আমাদের বন্ধু সেলিম তার নিজস্ব দর্শন অনুযায়ী চলতো। আর আমরা আমাদের মত চলতাম।
Published : 29 May 2017, 01:14 PM
আমরা মাঝে মাঝে একটু বিয়ার পান করতাম, তবে তখনও বিয়ার তেতো লাগতো। সেলিম ধুমপান করতো না, রশিদ করতো। আর আমি তখনও ধুমপান করা শিখিনি। এভাবে আমাদের তিনজনের মধ্যে তখন ছিল একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ।
ফ্রাঙ্কফুর্টের দিনগুলোতে সেলিম পরিস্থিতির কারণে নামাজ পড়তে পারেনি। তবে নতুন বাসায় এসে সে আবার নামাজ পড়া শুরু করলো। রশিদকে আমি তখন কোনো সময় নামাজ পড়তে দেখিনি, আর আমি তো কখনও নামাজ পড়াই শিখিনি।
মা-বাবা দু’জনই ছিলেন ধার্মিক মানুষ। মা প্রায়ই আমাকে বলতেন, আরবি আমপারা, সূরা শিখতে। তবে বাবা মানা করতেন। বাবা ছিলেন পরিবারের প্রধান শাসনকর্তা। তিনি মাকে বলতেন, আমার ওপর এ বিষয়ে যেন কোন চাপ প্রয়োগ করা না হয়, বড় হলে ও নিজে থেকেই এসব করবে।
আমি যখন বাবার কথা ভাবি, তখন দেখি যে বিংশ শতাব্দির প্রথম দিকের মানুষ হয়েও তিনি ওই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক আচরণ আমার সাথে করেছেন। যার কারণে হয়তো জন্মের পর থেকেই আমার কোমল মস্তিষ্কে কোন নির্ধারিত মতবাদ ঢুকতে পারেনি, এদিক থেকে আমি আমার বাবার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ।
ধর্ম চর্চার অধিকার পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশেই আছে। এই গণতান্ত্রিক বোধ কোন ব্যক্তি, পরিবার বা সমাজে একসাথে থাকার জন্য খুবই জরুরী। যদি থাকে, তাহলে আপেক্ষিকভাবে ভাল থাকা যায়। আমাদের তিনজনের মধ্যে তখন এ রকমই সম্পর্ক ছিল।
বলা হয়নি, ইতোমধ্যে আমার দুই বন্ধু রাজনৈতিক আশ্রয়ের কাগজ জমা দিয়ে ৬ মাস করে ভিসাও পেয়েছে। আর এর সাথে থাকা আর খাওয়ার জন্য ৪৬০ মার্ক করেও পেয়েছে। এর মানে, ওরা এই পরিমাণ মার্ক কাজ না হওয়া পর্যন্ত পেতে থাকবে।
এই অর্থপ্রাপ্তিকে আমরা তখন নিজেদের ভাষায় ‘চালান উঠা’ বলতাম। মানে জার্মানিতে যে পুঁজি বিনিয়োগ করে আসতে হয়েছে, তার কিছুটা ওদের উঠেছে। এই টাকাটা তখন দিত সামাজিক নিরাপত্তার অফিস থেকে, যাকে জার্মান ভাষায় বলা হয় ‘সোজিয়ালাম্ট’। রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আসা বিদেশিরা খুব তাড়াতাড়ি এই শব্দটি শিখে ফেলে। তবে অধিকাংশরাই উচ্চারণের সময় বলতেন ‘সোসাইলাম’।
ওদের ওই ৬ মাসের ভিসার সাথে ছিল কাজের অনুমতিও। সেই কারণে কারও ভিসা আর কাজের অনুমতি পাওয়ার সাথে সাথে পরিচিত অন্যরা কাজ খোঁজার জন্য তাদের শিখিয়ে দিতে্ন একটি বাক্য- জার্মান ভাষায়- ‘হাবেন সি আরবেইত?’ মানে- আপনার কাছে কি কাজ হবে? আর সাথে শিখতে হতো ‘যা’এবং ‘নেইন’, জার্মান ভাষায় এই দুটো শব্দ হচ্ছে ‘হ্যা’ এবং ‘না’।
যদি কোন রেস্টুরেন্টে বা গোডাউন বা কারখানায় অথবা অন্য যে কোন কাজে, যেখানে ভাষা ছাড়া শুধু শারীরিক পরিশ্রমের কাজের জন্য মানুষের প্রয়োজন হত তাহলে ‘ইয়া’ বলে। মালিকরা কাজ করাতেন, তবে এই কাজ করার সময় কীভাবে কাজ বুঝিয়ে দিতেন সেটা আমার সরাসরি অভিজ্ঞতা না থাকলেও শুনেছি যে অঙ্গ সঞ্চালন করে করানো হত।
এদিকে আমাদের একটি যৌথভাবে কেনা মাসিক টিকেট আছে। সুতরাং আমরা একেক দিন একেকজন প্রয়োজন মত ফ্রাঙ্কফুর্টে যাতায়াত করতাম। এই টিকেট ব্যবহারের দিক থেকে রশিদ সবচেয়ে বেশি আর আমি সবচেয়ে কম ব্যবহার করতাম। মাঝে ছিল সেলিম।
আমার তখনকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি হলো, যেহেতু আমি স্টুডেন্ট ভিসা নিয়েছি, সুতরাং আমার কোন জায়গা থেকে টাকা পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। শীতকালে তাই পত্রিকা বিক্রির চেষ্টা করারও সাহস করতে পারছি না।
দেশ থেকে নিয়ে আসা টাকা খুব সতর্কতার সাথে খরচ করে দিন কাটাচ্ছি। আর এভাবে কেটে যাচ্ছিল আমাদের জার্মানির জীবনে প্রথম দিকের দিনগুলো।
চলবে ...
লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি
এই লেখকের আরও পড়ুন-
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |