জার্মানিতে ৪০ বছর:  ভুলে ‘রেড লাইট’ এলাকায় বাসা

আমরা নিজেদের জন্য একে-ওকে জিজ্ঞেস করে ঘরের খোঁজ করছি। দু’দিনের মধ্যে খবর পেলাম, ফ্রাঙ্কফুর্ট মেইন স্টেশনের কাছেই টাউনুস স্ট্রিটে ঘর পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Feb 2017, 06:21 AM
Updated : 7 Feb 2017, 06:21 AM

সেখানে পাকিস্তানী একজন হাউস কেয়ার-টেকার আছে, নাম তার খান। তার কাছে যেতে হবে। আমরা তখন তিনজনই ফরহাদের ওপর এতো চাপ দেখে বিব্রত বোধ করছিলাম। তাই আমাদের ঘর খোঁজার তাগিদ বেশি ছিল।

যতদূর মনে পড়ে ফরহাদ কাজে ছিল, তাই আমরা একজন বাঙ্গালীকে নিয়ে ওই বাসার ঠিকানায় চলে গেলাম। খানের সাথে দেখা হল। ওটা ছিল একটা পাঁচতলা বাড়ি। বোধহয় সেই বাড়ির চারতলায় ছিল ঘরটি।

তখন অর্ধেক মাসেরও বেশি দিন পেরিয়ে গেছে, তাই ভাঙ্গা মাসের জন্য ভাড়া দিতে হলো ২৫০ মার্ক। আমরা হিসেব করে দেখলাম, এই মার্ক আমাদের দিতে অসুবিধা হবে না। তাই আমরা দেরি না করে মার্ক খানকে দিয়ে ঘরটিকে কনফার্ম করলাম।

ওই ঘরে ছিল একটি ডাবল খাট, তার সাথে জাজিম আর বালিশ। কিন্তু দেখে মনে হল, কত মানুষ যে এই খাটে থেকে গেছে- তার হিসেব নেই। তখন আমাদের পরিষ্কার-অপরিষ্কারের বোধটা মনে হয় কাজ করছিল না। তাই সেই চিন্তা সরিয়ে খুশি হওয়ার চেষ্টা করলাম এই ভেবে যে, অন্তত অল্প সময়ে আমাদের একটা নিজেদের ঠাঁই হলো।

ঘর ঠিক করে আমরা আমাদের পুরনো আস্তানা, মানে ফরহাদের ঘরে ফিরে আসলাম। সন্ধ্যার দিকে ফরহাদ কাজ থেকে ফিরে এলে ওকে ঘর পাওয়ার সংবাদটি দিলাম। ও জিজ্ঞেস করলো কোথায়?

আমরা রাস্তার নাম ও খানের কথা বললাম। ভেবেছিলাম শুনে সে বোধহয় খুব খুশি হবে। মনে করবে, যাক বাবা, এবার আর এক রুমে পাঁচজন থাকতে হবে না।

কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে দেখি ওর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল! শুধু বলল, আমাকে তো জানিয়ে নিতে পারতে?

পরে বলল, ওখানে তো খাবার ব্যবস্থা করতে সময় লাগবে তোমাদের। তাই আমার এখান থেকেই তোমরা এসে খেয়ে যেও। রাতে খাবার খেয়ে সেলিম আর আমি সেই ঘরের দিকে এগোলাম।

বাসাটা ফরহাদের বাসা থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না। এক কিলোমিটারের মত হাঁটা পথ। ফ্রাঙ্কফুর্টের মেইন স্টেশনের বিপরীত দিকে একটি রাস্তায়। মেইন স্টেশনের কাছাকাছি হওয়ায় বাসাটা মনে রাখা সহজ ছিল।

ওদিকে রশিদ কার সাথে যেন বেরিয়েছিল। তাই সেলিম আর আমি দু’জন এই নতুন শহরে স্থানীয় কোন গাইড ছাড়া প্রথম বের হলাম।

১৯৭৭ সালের অক্টোবরের সেই সময়টায় ঠাণ্ডার প্রকোপ তেমন ছিল না। তবুও সেলিম বাংলাদেশ থেকে যে শীতের কাপড় নিয়ে এসছিল, সেগুলো পরে নিল। আর আমি সেই দশ টাকার ওভারকোট গায়ে চাপালাম। এখন যখন ওই সময়ের পোশাকের কথা ভাবি, তখন নিজের কাছেই হাসি পায়। কী কিম্ভুতকিমাকার পোশাক পরেই না আমরা জার্মানিতে চলাফেরা শুরু করেছি!

যাহোক, ওই পোশাক যে কতোটুকু বেমানান ছিল, সেটা টের পেলাম কিছুক্ষণ পরেই। যখন আমরা মেইন স্টেশনের একেবারে বিপরীত দিকে রাস্তায় গিয়ে পৌঁছালাম, তখন দেখি একটি মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে আছে আর তার গায়ে বড় বড় করে লেখা আছে ‘Polizei’, মানে ‘পুলিশ’।

গাড়িটির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভেতরে বসা একজন আমদের শিস দিয়ে ডাকলেন আর বললেন, পাসপোর্ট, পাসপোর্ট?

আমাদের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে উনি আমাদের পাসপোর্ট চেক করবেন। দেখতে চাইছেন, আমরা বেআইনীভাবে জার্মানিতে ঢুকেছি নাকি।

আমরা আমাদের পাসপোর্ট এগিয়ে দিলাম। সে দেখল আর জিজ্ঞেস করলো, “আপনারা কতদিন জার্মানিতে থাকবেন?”

আমি সাথে সাথে উত্তর দিলাম, “যতদিন টাকা আছে ততদিন।”

কথাবার্তা ইংরেজিতেই চলছিল, সেই পুলিশ অফিসারও ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজি দিয়ে কথা বলছিল আর আমিও ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে উত্তর দিচ্ছিলাম। পুলিশ অফিসার আর বেশি কথা বলেন নাই। ‘ওকে’ বলে আমাদের পাসপোর্ট দু’টো ফেরত দিলেন।

পরে আমার মনে হয়েছিল- এই দুই পুলিশ আমাদের বেশভূষা দেখে নির্ঘাত ভেবেছিল, এরা বেআইনীভাবে জার্মানিতে ঢুকেছে। স্টেশনের বিপরীতে এই রাস্তার নাম ‘কাইসার স্ট্রিট’। সেই রাস্তা দিয়ে একটু এগিয়ে গেলে পড়বে ‘টাউনুস স্ট্রিট’।

তখন বোধহয় রাত ১০টার বেশি বাজে, রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা। লক্ষ্য করলাম, কয়েকটি পুলিশের গাড়ি চলাচল করছে আর একটি অ্যাম্বুলেন্সকে সাইরেন বাজিয়ে চলে যাচ্ছে। দিনের বেলায় যখন এসেছিলাম, তখন সব স্বাভাবিকই মনে হয়েছে। কিন্তু রাতে দেখি সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ।

টাউনুস স্ট্রিটের বা’দিকে ছিল আমাদের ঘর, তাই সামনে গিয়ে কাইসার স্ট্রিটের বাম দিকে হাঁটা শুরু করলাম। যত ভেতরের দিকে হাঁটছি, রাস্তার দু’পাশে চোখে পড়ছে বার আর নাইট ক্লাব। জার্মানিতে অনেক জায়গায় বার থাকবে সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু সবখানে নাইট ক্লাব নাই।

এরপর চোখে পড়লো ‘ইরোস’ নামে আলোকসজ্জিত বিল্ডিং। এসব কোন কোন বিল্ডিং-এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে মহিলারা, কারও সাথে আবার বড় কুকুর। এবার বুঝতে আর বাকি রইল না আমরা কোন জায়গায় ঘর নিয়েছি! আর এত সহজেই কেন ঘর পেলাম, আর কেনই বা এই জায়গায় ঘর পাওয়ার কথা শুনে ফরহাদ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল।

এই ‘রেড লাইট’ এলাকায় আমার সবচেয়ে বেশি খারাপ লেগেছে কঠিন নেশার দ্রব্য সেবন ও ইঞ্জেকশন নেওয়া অসহায় মানুষদের দেখে। হাঁটা পথেই দেখতে পাচ্ছিলাম এইসব ছিন্নমূল মানুষদের। নেশায় একেবারে ঝিমিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছেন, হাঁটতে গিয়ে ঢুলে পড়ছেন। কারও আবার দেখলাম হাতে রক্তের দাগ। তার মানে ইঞ্জেকশন ঠিক মত পুশ করতে পারে নাই।

এসব দেখতে দেখতে আমাদের সদ্য নেওয়া ঘরে পৌঁছে গেলাম। উপর থেকে কিছুক্ষণ নিচে তাকিয়ে রাস্তার দৃশ্য দেখে নিলাম। ভাবছিলাম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই জায়গা ছাড়তে হবে।

চলবে ...

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক

এই লেখকের আরও পড়ুন-