একটি গ্রুপ নিজেদের ‘নিশাচর’ নামে পরিচয় দেয়; অপরাধে জড়িতদের প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ উঠলেও ছাত্রলীগ তা অস্বীকার করেছে।
Published : 12 Feb 2023, 12:55 AM
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রায়ই ঘটছে ‘বহিরাগতদের’ মারধর করে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, হেনস্তা এমনকি শ্লীলতাহানির ঘটনা; দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেও এসব অপরাধে জড়াচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
তাদের হাত থেকে বাদ যাচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরাও, নারী হলেও অপদস্ত করা হচ্ছে নির্বিচারে।
অন্ধকার হতে না হতেই সংঘবদ্ধ কয়েকটি চক্র কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ফুলার রোড ও কার্জন হল প্রাঙ্গণে নেমে পড়ছে শিকারে; বিশেষ করে প্রেমিক-যুগল বা দম্পতিদের লক্ষ্য করে ‘বহিরাগত’ তকমা দিয়ে মারধর করে টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোন ও দামি অলংকার ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ মিলছে অহরহ।
এছাড়া রাতের বেলা ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে গাড়ি চলাচলে গতিরোধ করেও চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটে। এগুলোর কিছু কিছু ঘটনায় শাস্তিও হচ্ছে, তবে অপরাধ কমছে না।
দিন কয়েক আগে এমন ঘটনায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির নেতা ও কর্মীদের বহিষ্কার এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলার পর বিষয়টি আবার সামনে এসেছে।
তথ্য বলছে, গত এক মাসেই এধরনের ঘটনা ঘটেছে ডজনেরও বেশি। আর এগুলোতে জড়িতদের অধিকাংশই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী বলে অভিযোগ।
ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ, থানায় মামলা বা সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ ছাড়াও এধরনের ঘটনা অনেক; যেগুলো ভুক্তভোগীরা সামাজিক হেনস্তা কিংবা ভয়ে চেপে যান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রব্বানীও চান এসবের ব্যবস্থা নিতে। তবে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ না থাকায় অনেক ঘটনার কথা জানতেও পারেন না, সংবাদমাধ্যমে দেখে অবহিত হন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, কোনো ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে গেলে দেখা যায়, ভিক্টিম অভিযোগ উইথড্র করে নিতে চায়, বলে আমরা নিজেরা আপোস করে ফেলেছি। এধরনের একটা কমপ্লেক্স সিচুয়েশন আছে।
“যখন ক্রিমিনাল অফেন্স হয়ে যায়, তখন তো ওটা দেশের প্রচলিত আইনের সহায়তা নিতে হবে। অনেকে অভিযোগ করতে চায় না। আমরা পত্রিকায় লেখালেখি দেখি। তারপর দ্বিতীয় কোনো অনুসন্ধান সোর্স থাকে না। ভিক্টিম অভিযোগ দিলে তো ব্যবস্থা নেওয়া যায়।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এমন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা সামাজিক অস্থিরতা, মাদকে জড়িয়ে যাওয়া, অপরাধের শাস্তি না হওয়া, এমনকি অভিযোগ করে তা প্রত্যাহার করে নেওয়াকে চিহ্নিত করেছেন।
ক্যাম্পাস ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের প্রশ্রয় দেওয়ায় নারী হেনস্তা, শ্লীলতাহানি, ছিনতাইয়ের মত অপরাধ ‘উৎসাহ’ পাচ্ছে বলে তারা মনে করছেন।
এছাড়া ক্যাম্পাসে চলমান ছাত্ররাজনীতির ধারাকেও দায়ী করছেন কেউ কেউ। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য ছাত্র সংগঠনগুলো দুষছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে।
ছিনতাই, মারধর, হেনস্তা ও চাঁদাবাজির অভিযোগে কয়েকজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে সম্প্রতি শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে ছাত্রলীগের পদবি ব্যবহার করে এসব অপরাধ করলেও এর একটি ঘটনাও আমলে নিচ্ছে না সংগঠনটি।
কী ঘটেছে কয়েক দিনে
গত ৪ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক দম্পতিকে মারধর করে ২২ হাজার টাকা ও এটিএম কার্ড ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠে। পরে ১৪ জনের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় একটি মামলাও হয়। মামলার এজাহারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ফাহিম তাজওয়ার জয় এবং তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাজিদ আহমেদের নাম উল্লেখ করা হয়; দুজনই সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সদস্য।
এ ঘটনার পরদিন মধ্যরাতে শহীদ মিনার সংলগ্ন বুয়েটের মসজিদের সামনে কভার্ড ভ্যান আটকে চালককে মারধর ও টাকা ছিনতাই করে পালানোর সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
কভার্ড ভ্যান আটকে ‘ছিনতাই’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ শিক্ষার্থী গ্রেপ্তার
তারা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হল শাখা ছাত্রলীগের কর্মী ফজলে নাভিদ ওরফে অনন ও সাদিক আহাম্মদ এবং অনাবাসিক ছাত্র মো. রাহাত রহমান। তিনজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। গ্রেপ্তারের পর তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এর আগে গত ১৫ জানুয়ারি রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক দম্পতিকে আটকে স্বর্ণালঙ্কার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ওই রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক নারী শিক্ষার্থী স্বামীকে মারধর এবং তাকে হেনস্তা ও শ্লীলতহানির পর ছিনতাইয়ের অভিযোগে মামলা করা হয়। এর দুদিন পর কবি জসীম উদ্দীন হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তানজির আরাফাত ওরফে তুষার গ্রেপ্তার হন। এজাহারভুক্ত আরেক আসামি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সদস্য রাহুল রায় পলাতক।
তবে এক দিনের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে আবার ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন তুষার। পরে বিভিন্ন মহলের চাপে দুজনকে সাময়িক বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে প্রাইভেট কার চালককে মারধর ও ৩২ হাজার টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগে ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির শিক্ষার্থী নাজমুল হাসান রুপু এবং পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের তারিক হাসানসহ ১০-১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
এদের মধ্যে রুপু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পাদক। তারিক ফজলুল হক ছাত্রলীগের কর্মী। তবে অভিযোগ অস্বীকার করলেও এ টাকার একটি অংশ আত্মসাতের বিষয়টি দুজনই স্বীকার করেছেন।
মামলা বা সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ ছাড়াও এধরনের ঘটনার কথাই ক্যাম্পাসে শোনা যায়।
গভীর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তা করার অভিযোগে গত ২৫ জানুয়ারি সমাজকল্যাণ বিভাগের নাজমুল আলম ওরফে জিমকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে আরও ১১৩ জন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়।
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ’ নামে শিক্ষার্থীদের একটি প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। সেখানেও অনেকে এধরনের ছিনতাই-চাঁদাবাজির অভিযোগ নিয়ে যান বলে জানা গেছে।
মঞ্চটির প্রতিষ্ঠাতা ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সংসদের সাবেক জিএস জুলিয়াস সিজার তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সব ঘটনায় কিন্তু মামলা বা নিউজ হচ্ছে না। থানায় গেলে বলে আপনাদের কথা শুনলাম। আগে আপনারা প্রক্টরের কাছে যান। প্রক্টরের কাছে গেলে লিখিত অভিযোগ দিতে বলে।
“লিখিত অভিযোগ দিলেও যথাসময়ে এটার বিচার পাওয়া যায় না। ফলে অনেকে আমাদের কাছে অভিযোগ নিয়ে আসেন। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অপরাধীদের শনাক্ত করতে সহায়তা করে থাকি।”
তার ভাষ্য, “আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত কয়েক বছরে অন্তত কয়েক ডজন ছিনতাইয়ের রিপোর্ট হয়েছে। কিন্তু তাদেরকে বিচার আওতায় আনা যায়নি। ফলে এটা বৃদ্ধি পাচ্ছে।”
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রায়হান কামাল ফেইসবুক পোস্টে লেখেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাস্ট কয়দিনে বহিরাগত ও ক্যাম্পাসের ছাত্র-ছাত্রী মিলিয়ে একশর উপরে মানুষ মার খেয়েছে। লকডাউন পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাসে একটা গ্যাং কালচার শুরু হয়েছে, যাদের কাজ ছিনতাই, মানুষকে অকারণে মারধর, মাদক কারবার ও নারীর শ্লীলতাহানি থেকে শুরু করে হেন কোনো অপরাধ নাই তারা করছে না।
“সোজা কথায় ক্যাম্পাসে একটা ‘মাৎসন্যায়’ চলতেসে। যাদের দেখার কথা তারা দেখেও না দেখার ভান করছে। আমি আমার পরিচিত জনদের ক্যাম্পাসে আসতে নিরুৎসাহিত করি এখন।”
শিক্ষার্থীরা কেন জড়াচ্ছেন ‘অপরাধে’?
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা জড়িত বলে প্রচলিত ধারণা রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সময় সাময়িক বহিষ্কার ও ইয়ারড্রপ দেওয়া শিক্ষার্থীরা এ ধরনের অপরাধের পুনারাবৃত্তি ঘটাচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছাত্রলীগের সহায়তায় আবাসিক হলগুলোতে ‘গণরুমে’ উঠা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপে বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি করে রাতে ঘোরাফেরা করে মাদক গ্রহণ, নারী হেনস্তা, ছিনতাইসহ নানা অপকর্মে জড়াচ্ছেন। তারা নিজেদের ‘নিশাচর’ নামে পরিচয় দেন। এছাড়া ছাত্রলীগের নেতারাও ‘গণরুমে’ উঠা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গভীর রাতে ঘুরাফেরা করতে উৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে জুলিয়াস সিজারের অভিযোগ, কিছু কিছু হল ছাত্রনেতা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বখাটে বাহিনী তৈরি করছে। ইচ্ছাকৃতভাবে এই ছেলেদের ছিনতাই বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যারা জড়াচ্ছেন, তাদেরকে প্রশ্রয় দেয় যাতে সময় অনুযায়ী তাদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
“এরা যখন অপরাধ করে ফিরে আসে, তাদের অভিনন্দন জানায় যে, তুমি তো অনেক সাহসী। তাদেরকে উৎসাহ দেওয়া হয়। সেটা সব হলেই হচ্ছে। তাদের সাহসিকতা খুব প্রশংসা করে। এতে করে কিন্তু এই ছোট ছেলেদের কাছে এটা বীরত্বের কাজ মনে হয় এবং পুনরায় করতে কখনও লজ্জাবোধ করে না।”
ছাত্রলীগের সাবেক অনেক নেতার বিরুদ্ধে ‘ছিনতাইকারীদের রাজনৈতিকভাবে পদায়নের’ অভিযোগও করেন তিনি।
তার ভাষ্য, একজন ছিনতাইকারী যখন কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে, তখন সে নিজেকে শক্তিশালী মনে করে। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের পদ পেলে কিন্তু সেটা আরও বৃদ্ধি পায়।
“গত রমজানে শাহবাগ আজিজ মার্কেটে গিয়ে দোকান থেকে কতিপয় শিক্ষার্থী সরাসরি মালামাল ছিনতাই করে নিয়ে এসেছে। তারা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ছিনতাই করে তা নয়, আশপাশের যে মার্কেটগুলো আছে, সেখানেও তারা অপকর্মগুলো করে।”
কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছিনতাইয়ের মতো অপকর্মে জড়াচ্ছে, এমন প্রশ্নে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের তরুণ প্রজন্ম একটা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এটা শুধু ঢাকা ইউনিভার্সিটিতেই নয়, পুরো বাংলাদেশেই। বিভিন্ন জায়গায় কিশোর গ্যাং তৈরি হচ্ছে। পুরো ঢাকা শহরে চুরি-ছিনতাই বেড়ে গেছে।
“এর প্রধান কারণ শিক্ষার্থীদের একটি অংশ মাদকে জড়িয়ে পড়েছে, ক্রিয়েটিভ এক্টিভিটিজ থেকে সরে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলোর লিডারশিপ প্যাটার্নে উইকনেসের কারণেও এই বিষয়গুলো ঘটছে।”
তিনি বলেন, মাদকের ব্যবহার ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। মাদকের জন্য টাকা দরকার, তারা তখন নেগেটিভ জায়গা বেছে নিচ্ছে।
এসব শিক্ষার্থীদের শোধরাতে ‘কাউন্সেলিং’ দরকার জানিয়ে তিনি বলেন, “মূল জায়গাটা কিন্তু সোশাল। যারা বিচ্যুতিমূলক আচরণ করছে, তাদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য কমিটমেন্ট থাকতে হবে।”
অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতা রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, “ক্রাইম প্রিভেনশনের জন্য আমরা যে মিজারমেন্টগুলো (পরিমাপক) ব্যবহার করি, টইল পুলিশ জোরদার করা এবং অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা, এ ক্ষেত্রে ল’ ইনফোর্সমেন্স এজেন্সির একটা বড় দুর্বলতা আছে।
দম্পতিকে মারধর-ছিনতাই: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১১৪ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার
এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ওসি নূর মোহাম্মদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ যেসব স্থানে এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটছে, পুলিশ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় মামলা হলে আমরা খতিয়ে দেখি। এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে, তার জন্য পুলিশি টহল জোরদার করা হয়েছে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়াকে অপ্রত্যাশিত হিসেবে দেখছেন সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রক্টর একেএম গোলাম রব্বানী।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের নেওয়া হয়। এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক যে, এই মেধাবীরাই অপরাধপ্রবণ হয়ে যায়, এরকম অপ্রত্যাশিত নীতিবহির্ভূত কাজে যুক্ত হয়ে যায়।
“শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা অপসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। তারা বিভিন্ন সংগঠনের আদলে এসব কার্যক্রম করতে চায়, এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সেসব সংগঠনের নীতিগত অবস্থান নিয়ে আরও স্পষ্ট নির্দেশনা থাকলে প্রবণতাটা কমে আসবে।“
এসব বিষয়ে পরিবারেরও খোঁজ খবর রাখা এবং সহপাঠী, বন্ধু ও শিক্ষকসহ সবারই নজর রাখা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
ক্যাম্পাসে অপরাধ দমনে পদক্ষেপের বিষয়ে প্রক্টর বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটা ওপেন গেইট, রাত দিন ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। তার মাঝে এই সিজনে ক্যাম্পাসে আনুষ্ঠানিকতা বেড়ে যায়। এই সুযোগে সকল ধরনের মানুষরই সমাগম একটা ঘটে।
“ইদানিং একটা ভালো লক্ষণ হল যে হাতেনাতে ধরাও পড়ছে, বিশ্ববিদ্যালয় এগুলোকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতেছে। এছাড়া আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে অভিযোগ দিলে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলা হচ্ছে।”
কী বলছে ছাত্র সংগঠনগুলো?
এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই ছাত্রলীগ পরিচয় বহন করে বলে অভিযোগ অনেক পুরনো। সাধারণ শিক্ষার্থী এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতাদেরও অভিযোগ, ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগই তাদের নিজেদের স্বার্থে এসব ‘অপকর্ম’ টিকিয়ে রাখছে।
ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক দীপক শীল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, একজন শিক্ষার্থী অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হলেও হলগুলোতে গণরুম ও গেস্টরুম প্রথা তাদের সেই স্বপ্ন ধুলিসাৎ করে দেয়।
গণরুমে যেসব শিক্ষার্থীরা থাকে তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াতে ‘বাধ্য করে’ বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, “যারা সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ে জড়িত, তাদেরও পদায়ন করা হয়। বারবার অপরাধ করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। কিছু ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিলেও পরবর্তীতে তাদের পুরস্কৃত করা হয়। তার বেশ কিছু উদাহরণ আমাদের কাছে আছে।“
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদের সভায় নিরাপত্তার বিষয়টি অনেকবার উল্লেখ করেও কোনো সুরাহা হচ্ছে না বলে জানান এই নেতা।
ছাত্রলীগ নেতাদের মদদে শিক্ষার্থীরা এসব অপরাধে জড়াচ্ছেন বলে দাবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলামের।
তার অভিযোগ, “বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ কোনো ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনকেই তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম করতে দিচ্ছে না। এটা সবাই জানে, ছাত্রলীগ একটা সন্ত্রাসী সংগঠন। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ছিনতাই তাদের মূল পেশা। এটা অস্বাভাবিক কিছু না।“
“ছাত্রলীগ নেতাদের মদদে কিন্তু শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বিপদগামী হচ্ছে। নেতারা যদি কর্মীদের মদদ না দিত, অবশ্যই কোনো কর্মী এগুলো করার সাহস পেত না।”
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলছেন, “এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে ছাত্রলীগ করার সুযোগ কারও নেই। আমরা স্মার্ট ছাত্র রাজনীতি চাই, যারা শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করবে, একাডেমিক এনভায়রনমেন্ট ভালো রাখতে পারবে।
“ছাত্র রাজনীতিকে নিজের অপরাধমূলক কাজের বৈধতা দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে কেউ ব্যবহার করতে চাইলে কিংবা এটিকে টাকা বানানোর মেশিন হিসেবে ছাত্র রাজনীতিকে ব্যবহার করবে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মীদের বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনৈতিক সংমিশ্রণে আসার কোনো সুযোগ নেই।”
যারা ইতোমধ্যে অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় সব সময় ক্লিন ইমেজের, যারা আদর্শিক ঐকতান বজায় রেখে ছাত্ররাজনীতি করে, স্মার্ট ছাত্র রাজনীতি যারা করে- তাদেরকে আমাদের সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় আওতাভুক্ত করব।
বিশ্ববিদ্যালয় বহিষ্কার করলেও ছাত্রলীগ কেন বহিষ্কার করছে না এমন প্রশ্নে সাদ্দাম বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান পরিচালনা করছে, এই প্রসেসটি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আহ্বান জানায়। প্রশাসনের সঙ্গে আমরা দফায় দফায় আলোচনা করেছি। আইনশঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আমরা জানিয়েছি যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এধরনের ঘটনা ঘটছে। তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে।“
রাজনৈতিকভাবে প্রশ্রয় পাওয়ার কোনো ধরনের সুযোগ নেই বলে দাবি করেন তিনি।