“আমরা একটা স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের জন্য সুপারিশ করেছি,” বলেন মুয়ীদ চৌধুরী।
Published : 05 Feb 2025, 07:00 PM
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশে প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা, ক্যাপিটাল সিটি সরকার, মন্ত্রণালয়ের কলেবর কমিয়ে আনা, সরকারি সেবার প্রাপ্যতা নিয়ে গণশুনানির আয়োজনসহ একগুচ্ছ নতুন ধারণা দেওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছেন কমিশন প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী।
বুধবার প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেয় সংস্কার কমিশন। পরে সেখানে প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন মুয়ীদ চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘আমরা স্বল্প মেয়াদী কিছু সুপারিশ করেছি যেগুলো ছয় মাসের মধ্যে করা যাবে, মধ্য মেয়াদী কিছু সুপারিশ করেছি যেগুলো এক থেকে দুই বছরের মধ্যে করা যাবে। দীর্ঘমেয়াদী কিছু সুপারিশ আছে যেগুলো পরবর্তীকালে ক্রমান্বয়ে দেখা যেতে পারে।”
জনপ্রশাসন সংস্কারকে একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া আখ্যায়িত করে সাবেক এই আমলা বলেন, “এজন্য আমরা সুপারিশ করেছি একটা স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের জন্য। একই সঙ্গে এই কমিশন যাতে এবারের কমিশনগুলোর রিপোর্ট বাস্তবায়ন তদারকি করতে পারে। জনপ্রশাসনে একটা উদ্ভাবনী ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। সেখানে গতানুগতিকের পরিবর্তে নতুন নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে আসবে।
“সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটা আচরণ বিধিও প্রণয়ন করা দরকার। ব্যবসায়ীদের দিক থেকে একটা ওয়ান স্টপ সার্ভিসের দিকে জোর দিয়েছেন। যাতে করে ট্রেড রিলেটেড পরিষেবাগুলো এক জায়গা থেকে পাওয়া যায়।”
সরকারি সেবা নিয়ে গণশুনানির সুপারিশ করার বিষয়ে তিনি বলেন, “বিভিন্ন অভিযোগ শোনার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে একটা পাবলিক হিয়ারিংয়ের ব্যবস্থা যাতে করা যায়। পাশাপাশি নাগরিক কমিটি গঠনের ওপর সুপারিশ করেছি। জেলা নাগরিক কমিটি এবং উপজেলা নাগরিক কমিটি যাতে গঠিত হয়। যাতে করে নাগরিকদের প্রতিনিধিরা নিয়মিতভাবে সরকারের কাজকর্ম দেখতে পারে। এর সঙ্গে স্থানীয় এনজিও এবং সামাজিক সংগঠনের সংযুক্তির কথা আমরা বলেছি।”
“আমরা আরেকটি বলেছি, সেবা প্রদানের ক্ষমতা যেন স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এখন সবকিছু হেডকোয়ার্টার বা মিনিস্ট্রিতে কনট্রোলড। এইটা যাতে না হয়। যাতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এই ক্ষমতাটা ডাইভার্ট করা যায়। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে হটলাইন স্থাপন করা উচিত, যাতে করে মানুষ সহজে যোগাযোগ করতে পারে,” বলেন তিনি।
তুমুল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের লক্ষ্যে রাষ্ট্র সংস্কারে প্রথম ধাপে ছয়টি কমিশন করে।
গত অক্টোবরে গঠিত এসব কমিশনের চারটি ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন পেশ করেছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীকে প্রধান করে গত ৩ অক্টোবর ১১ সদস্যের জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। ৯০ দিনের মধ্যে প্রস্তুত করা প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমার কথা ছিল। পরে কমিশনের মেয়াদ ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
তবে তার আগে বুধবার কমিশন প্রতিবেদন জমা দিল। এছাড়া বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনও এদিন প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করেছে।
প্রশাসনে আমূল সংস্কারের প্রস্তাব
মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিশন মন্ত্রণালয়ের আমূল পরিবর্তনেরও কিছু সুপারিশ করেছে।
“এখন মোট ৪৩টি মন্ত্রণালয় ও ৬১টি বিভাগ আছে। আমরা মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা হ্রাস করে ২৫টি মন্ত্রণালয় ও ৪০টি বিভাগে সীমাবদ্ধ করতে বলেছি। পাঁচটি গুচ্ছে মন্ত্রণালয়গুলোকে ভাগ করার জন্য আমরা বলেছি।”
প্রদেশিক সরকার ব্যবস্থা চালুর পরামর্শ দিয়ে কমিশন প্রধান বলেন, “আমরা সরকারের কাছে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা চালু করার একটা প্রস্তাব করেছি। আমাদের লোকসংখ্যার কারণে সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন খুব একটা কার্যকর থাকে না।
“যদি চারটা প্রদেশ করা যায়, তাহলে একদিকে এই সমস্যাগুলো যেমন দূর হবে, তেমনি রাজনৈতিক দিক থেকেও একটা প্রভাব আসবে। কারণ, একটা কেন্দ্রীয় সরকার একবার বসে গেলে সে পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। প্রদেশ হলে আমরা মনে করি সেটা সম্ভব হবে না। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল বিভিন্ন দেশে এই ব্যবস্থা আছে।”
ঢাকার সাভার, গাজীপুরের টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জ নিয়ে একটা ক্যাপিটাল সিটি গভমেন্ট বা অথরিটি করার সুপারিশ করার কথা তুলে ধরে মুয়ীদ চৌধুরী বলেন, “জেলা পরিষদ বাতিল করার জন্য বলেছি। বিভিন্ন ক্যাডারকে কোনো জায়গায় একত্রিত বা একীভূত করার সুপারিশ করেছি। সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস গঠন করার সুপারিশ করেছি। যাতে শীর্ষ পর্যায়ে যাওয়ার সুযোগ সবার হয়। বাইর থেকেও অর্থাৎ বিদেশে অবস্থান করছে- এমন কোনো প্রতিভাবান যেন আসতে পারে।”
তিনি বলেন, “উপ-সচিব পর্যায়ে পদন্নোতির ক্ষেত্রে এখন প্রশাসনিক সার্ভিসের জন্য ৭৫ শতাংশ কোটা আছে। আমরা এটাকে ৫০ শতাংশ করার সুপারিশ করেছি। অবশিষ্ট ৫০ শতাংশ অন্যান্য সার্ভিসের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। আমরা সচিব নিয়োগের ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভা কমিটির মাধ্যমে করার সুপারিশ করেছি। যাতে সরকার প্রধান এটা না করেন “
বিধিবদ্ধ প্রশাসন, অর্থ-শিল্প ও বাণিজ্য, ভৌত অবকাঠামো ও যোগাযোগ, কৃষি ও পরিবেশ, মানব সম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন- এই পাঁচটি গুচ্ছে ভাগ করার সুপারিশ করার বিষয়টিও তুলে ধরেছেন তিনি।
মুয়ীদ চৌধুরী বলেন, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের পুনর্গঠনের কথা আমরা বলেছি। সেখানে মন্ত্রণালয়ে আলাদা হয়ে যাবে। এর অধীনে আয়কর, শুল্ক-আবগারি এবং মূল্য সংযোজন কর তিনটা অধিদপ্তর হবে।”
মঙ্গলবার আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, প্রথম ধাপে গঠিত ছয় সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন শনিবার প্রকাশ করা হবে। এছাড়া সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন ও সুপারিশমালা রাজনৈতিক দল ও গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির কাছে পাঠানো হবে।
এরপর রাজনৈতিক দল ও গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের সব শক্তির সঙ্গে আলোচনা এবং সমঝোতাক্রমে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে বসতে পারে, এমন আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।
বুধবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে নিয়ে রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের আলোচনায় ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে ‘জুলাই সনদ’ হবে, তার বাস্তবায়নের উপর নির্ভর করবে আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময়।