যাই হোক, কাসাসের আমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম এবং কয়েকদিন পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনের প্রথম জনসম্মুখে বক্তৃতাও দিলাম।
Published : 22 Apr 2024, 04:21 PM
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার আরবেলিয়া গ্রামে শাক্ত ব্রাহ্মণ ভট্টাচার্য পরিবারে ১৮৮৭ সালে জন্ম নরেন্দ্রনাথের যিনি পরে এম এন রায় হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামী, কমিউনিস্ট বিপ্লবী ও তাত্ত্বিক মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সমধিক পরিচিতি উদার মানবতাবাদের (radical humanism) তাত্ত্বিক ও প্রবক্তা হিসেবে। বিপ্লবী জীবনে তাঁকে বহু ছদ্মনাম নিতে হয়েছিল। ১৯৫৪ সালের ২৫শে জানুয়ারি প্রয়াত হন এই মনিষী।
মেক্সিকো সফর তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা। এক অর্থে তার রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি এই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেও মানবেন্দ্রনাথের মেক্সিকো-সফর বড় ধরনের বাঁক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ইংরেজিতে লিখিত তাঁর স্মৃতিকথা Memoirs ১৯৬৪ সালে দিল্লী থেকে প্রকাশিত হয়। ৬২৮ পৃষ্ঠার এই দীর্ঘ স্মৃতিকথার শতাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে মেক্সিকো বাসের রোমাঞ্চকর ও ঘটনাবহুল স্মৃতি। মূল গ্রন্থের ৫ম অধ্যায় থেকে ২৯ অধ্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত সেই স্মৃতিচারণ। স্মৃতিকথার এই নির্বাচিত অংশ কলামিস্ট অনুবাদক প্রিসিলা রাজ-এর অনুবাদে ধারাবাহিকভাবে বাংলা ভাষায় প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। আজ থাকছে মেক্সিকো সফরের দ্বাদশ পর্ব। এই অনুবাদে মূল বইয়ের পর্ব-বিন্যাস অনুসরণ ও উল্লেখ করা হয়েছে।
১৬
মেক্সিকোতে আসার পর প্রথমে যে কাজগুলো করেছিলাম তার মধ্যে ছিল স্প্যানিশ শিক্ষকের কাছে ভাষা শিখতে শুরু করা। এল পুয়েবলোর সম্পাদক এক প্রবীণ শিক্ষকের কথা বলেছিলেন। ভদ্রলোক এসকুয়েলা নাসিওনালে পড়াতেন। তাঁর পদবী ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের সমমানের। কিন্তু মেক্সিকোতে উচ্চবিদ্যালয়কে বলে কলেহিওস বা কলেজ আর তাদের শিক্ষকদের প্রফেসর বা অধ্যাপক বলা হয়। অন্যদিকে কলেজকে বলে এসকুয়েলা অর্থাৎ স্কুল। স্কুলের কেবলমাত্র বিভাগীয় প্রধানকে বলা হয় মায়েস্ত্রো। ফলে আমার স্প্যানিশ শিক্ষকের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পদবী না থাকলেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকের সমপর্যায়ভুক্ত ছিলেন। স্বল্পআয়ের খুবই সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ভদ্রলোকের চিন্তাভাবনাও বেশ পুরানো ধাঁচের। ঘুরেফিরে (পোরফিরিও) দিয়াস আমলের স্বর্ণালী দিনগুলোর কথা বলতেন। বিপ্লব পরবর্তী ধ্বংসলীলা এবং বাড়াবাড়ি চাকচিক্য দুটো নিয়েই দুঃখ করতেন। তবে দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে ভদ্রলোকের মধ্যে একধরনের দার্শনিক উদাসীনতা ছিল। রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ নেই। বিপ্লবী নেতৃত্ব সম্পর্কেও তাঁর ধারণা খুব উচ্চ নয়।
বিশেষ করে ওনার দুঃখ ছিল দেশের সাংস্কৃতিক অবক্ষয় নিয়ে। সেটা বোঝাতে উনি মাঝপথে নির্মাণ থেমে যাওয়া অপেরা হাউজটার কথা বলতেন। ইউরোপীয় ধনীদের কালচার অনুসরণ করে গ্র্যান্ড অপেরা ও বিভিন্ন ব্যালে ট্রুপ প্রতিবছর শীতে মেক্সিকো সিটিতে অনুষ্ঠান করে যেত। রাজধানী শহরের মর্যাদা বাড়াতে তাই দিয়াস তাঁর শাসনের শেষদিকে ইউরোপের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ অপেরা হাউজগুলোর সঙ্গে তুলনীয় একটি অপেরা হাউজ বানাতে এক কোটি পেসো বরাদ্দ করেছিলেন। স্থপতি ও দক্ষ শ্রমিকদের ইতালি থেকে আনা হয়েছিল। কিন্তু মার্বেলের সেই গর্বিত কাঠামো অর্ধেক শেষ হওয়ার আগেই বিপ্লব এসে পড়ে। আমি যখন এই শহরের বাসিন্দা ছিলাম তখনও নগরের কেন্দ্রে একটা পার্কের ভেতর অসংখ্য ভারার জঙ্গলের মধ্যে বিল্ডিংয়ের কাঠামোটি দণ্ডায়মান ছিল। দিয়াস আমলের বিগত রোশনাইভরা দিনের স্মারক ছিল শেষ না হওয়া এই ইমারত। গ্র্যান্ড অপেরা ও ব্যালের দল মেক্সিকোতে আর আসত না।
অন্যদিকে, জাতির দারুণ প্রিয় বুলফাইট বা ষাঁড়ের লড়াইও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কাররান্সা সরকার আসার পর থেকে। যুক্তিটা হচ্ছে, বুলফাইট নিষ্ঠুর ও বর্বর। দিয়াসের সময়ই নির্মিত মেক্সিকো সিটির বুলফাইট রিং যেটা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় বুলফাইট রিং, সেটাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বৃত্তাকার স্টেডিয়ামটির ধারণক্ষমতা ছিল ৩৫ হাজার। অপেরাহাউজের নির্মাণ শেষ না হওয়াকে সাংস্কৃতিক অগ্রগতির পথে অন্তরায় হিসেবে মনে করা হয়। কিন্তু বুলফাইট নিষিদ্ধ ঘোষণা ছিল সত্যিকার অর্থে বিপরীত পথে যাত্রার স্মারক। আমার শিক্ষকের মতো এক শ্রেণীর মানুষ কুঁড়ে ধনীদের দল এবং তাদের বিলীয়মান গৌরবের কথা ভেবে সর্বদা বিলাপ করতেন। দেশে নতুন এক গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার যে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে তার বিপুল সম্ভাবনা তাদের চোখে পড়ত না।
১৯১৮-এর শুরুর দিকে বুলফাইটের বিরাট রিংটাকে উপযুক্ত কাজে লাগানো হলো। বোঝা গেল দিয়াসের নেতৃত্বে অর্জিত সাংস্কৃতিক উৎকর্ষকে ধ্বংস করতে আসেনি বিপ্লব। মেক্সিকো সিটিতে আবারও ইতালিয়ান গ্র্যান্ড অপেরা ও রুশ ব্যালে ট্রুপের আগমন ঘটল। অপেরা হাউজটির নির্মাণকাজ সময়মতো শেষ করা যায়নি। কিন্তু বিপ্লবী সরকার সাধারণ মানুষকে শিল্প উপভোগের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে চায়নি। এজন্য ষাঁড়ের লড়াইয়ের মঞ্চ খুলে দেওয়া হলো। বিশাল গ্রীক স্টেডিয়ামে ঠাসা তিরিশ হাজারের ওপর দর্শক কয়েকদিন ধরে কারুসোর সঙ্গীত পরিবেশনা উপভোগের সুযোগ পেল। মানুষের কণ্ঠস্বর যে এমন হতে পারে কল্পনাতেও ভাবিনি। কারুসোর রাজসিক কণ্ঠে সঙ্গীতের অভিজ্ঞতা নেওয়ার পর পাভলোভার নাচ ও পুরো রুশ ব্যালে দলের পরিবেশনাকে রীতিমতো পানসে ও খামখেয়ালি বলে মনে হতে লাগল আমার। বলা বাহুল্য, মহৎ শিল্প সম্বন্ধে আমার মতামত তখনও একেবারেই আদিম পর্যায়ে।
পেশিবহুল পুরুষমানুষের অন্তর্বাস পরে সারা মঞ্চ দাপিয়ে বেড়ানোর মধ্যে শিল্প কোথায় সেটা বোঝার মতো আক্কেল তখনও তৈরিই হয়নি আমার। মনে হয়েছিল ওটাকে চৌকস জিমনাস্টিকস বলা যেতে পারে বড়জোর। আর সেটার জন্য সার্কাস দেখতে গেলেই তো হয়। সেখানে বরং আরো চমৎকার সব কৌশল দেখা যায়। সত্যি বলতে, ব্যালের ব্যাপারে আমার শিল্পবোধ আজও তেমন ধারালো হয়ে উঠতে পারেনি। একমাত্র রুশ অপেরাগুলোর ব্যালেতেই তৃতীয় অঙ্ক নিরুদ্বেগে পার করতে পারি। আর সেটাও সম্ভব হয় পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর ভর করে ভেসে বেড়ানো মহিলা ব্যালেরিনার জন্য নয়। মূলত সঙ্গীত ও এর সব অনুষঙ্গ মিলিয়ে যে একটা ঝাকানাকা ব্যাপার তৈরি হয় সেটাই মুগ্ধ করে আমাকে।
আগেই বলেছি, স্প্যানিশ ব্যাকরণে প্রাথমিক পাঠের পরে মূলত অনুবাদকর্মের মাধ্যমে আমি স্প্যানিশ ভাষাটা শিখেছিলাম। আমার উত্তম শিক্ষকের সাহায্যে দ্য ওয়ে টু ডুরাবেল পিস নামে পুস্তিকাটি মার্কিনদেশে থাকতেই রচনা করেছিলাম। মেক্সিকোতে থাকার সময় বইটাতে মনরো ডকট্রিন ও এর উদ্ভবের পরের একশ‘ বছরে এর প্রয়োগ-ইতিহাসের ওপর একটি লম্বাগোছের অধ্যায় যোগ করলাম। অধ্যায়টি লেখার সময় “নয়া বিশ্বের“ (Nuevo mundo) ইতিহাস বিশেষ করে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কালের ওপর বেশ গভীর পাঠের সুযোগ হলো। এই পড়াশোনা আমার জন্য অত্যন্ত ফলদায়ক হয়েছে। বিশেষ করে আমার রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার বিকাশ ও সমকালীন বিশ্ব পরিস্থিতি বোঝার ক্ষেত্রে তা বিশেষভাবে সহায়ক হয়েছে।
১৮২৩ সালে রচিত মনরো ডকট্রিনের উদ্দেশ্য ছিল, জর্জ ওয়াশিংটনের ঘোষণার পর বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপ থেকে আত্মরক্ষা এবং সেইসাথে শক্তিধর ইউরোপীয় দেশগুলোর পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া আদায়। যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম রাষ্ট্রপতি জেমস মনরো কংগ্রেসে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেন:
আমেরিকার মহাদেশসমূহ স্বাধীন এবং স্বনির্ভর অবস্থা পরিগ্রহ করেছে এবং রক্ষা করেছে এবং এখন থেকে কোনো ইউরোপীয় শক্তির দ্বারা উপনিবেশ স্থাপনের জন্য আর বিবেচিত হবে না।
সেটা ছিল ১৮২৩ সালের ঘটনা। তার আগের দশ-পনেরো বছরে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার দেশগুলো একের পর এক স্পেনীয় শাসনের শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু এতে ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া “পবিত্র রিস্তা” (Holy Alliance) দিয়ে বাঁধা থাকায় একটা ভয় ছিল স্পেন বুঝিবা আমেরিকার উপনিবেশগুলো আবার নিজের অধীন করার চেষ্টা চালাবে।
অর্থাৎ শুরুতে মনরো ডকট্রিন ছিল আমেরিকা থেকে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের প্রতি “তফাৎ যাও” সঙ্কেত। এই নীতির নির্দেশনাতেই পরবর্তী একশ’ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি অবলম্বন করা হয়েছে। এই নীতির সাম্প্রতিকতম প্রকাশ ছিল জাতিপুঞ্জ (League of Nations) থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে থাকার মধ্যে। বলা যায়, প্রায় অস্তমিত এক রশ্মির শেষবারের মতো জ্বলে ওঠা ছিল এই ঘটনা। ১৯২৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দাওস পরিকল্পনা (Dawes' Plan) ও ইয়াং পরিকল্পনা (Young Plan) এই দুইয়ের মাধ্যমে ইউরোপে প্রথমবারের মতো হস্তক্ষেপ করে, যার প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় জার্মানিতে। আর এর ফলে জার্মানিতে ফ্যাসিবাদ উত্থানের পটভূমি তৈরি হয়।
অন্যদিকে মনরো ডকট্রিন ঘোষণার পরে এই নীতি প্রয়োগের মধ্য দিয়ে পরবর্তী একশ’ বছরে যুক্তরাষ্ট্র “নয়াবিশ্বের” ওপর কার্যত একটি করদ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে। ইউরোপীয় উপনিবেশবাদী শক্তিকে প্রতিহত করার অজুহাতে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় বারবার সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে। সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী হওয়ার ফলে মেক্সিকো এদিক থেকে সবচেয়ে বেশি হস্তক্ষেপের শিকার হয়েছে। দেশটির বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে অসংখ্য সশস্ত্র অভিযান ছাড়াও আমেরিকা দুবার বড় ধরনের যুদ্ধ করেছে এবং এর বিরাট ভূখণ্ড বেদখল করে নিয়েছে। এই ভূখণ্ডই এখনকার টেক্সাস, অ্যারিজোনা ও ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্য।
ঊনিশ শতকের শেষ দশকগুলোর আগে পর্যন্ত নিজ দেশের ভেতরেই যুক্তরাষ্ট্র ব্যস্ত থেকেছে। এমন কি তারও পরে দেশটিকে অন্যদের কাছে ঋণ নিয়ে চলতে হয়েছে। বিদেশী পুঁজি বিশেষ করে ব্রিটিশ পুঁজি দেশটির নাটকীয় শিল্প উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। সে সময়টায় মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার অর্থনৈতিক জীবনে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করা সম্ভব ছিল না। ঊনিশ শতকের শেষভাগে এসে রিও গ্রান্দের উত্তর পর্যন্ত অধিকার করার পরে আমেরিকা “নয়াবিশ্ব” দখলের দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করে। মনরো নীতির মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক অধীনতার সূচনা ঘটেছিল সেটাই অর্থনৈতিক প্রভুত্বের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। কার্যত এই নীতি একচেটিয়া মার্কিনি অর্থনৈতিক স্বার্থের বিস্তার ঘটায়। এর মধ্য দিয়ে দুর্বলতর প্রতিবেশী দেশগুলোর রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়। এসব দেশে বারম্বার বিপ্লব-বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধ বাধানোর জন্য মদদ দান যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতির অংশ হয়ে দাঁড়ায়। এদিক থেকে নিখিল-মার্কিনবাদ প্রকৃতপক্ষে নিখিল-জার্মানবাদ বা জাপানের “যৌথ-উন্নয়ন বলয়”-এরই নামান্তরমাত্র।
আমার বইয়ের জন্য মনরো ডকট্রিনের ওপর লেখা অধ্যায়টি প্রথমে “এল এরাল্দো দে মেক্সিকো” পত্রিকায় সিরিজ নিবন্ধ হিসেবে প্রকাশিত হয়। লেখাগুলো বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং উচ্চ পর্যায়ের মেক্সিকানদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব স্থাপনে সহায়ক হয়। মুহের মদের্নার কাছে দন বেনুস্তিয়ানোর বিশেষ মুগ্ধতার সংবাদও পেলাম। লেখাগুলো তাঁর মতে শুধু যে ইতিহাসের একটা ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছে তা-ই নয়, গুরুত্বপূর্ণ কিছু রাজনৈতিক উপসংহারও হাজির করেছে। তা থেকে যে দিকনির্দেশনা বেরিয়ে এসেছে তার মর্মার্থ হলো - উত্তর আমেরিকার মাষ্টারি বন্ধ করতে হবে। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে একটা লাতিন আমেরিকান লীগ গঠন করা জরুরি যা যুক্তরাষ্ট্রের টাকায় পরিচালিত প্যান-আমেরিকান জোটের বিপরীতে কাজ করবে। একটা ভাবনা হিসেবে বিষয়টা প্রেসিডেন্ট কাররান্সার কাছে উপস্থাপন করি আমি। সেটাকে তিনি বেশ উৎসাহের সঙ্গেই গ্রহণ করেন। জার্মান কাইজারের প্রিভি কাউন্সিলর এ ধরনের একটি আন্দোলনে মদদ যোগানোর উদ্দেশ্যে মেক্সিকোতে আসার কিছুদিন আগের ঘটনা ছিল এটা। কাররান্সা সম্ভবত প্রিভি কাউন্সিলরের আগমন সংবাদ জ্ঞাত হয়েই আমার সঙ্গে অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করেছিলেন।
আমার প্রথম সাহিত্যকর্ম প্রকাশ উপলক্ষে সমাজের উচ্চবলয়ে একটা অনুষ্ঠান আয়োজিত হলো। লা মুহের মদের্না টিপার্টি থ্রো করল। সেখানে নিমন্ত্রিতদের মধ্যে মুহের মদের্নার ফুলকুঁড়ি কবিসাহিত্যিকদের দল বাদেও হোমরাচোমরারা উপস্থিত ছিলেন। মায়েস্ত্রো কাসাসের মতো এলিট বুদ্ধিজীবীও এসেছিলেন। বেশ কয়েকজন জেনারেল, মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ আমলাদেরকেও পাওয়া গেল। ডেপুটিদের চেম্বারের সভাপতি ও কতিপয় বামপন্থী রাজনীতিকরাও নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। দুঃখের বিষয়, মুহের মদের্নার সালোঁতে কোনো সিরিয়াস আলোচনা সম্ভব ছিল না। খোঁপায় কালো সিগারেট গুঁজে তাকেই মঞ্চপ্রদীপের তলায় বসতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীও ছিল না। বুদ্ধিবৃত্তিক ভানে ভরা সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে ললনাকূল দূরে থাকতেই ভালবাসেন।
লা মুহের মদের্নার উপগ্রহভুক্ত জনৈক কবি যাঁর কবিতা অনিবার্যভাবেই তার নামে ছাপা হতো (মুহের মদের্না তাঁর লেডিলাভ), তিনি এক আবেগথরথর প্রশংসাপত্র পাঠ করলেন - “রহস্য ও জ্ঞানের আকর প্রাচীন রাজ্য হতে বিষণ্ণ দার্শনিক” আগত হয়েছেন আজ লাতিন ইন্ডিয়ান আত্মায় অগ্নি প্রজ্জ্বলন করবার জন্য যা থেকে উদ্গীরিত বিপুল শিখায় পুড়ে খাক হয়ে যাবে উত্তর আমেরিকার দাসত্বের যত বিপন্নতা, মেক্সিকোবাসীর হৃদয়ে তিনি আবারও জাগিয়ে তুলবেন মোরেলোস, ইদাল্গো ও হুয়ারেসের মহান ঐতিহ্যকে যাঁরা এই দেশকে শুনিয়ে গেছেন স্বাধীনতার পরম বার্তা।” প্রশংসাপত্রে ব্যবহৃত রূপকগুলো বর্ণনার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম মাত্র। তবে এর আবেগঘন স্বরটাই সবচেয়ে দেখার মতো। পার্টিতে উপস্থিত সবাই দেখলাম সাংঘাতিক আপ্লুত হয়ে উঠলেন। কেবলমাত্র মায়েস্ত্রো কাসাসের ঝোঁপালো কেশের নিচে বিরাট মুখমণ্ডলে তীর্যক এক টুকরো হাসি ঝুলতে দেখলাম। বেশ পছন্দ হলো আমার তাঁর এই হাসি। বাকিদের মধ্যে সামরিক পরিচ্ছদে আগত জেনারেলদের খাপবদ্ধ তরোয়ালগুলো যেন নড়ে উঠল এই বক্তৃতা শুনে, কূটনীতিকরা আবেগহীন চেহারাটা ধরে রাখতে সক্ষম হলেন, মন্ত্রীমশাইদের বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়কদের মতো দেখাতে লাগল, রাজনীতিকরা শতমুখে প্রশংসায় ব্যস্ত হলেন। কেবল হোস্টেসের উপগ্রহভুক্তরা ঈর্ষায় সবুজ হয়ে উঠলেন বলে আমার চোখে ধরা দিলো।
পাঠ শেষ হওয়া মাত্র হোস্টেস উঠে গেলেন তাঁর কাব্যিক ভক্তের কাছে, হাতখানি ধরে দমিত বিপুল আবেগে ছোঁয়া থরথর কণ্ঠে (ভদ্রলোক বিবাহিত এবং ক্যাথলিক চার্চে বিবাহবিচ্ছেদ নিষিদ্ধ) বললেন, “অপূর্ব”। কৃতজ্ঞ পুরুষটি ঝুঁকে অর্চিতর পায়ে প্রায় পড়েই গেলেন।
তীব্র আবেগের উষ্ণ বায়ুমণ্ডল থেকে মাটিঘেঁষা বায়ুতে সবাইকে নামিয়ে আনার উদ্যোগ নেয় গদ্যাকার মুহের মদের্না। এমনকী তার পূজারী কবির ওপরও মঞ্চপ্রদীপ বেশিক্ষণ আলো ফেলুক মেনে নেওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে। কবির দিকে একটা চোরা চাউনি হেনে তার করমর্দন সেরে দ্রুত সে স্বভূমিকায় ফিরে আসে - একটা কালো সিগারেট বের করে। তার অগ্নিসংযোগে আধাডজন পুরুষ ছুটে আসে। অবশ্য তার কেশদাম স্পর্শ করে কেশকাঁটা বের করে আনার মতো ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ কাউকে দেয় না সে। এবার তার বক্তৃতা দেওয়ার পালা। কয়েক বাক্যের সংক্ষিপ্ত কেজো পুরোপুরি বিষয়কেন্দ্রিক বক্তব্যে সে জানায়, বইয়ের লেখককে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে মোলাকাত করিয়ে দিতে হবে অবশ্যই। আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ প্রক্রিয়ার প্রস্তুতিপর্বে লেখকের স্বহস্তে স্বাক্ষরিত বইয়ের একটি কপি সে নিজে দন বেনুস্তিয়ানোর হাতে তুলে দেবে। সবার সরব সমর্থনের মাঝখানে কেবল মায়েস্ত্রো কাসাস নিমরাজী ভঙ্গীতে আবছা মাথা ঝাঁকালেন। পার্টির লোকজন প্রায় সকলে বিদায় নিলে আমার কাছে এসে উনি গরগর করে উঠে বললেন - যতসব খামখেয়ালি অতিআবেগ। বিষয়টাকে সাধারণ মানুষের মতামতের জন্য ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল। একমাত্র সাধারণ মানুষই সুচিন্তিত মতামতের ভিত্তিতে বিবেচনাসম্পন্ন জনমত গড়ে তোলায় সাহায্য করতে পারত। সেরকমই একটা বিষয় এটা। আমি কি এ বিষয়ের ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে আগ্রহী?
প্রস্তাবটা রীতিমতো রোমাঞ্চকর আমার জন্য। কিন্তু একইসঙ্গে বক্তৃতা দেওয়ার ভাবনাটা মাথায় নিতেই শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। তখনও পর্যন্ত জনসম্মুখে কোথাও কোনো বক্তৃতা দেওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল না আমার। যেসব ষড়যন্ত্রকেন্দ্রিক বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলাম সেখানে বক্তৃতাবাজি কাজের অংশ ছিল না। শব্দের বিপ্লব ঘটানোর তত্ত্বে আমাদের বিশ্বাস ছিল না। এজন্য দরকার আরো আরো শক্তিশালী অস্ত্র। শুরুর দিকের সেই বদ্ধবিশ্বাস থেকে বেরিয়ে এলেও বক্তৃতামঞ্চে কখনও সফল হইনি। মেক্সিকোবাসের সময়টাতে বক্তৃতা দিতে শিখেছিলাম বটে তবে সেটা সীমিত সংখ্যক শ্রোতাদর্শকের সামনে। যেমন পার্টির সম্মেলন, পার্টি সদস্যদের সভা বা ট্রেড ইউনিয়নের মিটিং। রাশিয়ায় পা দেওয়ার আগে কখনও জনতার সামনে বক্তৃতা দিইনি আমি।
যাই হোক, কাসাসের আমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম এবং কয়েকদিন পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনের প্রথম জনসম্মুখে বক্তৃতাও দিলাম। সব ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন। বক্তৃতাটা ছিল স্প্যানিশে। আমার শিক্ষকের সাহায্যে আগেই লিখে নিয়েছিলাম। আমার শিক্ষককে ছাত্রের ব্যাপারে খুব গর্বিত দেখাচ্ছিল। দ্বিতীয় দিনে আরো সাহসী হয়ে দেখে দেখে না দিয়ে স্মৃতি থেকেই পুরো বক্তৃতাটা দিয়ে ফেললাম।
সেবার পাঁচটা বক্তৃতা ছিল। শেষদিন মায়েস্ত্রো কাসাস সভাপতিত্ব করলেন। সভাপতির উপসংহারমূলক বক্তৃতায় বললেন, এই বক্তৃতাগুলোয় নয়াবিশ্বের ইতিহাসের একটি নতুন ব্যাখ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের সামনে হাজির করা হয়েছে, যার নিবিড় বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। বিজ্ঞ অতিথি ইতিহাসের স্বাধীন বিশ্লেষণের মাধ্যমে কিছু সাহসী ও চিন্তা উদ্রেককারী সিদ্ধান্ত টেনেছেন। তাঁর এই বিশ্লেষণ যদি ঠিক হয়ে থাকে, যে ব্যক্তিই একে সঠিক বলে ঘোষণা করুক না কেন, তাকে সেটি করতে হবে এ বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতনতার সঙ্গে এবং দায়িত্ব নিয়ে। লাতিন আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম যাঁদের হাত ধরে এসেছে তাঁরা সকলেই মহান ব্যক্তিত্ব। তাঁদের স্মৃতি যথাযথ সম্মানের সঙ্গে ধারণ করতে হবে। কিন্তু একইসঙ্গে সমসাময়িক বিশ্বে সেই মুক্তিসংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হলে চাই নতুন পথনির্দেশনা।
মায়েস্ত্রোর বক্তব্যে যে ইঙ্গিত এখানে বেরিয়ে এসেছে তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হলো আমার। কোনো একাডেমিক চেয়ারে বসে এর চেয়ে সুষ্পষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে তাঁর ইঙ্গিত এত পরিষ্কার যে ভুল হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। দেশের বুদ্ধিজীবীকুলশিরোমণি এক সামাজিক বিপ্লবের সংকেত বাজিয়ে দিলেন।
এই দেশের সমাজবিপ্লবের আন্দোলনের শুভারম্ভে আমিও কিছু অবদান রাখতে চলেছি ভেবে তৃপ্তিতে মনটা ভরে যাচ্ছিল, যদিও আসলে ওটা ছিল কিছুটা দিবাস্বপ্নের মতো। আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দদায়ক মুহূর্তের একটি ছিল এই সময়টা। একটা নতুন অধ্যায় শুরুর সংকেতবাহী।
চলবে