বৃষ্টি ছিল মাত্রাছাড়া, তবে বান্দরবানের এভাবে ডুবে যাওয়া বন উজাড়, অপরিকল্পিত নগরায়নের বিষয়টি সামনে এনেছে।
Published : 09 Aug 2023, 01:11 AM
বর্ষার শেষ দিকে অগাস্টে বন্যা বাংলাদেশে নিয়মিত ঘটনা; তবে সেই বন্যা এবার দেখা গেল দেশের ভিন্ন প্রান্তে; অন্য সময় উজানের পানিতে উত্তরাঞ্চলে এমন বন্যা হলেও এবার ঢলে ডুবল পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি শহর বান্দরবান।
কয়েক দিনের টানা বর্ষণে বান্দরবান শহর তলিয়ে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত পানিবন্দি অবস্থায় ছিলেন লাখো মানুষ। পাহাড়ি ঢলে মানুষ ভেসে যাওয়া ও পাহাড় ধসে মাটিচাপার মতো ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকটি।
বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। রোববার রাত থেকে বিদ্যুৎ নেই, তাই নেই মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট।
শহরে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, সদর উপজেলা কার্যালয়, ফায়ার সার্ভিস, আদালত, নির্বাচন কমিশন কার্যালয়, পাসপোর্ট ও বিআরটিএ কার্যালয় হাঁটু পানিতে তলিয়ে আছে।
সড়কে পানি ওঠায় রোববার সকাল থেকে বান্দরবান থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ির পথে বাস চলাচল বন্ধ। রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি উপজেলাও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
বান্দরবান শহরটি আশাপাশের তুলনায় নিচু স্থানে। শহরের পাশ দিয়ে সাঙ্গু নদী (শঙ্খ নদী) বয়ে চলে। রুমা ও থানচির পানি সাঙ্গুর বান্দরবান শহর অংশ হয়ে নিচে নামে।
স্থানীয়রা বলছেন, তিন দশক আগে বান্দরবান শহর অংশে সাঙ্গু নদীতে অনেক বড় বড় পাথর ছিল, নদীর দুই পাড় ছিল উঁচু। পাথর তুলে তুলে বিক্রি করা হয়েছে। নদীতে পাথর না থাকায় ঢলে নেমে আসা মাটিতে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এতে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা কমে গেছে।
বান্দরবান শহরের চারপাশে তুলনামূলক উঁচু পাহাড়। শহরটি মাঝের নিচু অংশে। তাই নদীতে উপচেপড়া পানি হলে তা শহরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
জলাবদ্ধতা আর ভোগান্তি নিয়ে লাখো মানুষের দিনযাপন
বন উজারকে দায়ী করলেন উপজেলা চেয়ারম্যান
বাসিন্দারা বলছেন, বান্দরবান শহর ঘিরে অপরিকল্পিত বসতি তৈরি হয়েছে। মূ্ল শহরে জমির দাম বেশি হওয়ায় আশেপাশের পাহাড় টিলায় জমি কেনা-বেচা চলে, এরপর জমি টিলা-পাহাড় কেটে স্থাপনা করেছে। বর্ষায় পাহাড় কাটা মাটি নামে পানির সঙ্গে মিশে, তারপর গিয়ে পড়ে সাঙ্গুতে।
এছাড়া পাহাড়ি ছড়া ও নালা ভরাট হয়ে যাওয়ায় জেলার বিভিন্ন উপজেলার উঁচু পাহাড়গুলো থেকে সব পানি নামে সাঙ্গুতে।
বনভূমি উজার, পাথর তোলার পরিণাম যে কী হতে পারে, তা এখন দেখা যাচ্ছে বলে মন্তব্য করলেন বান্দরবান সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঝিরি-ঝর্নাগুলো বারো মাস চলমান ছিল, এখন নেই। শুধু বর্ষায় দেখা দেয়। সমস্ত ডিবি-ঝর্ণার পানি নদী শঙ্খ নদীতেই নামে। বিকল্প কোনো পানি নামার ব্যবস্থা নেই।
“এখন যদি শঙ্খ নদীর পানি বাড়ে রুমা, থানছি, বান্দরবান অনিবার্য কারণে ডুবছে। এদিকে মাতামুহুরী নদীর পানিতে লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়িও ডুববে, এটাই বাস্তবতা।”
পার্বত্য এলাকার পরিবেশ বিনষ্টের পাশাপাশি অপরিকল্পিত নগরায়নকেও দায়ী করেন উপজেলা চেয়ারম্যান।
তিনি আরও বলেন, “যে শঙ্খ নদী খরস্রোতা ছিল, তাতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। বন উজার করায় পাহাদের মাটি ক্ষয় এত বেড়েছে যে নদীর আগের নাব্যতা আর নেই। অল্প পানিতেই ফুলে উঠে।
“আমাদের কোনো জোয়ার-ভাটা নেই, শুধু পানি নামে; এ পানি যদি নামতেই না পারে, তাহলে সেটা ফুলে উঠবেই।”
রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে কয়েকদিন আগে ঢাকায় আসা জাহাঙ্গীর এলাকার খোঁজ-খবর রাখছেন বলে জানান।
তিনি বলেন, শহরের নিচু এলাকা সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে। সদর উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ের অধিকাংশই ‘এফেক্টেড’, পানির নিচে রয়েছে তিন দিন ধরে। পাহাড় ধসও হচ্ছে।
১৯৯৭ সালের পর এবারই বান্দরবান সবচেয়ে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত বলে জানান উপজেলা চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, সেবার ছয়-সাত ঘণ্টা পানি স্থায়ী হয়েছিল। এর আগে ১৯৭৭ সালে ক্ষণস্থায়ীভাবে বানের জলে ডুবেছিল শহর। কিন্তু এবার তিন দিন ধরে পানি আটকে আছে।
বন উজার, অপরিকল্পিত নগরায়ন চলতে থাকলে সামনে আরও ভয়াবহ অবস্থা দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন উপজেলা চেয়ারম্যান।
বিশেষজ্ঞ দৃষ্টিতে দুর্যোগের কারণ
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলছেন, এবার বৃষ্টিপাত মাত্রা ছাড়ানো, তার মধ্যে পূর্ণিমার জোয়ারের কারণে দক্ষিণাঞ্চল দিয়ে পানি নামাতেও হচ্ছে দেরি। আর পাহাড় কাটা, বন উজারসহ ভূমির ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন হচ্ছে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পানি ধরে রাখার আধার নষ্ট হচ্ছে। পানি যেগুলোতে বহন হয়, খাল-বিল এগুলোর ধারণক্ষমতা কমে যাচ্ছে। মাটির নিচে সারফেসকে আমরা আরবান করছি। এ তিনটিই আমাদের প্রধান সমস্যা।”
বান্দরবানের মতো সব শহরেই অপরিকল্পিত নগরায়নকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি বলেন, “ড্রেনেজের পথ বন্ধ হয়েছে, ময়লা পরিষ্কার হয় না, সব বর্জ্য তোলা হয় না, আগে যতটুকু পানি আসত এখন অনেক বেশি পানি আসছে। আগে যেখানে মাটির নিচে পানি ইনফিলট্রেট হত, সেখানে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর করে ফেলেছি। লেক, পুকুর আগে যেখানে পানি জমত, সেখানে সবগুলো ধীরে ধীরে পরিবর্তন করছি।”
আবহাওয়াগত পরিবর্তনের বিষয়টি তুলে ধরে বুয়েটের এ শিক্ষক বলেন, “একদিকে বৃষ্টি কম হচ্ছে, আবার যখন হয় অনেক বেশি হচ্ছে। ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন তো আছেই। নগর ব্যবস্থাপনায় নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে। শহরকে বিস্তৃত করতে হবে,অভিযোজন ও প্রকৃতি সংরক্ষণ করে এগোতে হবে।”
চট্টগ্রামের পরিবেশবাদী সংগঠন পিপলস ভয়েসের সভাপতি শরীফ চৌহান বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে পাহাড় কাটা বন্ধে কার্যকর উদ্যোগের পাশাপাশি ঝুঁকিপুর্ণ বসতি স্থাপনকারীদের সচেতন করার বিষয়ে জোর দিয়ে এসেছি। এ বিষয়ে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ না থাকলে পাহাড়ি ভূমি ধসে প্রাণহানির তালিকা বাড়বে।”
ভূতত্ত্বের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার পাহাড়ি এলাকার বাস্তবতা বিবেচনা করে পরিকল্পিত নগরায়নের পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে এলাকায় একবার পাহাড় ধস হয়েছে, সেখানে পাঁচ-দশ বছরে নতুন করে সম্ভাবনা কম। কিন্তু যেখানে হয়নি, সেখানে পাহাড় ধসের শঙ্কা বাড়ে।”
কেন এক বৃষ্টি?
এবার টানা ভারি বর্ষণকে বর্ষার ‘পরিপূর্ণ রূপ’ হিসেবে দেখছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান।
তিনি বলেন, এখন মৌসুমী বায়ু বেশ সক্রিয়, বৃষ্টিপাত হবে স্বাভাবিক। জুন-জুলাই মাসে এবার স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হলেও ১ অগাস্ট থেকে ভারি বর্ষণ হচ্ছে।
বান্দরবানে রোববার ২৬৮ মিলি মিটার, সোমবার ২৮৬ মিলি মিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ৭ অগাস্ট ৩২২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে চট্টগ্রামে, তাতেও নগরীটি তলিয়েছে।
আজিজুর রহমান জানান, দেশেএ পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড রয়েছে ২০০১ সালে সন্দ্বীপে ৫৯০ মিলি মিটার। চট্টগ্রামে ৪৬৩ মিলি মিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল ২০১২ সালের ২৬ জুন।
“মৌসুমী নিম্নচাপ হয়েছিল, তা উঠে যাওয়ার পর বৃষ্টি বেড়ে গেছে। সাগরে ও দেশের উপরে সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর কারণে হচ্ছে।”
চট্টগ্রাম অঞ্চলে বুধবার থেকে ভারি বর্ষণের প্রবণতা কমে আসার আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আজিজুর রহমান বলেন, “আগামীকাল থেকে চট্টগ্রাম, বরিশালসহ উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টিপাতের তীব্রতা কমে আসবে। তবে এসময় রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ বিভাগে দুই-তিন দিন বৃষ্টি বাড়বে।”
এরপর ১২ অগাস্ট থেকে দক্ষিণাঞ্চলে বৃষ্টি বাড়বে বলে আভাস দেন তিনি।
বৃষ্টি একেবারেই কমে যাবে, অগাস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত এমন সম্ভাবনা নেই বলে জানান তিনি।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন মিঠুন চৌধুরী