তবে শিল্প-সাহিত্যে আমাদের বোধগম্য অর্থেই নকল ও চুরি-চামারির ঘটনা আকছারই শোনা যায়।
Published : 18 Apr 2024, 01:28 PM
দার্শনিক প্লেটোর মতে আমাদের এই বিশ্বজগৎ একটা নকল জিনিস। আসল জিনিসটা আছে ভাবের দেশে। এই জগৎ শুধু নকলই নয়, বরং একটা ছায়া মাত্র। বিভ্রম। মায়া। আমরা দেখার-বোঝার ভুলে এটাকে আসল মনে করি। এই আসল নকলের পার্থক্য বোঝাতে প্লেটো এক গুহার গল্প ফেঁদেছেন। সেই গল্পে এখন না যাই। কিন্ত প্লেটোর মতে শিল্প-সাহিত্য হলো নকলেরও নকল। আসল বা মৌলিক বলে কিছুই নাই এখানে। নকলনবিশ কবিকে প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্র হতে ভাগিয়ে দেবারও মতলব এঁটেছিলেন। এ বড় জটিল দার্শনিক কূটকচাল। আমরা এখন ওই প্যাঁচাল আর বাড়াব না।
তবে শিল্প-সাহিত্যে আমাদের বোধগম্য অর্থেই নকল ও চুরি-চামারির ঘটনা আকছারই শোনা যায়। তবে কি না, যদি কড়াকড়িভাবে লোম বাছতে যাওয়া হয়, তবে কম্বল বলে কিছুই আর থাকবে না সম্ভবত। তাই নকলের পাশাপাশি আরেকটি অভিধা ব্যবহৃত হয় মিষ্টিভাষণ হিসাবে : অনুসৃজন বা অনুসর্জন। অর্থাৎ কোনো শিল্প বা সাহিত্যকর্মের উপাদান যে-কোনো পরিমাণে গ্রহণ করে তাকে নতুন রূপে উপস্থাপন করা। টি এস এলিয়টের একটা বিখ্যাত উক্তি আছে এরকম যে ছোট কবিরা নকল করে, আর বড় কবিরা চুরি করে। চোরাই মালটাকে তারা আপন-আপন সৃজন প্রতিভায় এমনভাবে রূপান্তরিত করে যে সেটা একরকম মৌলিকতায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
গানের ক্ষেত্রে নকল বা চুরি-চোট্টামি একটু বেশিই হয়। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের গানের দুই মহৎ কাণ্ডারী রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সুরসম্পদের বিরাট অংশ দিনেদুপুরে সংঘটিত নকল ও চুরির মাল। এই বাউল গান তো ওই মিশরীয় সুর, এই কীর্তন তো ওই লোকগীতি। ধ্রুপদ-গজল এইসবের কথা আর না বাড়ালেও চলে। শুধু সুর নয়, ভাবসম্পদেও হাতসাফাই আছে কলিতে-কলিতে। তবে তারা বড় মাপের সৃষ্টিকর্তা বলে মাঝে-মাঝে এটা-সেটা কথা উঠলেও তারা পার পেয়ে স্বমহিমায় বিরাজমান থেকে যান। এই দুই মহাজনের নামে এমনতর নালিশ তোলায় গোনাহ হলো কি না তা আল্লাহ মাবুদ ভালো জানেন। তওবা পড়ে রাখি। এবং গৌরচন্দ্রিকা আর প্রলম্বিত না করে আসল আলাপে আসি এই বেলা।
'রাফতা রাফতা ও মেরি
হাস্তিকা সমান হো গ্যেয়ি।'
মেহদি হাসানের গাওয়া এই বিখ্যাত গজলটি নিয়ে কিছু চিত্তাকর্ষক ব্যাপার আছে। এই গানটি মেহদি হাসান করেন পাকিস্তানি উর্দু সিনেমা 'জিনাত' (১৯৭৫)-এর জন্য। নামচরিত্রে শবনম অভিনীত এই ছবির পরিচালক ছিলেন এস সুলেমান। সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন নাশাদ। গানগুলো লেখেন তাসলিম ফাজলি।
তাসলিম ফাজলি ছিলেন উর্দু সিনেমার প্রধান গীতিকারদের একজন। ১৯৬৮ সালে 'আশিক' ছবির মাধ্যমে তার গীতিকারের পেশা শুরু হয় ও ক্রমে নামদার হয়ে ওঠেন। 'রাফতা রাফতা' ছাড়াও তার খুব বিখ্যাত গানের মধ্যে আছে মেহদি হাসানের গাওয়া 'খুদা কারায় কে মুহাব্বত মেঁ' কিংবা আখলাক আহমেদের গাওয়া 'সোনা না চান্দি না কোই মহল, জানে মান' ইত্যাদি।
তাসলিম ফাজলির জন্ম ১৯৪৭ সালে। তার আসল নাম ইজহার আনোয়ার। লেখাই ছিল তার পেশা। অভিনেত্রী নিশোকে তিনি বিয়ে করেন। ১৯৮২ সালে তিনি প্রয়াত হন।
জিনাত সিনেমায় গীত হবার পর 'রাফতা রাফতা ও মেরি' গানটি দিকে-দিকে জনপ্রিয় হতে থাকে। মেহদি হাসান অনেক-অনেক জলসায় গানটি করেছেন বার বার।
এর বছর বিশেক পরে ঘটল এক অঘটন। বলিউডের সিনেমা 'বাজি' (১৯৯৫)-র জন্য সমীর লিখলেন এমন একটা গান যা খুব পীড়াদায়কভাবে রাফতা রাফতার সাথে সমান্তরাল : বলা যায় নকল। সুর করেছিলেন আনু মালিক। গানটি গেয়েছিলেন উদিত নারায়ণ ও সাধনা সারগাম। গানটির কথা এরকম : Dheere dheere aap mere dil ke mehmaaN ho gaye. (ইউটিউবে গানটি আছে, শুনে দেখতে পারেন)।
চুরি-চোট্টামি-নকল নিয়ে বেশি একটা বলার কিছু নাই। তবে সমীরের লেখা গানটি মেহদি হাসানের গাওয়া গানটিকে নতুন করে আবার জনপ্রিয় করে তুলল। নিশ্চয়ই নকলের চেয়ে আসলটা ভালো।
কিন্তু...
কৌতুকজনকভাবে এখানে একটা কিন্তু রয়ে গেছে। তাসলিম ফাজলির গানটিও (খুকখুক) নকলই। তার লিখবার একদশক আগে ভারতের প্রখ্যাত গীতিকার ও কবি কামার জালালাবাদী (১৯১৭-২০০৩) 'হাম কাহান জা রাহে হ্যাঁয়' (১৯৬৬) ছবির জন্য যে গান লিখেছিলেন তার শব্দবিন্যাস আর তাসলিম ফাজলির লেখা গানটির শব্দবিন্যাসের মিল বিস্ময়কর রকম। এই গানটিতে সুর করেন বসন্ত প্রকাশ। গানটি গেয়েছেন মহেন্দ্র কাপুর ও আশা ভোঁসলে। গানটির কথাগুলো এরকম :
rafta rafta woh hamaare dil ke armaaN ho gaye
pahle jaaN, phir jaan-e-jaaN, phir jaan-e-jaanaaN ho gaye
rafta rafta woh meri taskeeN kaa saamaaN ho gaye
pahle dil, phir dilrubaa, phir dil ke mehmaaN ho gaye
rafta rafta unki aaNkhoN kaa nasha ba.Dhne lagaa
pahle mai, phir mai-kada, phir mai kaa toofaaN ho gaye
rafta rafta husn nikharaa aur nikhartaa hi gayaa
pahle gul, phir gulbadan, phir gul-ba-daamaaN ho gaye.
নিচে তাসলিম ফাজলির লেখা ও মেহদি হাসানের গাওয়া গানটির আমার করা অনুবাদের পর মূল গানটি দেওয়া আছে। তার সাথে এই গানটি মিলিয়ে দেখুন। ইউটিউবে গানটি আছে, শুনেও দেখতে পারেন।
জগত বড়ই মজার...
পুনশ্চ : এই যে লেখাটি লিখলাম, এটিও একটি নকল রচনা। আন্তর্জালের কয়েকটি লেখা থেকে মালমসলা টুকে এখানে পরিবেশন করলাম মাত্র। তবে নিচে গানটির যে পদ্যরূপ ভাবানুবাদ আছে সেটি এই অধমেরই কৃতকর্ম, কারো থেকে টুকলিফাই করা নয়। তবে অনুবাদ যেহেতু, সেই কারণে এটিও মূলেরই নকল। অর্থাৎ এই জগতে নকলেরই কারবার।
//রাফতা রাফতা ও মেরি//
আস্তে আস্তে একদিন সেই মেয়ে
আমার আমির সমান উঠল হয়ে।
হলো সে আমার জান ও জানের জান,
তারপর হলো প্রেমিকা, ভরলো প্রাণ।
দিনে দিনে তার শরীরে দেখি যে ক্রমে
রূপের উপরে রূপ উঠছেই জমে।
প্রথমে ছিল সে গোলাপের ঘ্রাণ
তারপরে হলো ফুল,
এরপর দেখি আস্ত বাগান
হয়ে গেছে বিলকুল।
কাছে হতে তুমি আরও কাছে এলে
হৃদয়ে জাগালে টান,
প্রিয়তমা হয়ে তারপর হলে
হৃদয়ের মেহমান।
প্রণয় যখন সীমানা ছাড়ালো
দূর হলো লোকাচার,
নিয়ম ডিঙানো নিয়মই তো তুমি
ধারি না রীতির ধার।
Rafta Rafta Wo Meri Hasti Ka Saman Ho Gaye
Pehle Jaan Phir Jaan-e-jaan Phir Jaan-e-jaana Ho Gaye
Deen-ba-deen Badhti Gayi Iss Husn Ki Ronaiya
Pehle Gul Phir Gulbadan Phir Gulbadama Ho Gaye
Aap Tou Nazdik Se Nazdik-tar Aate Gaye
Pehle Dil Phir Dilruba Phir Dil Ke Mehman Ho Gaye
Pyaar Jab Haad Se Badha Saare Taqalloufh Mit Gaye
Aapse Phir Tum Houe Phir Tu Ka Unwan Ho Gaye.