বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে আসাতে মনটা ফুরফুরে ছিল। ওই মুহূর্তে খেয়াল ছিল না যে, সামনে দীর্ঘ পথ পড়ে আছে। সে পথ অনেক বন্ধুর।
Published : 20 Mar 2017, 01:17 PM
এখন আমার পরবর্তী কাজ হলো- ভাষা ইস্কুলের খোঁজ করা। কোথায় অল্প খরচে ভাষা শেখা যায়? ফ্রাঙ্কফুর্টে সে সময়ও বেশ কিছু ভাষা শেখানোর স্কুল ছিল। যেমন ছিল বাকশুলে, ইলনিনগুয়া, ফক্সহোকশুলে। এদের টিউশন ফিরও বেশ পার্থক্য ছিল।
বাকশুলে দিনের ইনটেনসিভ কোর্সের জন্য মাসিক ফি ছিল ২৬০ মার্ক, আর ইলনিনগুয়ারও ছিল বাকশুলের কাছাকাছি। ফক্সহোকশুলে ইনটেনসিভ কোর্সের জন্য তখন ৬ মাসের ফি ছিল ৪০০ মার্ক। ইনটেনসিভ কোর্স বলা হতো কারণ এই কোর্সগুলোতে সপ্তাহে প্রায় ১৮ ঘণ্টা ক্লাস হত এবং অন্যান্য সন্ধ্যার কোর্সগুলোর থেকে এই কোর্সে ভাষার একটু গভীরের জিনিস শেখানোর চেষ্টা করা হত। তারপরও ফক্সহোকশুলে সাধারণত তারাই আসতেন, যারা মোটামুটি কথা বলার জন্য ভাষা শিখতে চাইতেন।
আমি তখনকার সব দিকের পরিস্থিতি মিলিয়ে দেখলাম যে বেশি বেতনের স্কুলে ভর্তি হওয়ার আমার কোন সুযোগ নেই। কারণ সব খরচ আমাকেই বহন করতে হবে আর কবে থেকে একটু-আধটু উপার্জন করতে পারবো, সেটা তখনও অনিশ্চিত।
বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারলাম, এই স্কুল সেন্ট্রাল স্টেশনের বিপরীতে, বার্গার কিং-এর উপরে। এটা জেনে খুশি হলাম, কারণ ওই জায়গা দিয়ে ইতোমধ্যে আমরা বেশ কয়েকবার আসা-যাওয়া করেছি। সুতরাং আর কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে না।
তারপরের দিন গেলাম একটি ‘ক্রানকেনকাস’-এ, মানে স্বাস্থ্যবীমা করাতে। যেহেতু এই ইনস্যুরেন্স কোম্পানির সাথে আমি অনেক বছর জড়িত ছিলাম, তাই সেই কোম্পানির নাম আজও মনে আছে। ওই ইনস্যুরেন্স কোম্পানির নাম ছিল ‘বারমার ক্রানকেনকাস’। তখন ছাত্রদের জন্য মাসে দিতে হত ৩০ মার্ক। সেখানে স্বাস্থ্যবীমা করিয়ে ‘বেসশাইনিগং’, মানে সার্টিফিকেট নিয়ে আসলাম। এদিকে আমার গাঁটের টাকা থেকে ইতোমধ্যে ৩০০ ডলার ভাঙ্গানো হয়ে গেছে। বাকি আছে ৩৫০ ডলার। সামনে দীর্ঘ শীতকাল, তার মানে আমার অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করলে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক!
ফ্রাঙ্কফুর্টে আসার পর থেকে থাকার ব্যাপারে বেশ ভালভাবেই এগোচ্ছিলাম। অন্যদিকে রশিদ আর সেলিম এরই মধ্যে উকিলের কাছে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য কাগজ করিয়ে নিয়েছে। আসার পর পরই ফরহাদ আমাদের জানিয়েছিল যে তার বাড়ির মালিকের আরও একটা বাড়ি আছে। তবে সেটা ফ্রাঙ্কফুর্ট শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ওফেনবাখ নামে একটি ছোট শহরে।
প্রথম অবস্থায় আমরা এ বাসার কথা নিয়ে ভাবতে পারিনি, কারণ আমরা নিশ্চিত ছিলাম না যে এখানে থাকতে পারবো কি না বা থাকবো কি না? ফ্ল্যাটটার কথা ফরহাদ কয়েকবার বলার পর আমরা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিলাম।
ফরহাদ জানাল, সেই ফ্ল্যাটটায় চারটা রুম, আলাদা রান্নাঘর আর ফ্ল্যাটের ভেতরেই টয়লেট ও গোসল করার জায়গা আছে। ভাড়া ৬৫০ মার্ক। যদি আমরা যেতে চাই, তাহলে ১ নভেম্বর ১৯৭৭ থেকে সেখানে উঠতে পারি। আমাদের তখন ঘর দরকার, তার মধ্যে প্রস্তাব পেলাম একটা ফ্লাটের।
হিসেব করে দেখলাম, যদি আমরা চারজন থাকি, তাহলে এই ভাড়া চালাতে পারবো। তাই আমরা রাজি হয়ে গেলাম। ভাবলাম, আমাদের যদি ওই ফ্ল্যাটটি হয় তাহলে একটা সমস্যার অন্তত স্থায়ী সমাধান হবে। হোক না সেটা ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে দশ কিলোমিটার দূরে। আমাদের কাছে তখন ফ্রাঙ্কফুর্ট বা ওফেনবাখ সবই প্রায় এক। কারণ আমরা তখন এই দুই শহরের কোন শহরই চিনি না।
আমি তখন মোটামুটি বিশ্রামের মধ্যেই ছিলাম। তাই একদিন রুমমেট নিজামের সাথে ‘ফ্রাঙ্কফিউটার রুন্ডশাও’ পত্রিকা বিক্রির জন্য আমাদের মত ইচ্ছুক বিক্রেতাদের যেখানে পত্রিকা বিতরণ করা হয়, সেই অফিসের দিকে গেলাম। গিয়ে দেখি বেশ লোকজনের সমাগম, ওখানে গিয়ে দেখা হলো আমাদের সাথে বুয়েটে একই শাখায় পড়া বন্ধু প্রদীপের সাথে। সেদিনই পরিচত হলাম বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে পাশ করা ফারুক ভাই আর রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা ফিরোজ ভাইয়ের সাথে। তারা দু’জনই ছিলেন আমাদের থেকে দুই বছর সিনিয়ার।
বিতরণ কেন্দ্রের প্রথম ঘরটি ছিল বেশ বড়। সেই ঘরের পেছন দিকটায় ডান পাশের কোণায় ছিল একটি কাউন্টার, সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতেন ইয়ান নামে একজন জার্মান ভদ্রলোক। তিনি ছিলেন সেই বিক্রয় কেন্দ্রের প্রধান। বাকি ডান পাশের দিকে ছিল লম্বা টেবিলের মত উঁচু আসবাব। সেখান থেকে ইয়ানের সহকারী রহিম নামে একজন পাকিস্তানি ইয়ানের কাছ থেকে লেখা স্লিপের সংখ্যা অনুযায়ী পত্রিকা বিক্রেতাদের দিতেন।
সেদিন অবশ্য নিজাম বিক্রির জন্য পত্রিকা পেল। আমরা পত্রিকাগুলো ট্রলিতে করে নিয়ে ইয়ানের নির্দেশিত জায়গায় চলে গেলাম। নিজাম আমাকে সেই জায়গায় গিয়ে বলল, আমি ইচ্ছে করলে বিক্রি করতে পারি। নতুন অভিজ্ঞতা নেওয়ার ইচ্ছে ছিল, তাই আমরা একটি ট্রাফিক সিগনালের গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখানে স্বাভাবিকভাবেই লাল লাইট জ্বললে গাড়ি থেমে যাচ্ছিলো। আমরা রাস্তার দুই পাশে দু’জন দাঁড়িয়ে যখনই গাড়ি সিগনাল অনুযায়ী থামছিল, তখনই পত্রিকা উঁচু করে হাতে ধরে গাড়িগুলোর সামনে দিয়ে হাঁটছিলাম। ঠিক যেমন আমাদের দেশে যেভাবে ফেরিওয়ালারা তাদের পণ্য বিক্রি করেন। দুই- একজন আমাদের কাছ থেকে কিনছিলেনও, তবে সেদিন খুব কমই বিক্রি হয়েছিল।
পত্রিকা বিক্রির একটা সুবিধা ছিল, বিক্রির প্রথম ২০টা পত্রিকা ফ্রি ছিল। তার মানে এই ২০টি পত্রিকা বিক্রির টাকা বিক্রেতারা পেতেন (একটা পত্রিকার দাম ছিল ৪০ পেনি)। এরপরে বিক্রি হলে অফিসকে তার একটা অংশ দিতে হত। কিন্তু নতুনদের জন্য, যারা জায়গা ভাল পেতেন না, তাদের জন্য এই ফ্রি পত্রিকাগুলো সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিক্রি করা কঠিন হয়ে যেত।
নিজাম আর আমি বিক্রি শেষে ট্রলি ফেরত দিতে সেই অফিসে গেলাম। যতদূর মনে পড়ে, সেদিন আমরা দুজন ২৩-২৪টা পত্রিকা বিক্রি করতে পেরেছিলাম। তবে এটা ঠিক মনে আছে যে নিজাম আমাকে ৫ মার্কের একটা চকচকে মুদ্রা দিয়েছিল।
ধরা যেতে পারে, জার্মানিতে আমার পরিশ্রমের এটাই ছিল প্রথম উপার্জন।
চলবে ...
লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি
ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক
এই লেখকের আরও পড়ুন-
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash.bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |