বিধি এবং নীতিমালা সময়ে সময়ে প্রণয়ন করা হলেও সেগুলো সেবার পেশাগত মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট কার্যকর ছিল না।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ‘আমলাতন্ত্রের জন্য কিছু মৌলিক পেশাগত মূল্যবোধ চিহ্নিত করা প্রয়োজন’ তুলে ধরে কমিশন বলেছে, “একটি সিভিল সার্ভিস কোড ডিজাইন করা যেতে পারে, যেখানে এ মৌলিক মূল্যবোধগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
“এটি কর্মচারীদের মধ্যে পেশাগত আচরণবিধি গড়ে তুলবে, যা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের আচরণবিধির ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।”
‘৮০% নাগরিক মনে করে জনপ্রশাসন জনবান্ধব নয়’
সংস্কার সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে নাগরিকদের মতামত তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। অনলাইনে জরিপ চালিয়ে তাদের মতামত নিয়েছিল কমিশন। এক লাখ পাঁচ হাজার নাগরিক বিভিন্ন প্রশ্নে তাদের মতামত দেন।
এদের মধ্যে ৮৪ দশমিক ৪ শতাংশ নাগরিক মনে করেন, দেশে জনপ্রশাসনে সংস্কার প্রয়োজন। ৮০ শতাংশ মানুষ মনে করেন, দেশের জনপ্রশাসন জনবান্ধব নয়।
৬৮ দশমিক ৮ শতাংশ নাগরিক মনে করেন, ‘বিগত ১৫ বছরে জনপ্রশাসনে নিরপেক্ষতার’ অভাব ছিল। ৫৬ শতাংশ মানুষ মনে করেন, জনপ্রশাসন জনবান্ধব করার পথে ‘প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ’।
প্রতিবেদনে সংস্কারের যৌক্তিকতায় বলা হয়, “জনমুখী প্রশাসন বলতে আমরা সাধারণত বুঝি এমন একটি প্রশাসনব্যবস্থা, যেখানে জনসেবা হবে মুখ্য। এখন প্রয়োজন হল জনসেবাকে সহজ করা; জনগণ যেন হয়রানির মুখে না পড়ে, এমন প্রক্রিয়া চালু করা এবং জটিলতা পরিহার করে, এমন আইন ও বিধিবিধান সংস্কার করা।
“বিশেষ করে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে যেসব বিষয়ে জনগণ সবচেয়ে ভোগান্তিতে পড়েন, সেগুলো সামনে রেখে সংস্কার প্রস্তাব করা; প্রতিটি দপ্তরে জবাবদিহিতার প্রচলিত বিধানকে আরও শক্তিশালী করা; জনবান্ধব জনপ্রশাসন গড়তে নৈতিকতা এবং কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং জনপ্রশাসনকে রাজনীতিমুক্ত করার জন্য নির্দিষ্ট প্রস্তাব দেওয়া।”
আরও যা রয়েছে
বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার নিয়ে আলাদা ‘বাংলাদেশ প্রশাসনিক সার্ভিস’ ও সচিবালয়ে ‘সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস’ (এসইএস) গঠনের সুপারিশ এসেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের তরফে।
এসইএস গঠনের সুপারিশ করে কমিশন বলেছে, উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত কর্মকর্তারা সরকারের সব সার্ভিস থেকে আসতে পারবেন, তবে পরীক্ষা দিয়ে।
সুপারিশে বলা হয়, প্রশাসনিক সার্ভিসের যেসব কর্মকর্তা পরীক্ষা দেবেন না বা অকৃতকার্য হবেন, তারা ওই সার্ভিসেই পদোন্নতি (লাইন প্রমোশন) পাবেন। একইভাবে অন্য সার্ভিসের কর্মকর্তাও পদোন্নতি পাবেন। তবে তাদেরও পরীক্ষা দিতে হবে।
এছাড়া বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) একীভূত ‘ক্যাডার’ পদ্ধতি বাতিলের সুপারিশ করে কাজের ধরন ও বিশেষায়িত দক্ষতার ভিত্তিতে ১৩টি প্রধান সার্ভিসে ভাগ করার সুপারিশ এসেছে।
ওই ১৩ সার্ভিসে নিয়োগের পরীক্ষা পৃথক তিনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অধীনে নেওয়ার কথা বলেছে কমিশন। এগুলো হবে- প্রশাসনিক, বিচারিক, জননিরাপত্তা, পররাষ্ট্র, হিসাব, নিরীক্ষা, রাজস্ব, প্রকৌশল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, তথ্য এবং তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি সার্ভিস।
প্রশাসনে যাবে খাদ্য ও সমবায়। ক্যাডার সার্ভিস পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে বিসিএস (খাদ্য) এবং বিসিএস (সমবায়) সার্ভিসকে বাংলাদেশ প্রশাসনিক সার্ভিসে একীভূত করার সুপারিশ করে সংস্কার কমিশন বলছে, ভবিষ্যতে এই দুটি সার্ভিসে নতুন নিয়োগ করা যাবে না।
বিসিএস (হিসাব ও নিরীক্ষা) সার্ভিসকে দুই ভাগ করার সুপারিশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি হবে ‘বাংলাদেশ হিসাব সার্ভিস’; আরেকটি হবে ‘বাংলাদেশ নিরীক্ষা সার্ভিস’।
বিসিএস সাধারণ তথ্য ক্যাডারের তিনটি সাব-ক্যাডার একীভূত করার সুপারিশও করে কমিশন বলেছে, এগুলোয় পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধায় বৈষম্য রয়েছে।
একীভূত সার্ভিসে মধ্যে থাকবে- সহকারী পরিচালক/তথ্য কর্মকর্তা/গবেষণা কর্মকর্তা; সহকারী অনুষ্ঠান পরিচালক এবং সহকারী বার্তা নিয়ন্ত্রক। এদের পদোন্নতি মেধা তালিকার ভিত্তিতে করার কথা বলেছে কমিশন।
আইসিটি কর্মকর্তাদের তথ্য সার্ভিসে অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করে কমিশন বলেছে, “সরকারি দপ্তরে এখন আইসিটি সম্পৃক্ত বহু কর্মচারী কাজ করেন। তাদের অনেকে বেশ মেধাবীও। অনেকে বিদেশে সাফল্য দেখাচ্ছে।
বিসিএস (তথ্য প্রকৌশল) সার্ভিসকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে কমিশন।
বিসিএস ট্রেড ক্যাডারকে একীভূত করার সুপারিশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, “বিসিএস (ট্রেড) ক্যাডার খুবই ছোট একটি সার্ভিস হওয়ায় একে বিলুপ্ত করে বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) এর সঙ্গে একীভূত করার সুপারিশ করা হল।”
ইন্টারনেট, সামাজিক মাধ্যম, কুরিয়ার সার্ভিসের মত সেবা সহজলভ্য হওয়ায় বিসিএস (ডাক) সার্ভিসের গুরুত্ব অনেকটাই কমে গেছে। এজন্য এ সার্ভিসের প্রয়োজনীয়তা পরীক্ষা করে দেখার সুপারিশ করেছে কমিশন।
আরও পড়ুন
৬ সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ
মন্ত্রণালয় কমিয়ে ২৫, প্রাদেশিক সরকারের প্রস্তাব সংস্কার কমিশনের
জনপ্রশাসন সংস্কার: ‘ক্যাডার’ নয় বিসিএসে থাকবে ১৩ সার্ভিস, পিএসসি হবে ৩টি
চার কমিশনের প্রতিবেদন: রাষ্ট্র সংস্কার কোন পথে?
চার সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা
চার সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে কী সুপারিশ থাকছে
পদোন্নতিতে কোটা কমানোর প্রস্তাবে সচিবালয়ে জনপ্রশাসন কর্মকর্তাদের অবস্থান
পদোন্নতির কোটা: কমিশনের ভাবনায় 'ষড়যন্ত্র' দেখছে প্রশাসন ক্যাডার
প্রতিবেদন জমার পর প্রশাসন ক্যাডারে ভুল বোঝাবুঝি থাকবে না: সচিব
পদোন্নতিতে কোটা কমানোর প্রস্তাবে সচিবালয়ে জনপ্রশাসন কর্মকর্তাদের