জার্মানিতে ৪০ বছর: রঙিন জার্মানি উবে গেছে

পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের তিন বন্ধুর থাকার ব্যপারে পদক্ষেপ একই। আমরা যে বাড়িওয়ালার কাছ থেকে ঠিকানার ফর্ম নিশ্চিত করে সই করিয়ে নিয়েছি, সেটা এখানকার বিদেশিদের দায়িত্বের জন্য পুলিশ অফিসে জমা দিতে হবে।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Feb 2017, 07:54 AM
Updated : 3 March 2017, 11:10 AM

সে কারণে আমরা সকালেই একসঙ্গে হয়ে ফ্রাঙ্কফুর্টের মাইঞ্জার ল্যান্ড স্ট্রিটের ৩২১ নাম্বার থেকে ১১ নম্বর ট্রামে চড়ে চলে গেলাম। এবার আমরা নিজেরাই ট্রামের টিকেট মেশিনে মার্কের মুদ্রা ঢুকিয়ে কিনতে পারলাম। তখনকার ওই স্বয়ংক্রিয় মেশিনের উপরে দেখতে পেয়েছিলাম ‘ফাহরকারটে’, মানে ‘টিকেট’ লেখা।

প্রায় ২০ মিনিট যাত্রার পর বন্ধুদের নির্দেশিত স্টপেজে নেমে পড়লাম। বিশাল এই পুলিশ অফিসটি খুঁজে পেতে আমাদের অসুবিধা হলো না। ভেতরে গিয়ে দেখি অনেক বিদেশিদের সমাগম। তাই লাইনে দাঁড়াতে হলো। লক্ষ্য করলাম, এই দেশ হচ্ছে নিয়ম-শৃঙ্খলার দেশ। লাইন ভাঙ্গা বা স্বজনপ্রীতির কোন সুযোগ এখানে নাই।

বেশ কিছুক্ষণ পর আমাদের পালা এলো। অফিসার ফর্ম দেখে তার এক অংশ রেখে অপর অংশে সিল মেরে আমাদের যার যারটা ফেরত দিলেন। প্রথম অফিসিয়াল কাজ আমাদের শেষ হলো, এবার ওরা দু’জন থাকার বিষয়ে এক দিকে যাবে আর আমি ভিন্ন পথে।

আবার আস্তানায় ফিরে আসলাম। আমার আর তেমন কোন কাজ নেই, আর ওদের তখন অনেক কাজ। উকিলের কাছে গিয়ে কেস লেখাতে হবে, তারপর সেই কাগজ নিয়ে যে কোন একদিন খুব ভোরে পুলিশ অফিসে গিয়ে লাইন দিতে হবে। কারণ তখন দিনে দিনে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসছিলো।

১৯৭৭ সালে যেসব বাংলাদেশিরা জার্মানিতে এসে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন, তাদের বেশিরভাগ দেখাতেন যে তারা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ বা যুবলীগ করতেন। সেই কারণে বিএনপি সরকার তাদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন করেছে বা করছে। এর সাথে অনেকে আবার জাসদের মামলা দিতেন। হাতে গোণা কয়েকজনকে দেখেছি যে তারা সর্বহারা দলের কর্মী হিসেবে মামলা দিয়েছেন।

পরবর্তীতে দেখেছি, যখন আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় তখন অধিকাংশই আবার বিএনপি বা তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর মামলা দিচ্ছেন। এমনি চলেছে খেলা! তবে বাংলাদেশিদের মধ্যে দেখেছি ও শুনেছি, দুই-চারজনের মামলা ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করে এখানকার আদালত তাদেরকে জার্মানিতে স্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি দিয়েছে।

বেশিরভাগ আশ্রয় প্রার্থীরা অ্যাসাইলাম চাওয়ার পর এক বছর বা তারও চেয়ে বেশি সময় পর তাদের কেস নাকচ হয়েছে। কিন্তু তখন সুযোগ ছিল যে এই নাকচের বিরুদ্ধে তারা আপিল করতে পারতেন। সেটাও যখন নাকচ হয়ে যেত, তখনও মামলা বুঝে তারা বেশ কয়েকবার আপিলের সুযোগ পেতেন। তবে কয়েক বছর পর থেকে যখন আশ্রয় প্রার্থীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, তখন এই অবস্থারও পরিবর্তন শুরু হতে থাকে।

বাড়িতে যে পত্র লিখেছিলাম, সে পত্রের উত্তর তখনও এসে পৌঁছায় নাই। মাঝে অবশ্য বাবাকে লিখেছিলাম যে স্টুডেন্ট ভিসার জন্য যদি আমি চেষ্টা করি, তাহলে আমার স্পন্সরশিপের কাগজ লাগবে। সেখানে উল্লেখ থাকতে হবে, স্পন্সর আমাকে মাসে মাসে ৬০০ মার্ক পাঠাবেন।

এই কাগজ আসা পর্যন্ত তিনটি কাজ আমার করতে হবে। এখানকার কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা স্বীকৃত এডুকেশনাল ইন্সটিটিউট থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে আসতে হবে যে আমি ভাষা শিখে পরবর্তীতে ওইসব জায়গার কোন একটাতে পড়াশুনা করবো।

ফরহাদের ঘরে মোটামুটি প্রায় সন্ধ্যায়ই আড্ডা হত। তার মধ্যে আমরা তিনজন তো আছিই, মাঝে মাঝে নিচের তলা থেকে মঞ্জুর চলে আসতো। পাশের ঘরের করাচি থেকে আসা বাঙালি ছেলে ঈশরাতও আসতো। আরও দেখা হত, ঢাকায় মঞ্জুরদের একেবারে বিপরীত দিকের বাসার সোহরাবের সাথে। সে তখন স্লোসেন স্ট্রিটের ৪ নম্বর বাসা থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ দূরে ওর এক ভাতিজা ‘খানের’ সাথে থাকতো।

যেহেতু আমরা তিনজন লক্ষ্য নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছি, যার যার পথে অগ্রসরও হচ্ছি, তাই তখন থেকে অনুভব করতে শুরু করলাম যে মাথায় উত্তেজনার চাপ বেশ কমেছে। যে জার্মানিকে দেশ থেকে রঙিন মনে হত, সেই জার্মানিতে আসার পর থাকা, খাওয়া, নির্ভরশীল চলাফেরা মানে একা একা না চলতে পারা, ভাষা না বোঝা, ঠাণ্ডা- এসবের কারণে রঙিন জার্মানি যে কোথায়, কখন উবে গেছে, সেটা আঁচও করতে পারিনি। বিশেষ করে আমাদের বা আমার ওই বয়সে কল্পনা আর বাস্তবতায় যে কত পার্থক্য ছিল, সেটা জার্মানি এসেই প্রথম উপলব্ধি করতে পারলাম।

আমরা ঢাকা থেকে চারজন একসাথে ১৪ অক্টোবর ১৯৭৭ সালে ফ্রাঙ্কফুর্টে এসে পৌঁছেছিলাম। আমাদের মধ্যে চতুর্থ জন সেই নিলু যে নুরুর সাথে রয়ে গেল, ওর সাথে আর দেখা হচ্ছিল না। পরে শুনতে পেলাম, সে দেশে ফিরে যাবে এই সিদ্ধান্তেই অটল আছে। আর যাবেই বা না কেন, ও জার্মানির কঠিন বাস্তবতা প্রথম দিন থেকেই অনুধাবন করতে পেরেছিল। তার এখানে থেকে যে পোষাবে না, সেটা ও ঠিকই বুঝতে পেরেছিল।

নিলুরা কয়েক ভাই ছিল ঢাকা শহরের মফাজ্জল হোসেন মায়ার নেতৃত্বে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য। বেশি কিছু না বলে শুধু এটাই বলতে চাই, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তারা ছিল রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। তাই হয়ত নিলু জার্মানি এসে বলতো, আমার সম্পত্তি কে খায়, আমি কষ্ট করুম ক্যা?

আর একটা হাসির কথা নিলু বলতো, ওর নাকে নাকি ভিক্টোরিয়া পার্কের (বাহদুর শাহ পার্ক) কাছে অবস্থিত পুরনো কাপড়ের দোকানে রাখা শীতের কাপড়ের গন্ধ লাগে। হতে পারে, ঢাকার এই পুরনো কাপড়ের দোকানগুলোতে তো অনেক কাপড় শীতপ্রধান দেশ থেকেই আসতো, তাই এখানে যখন মানুষ ওই ধরনের কাপড় পরে, তখন সে রকম গন্ধ পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে আমাদের তিন জনের বা অন্যান্য কোন বাংলাদেশিদের মুখে শুনিনি যে তারা এই উক্তি করেছে।

আসলে নিলু এখানে থাকতে চায়নি, তাই তার স্বপক্ষে নানান যুক্তি দাঁড় করাতো। হ্যা, সত্যি ও মাসখানেক পর দেশে চলে গিয়েছিল।

চলবে ...

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash.bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!