জার্মানিতে ৪০ বছর: ‘লাল বই’ মানে বিপদজনক বই

মিলিটারি জ্যাকেট আর কর্ডের প্যান্ট কেনা হলো, এবার এগুলো পরে আমার প্রয়োজনীয় কাজ করতে হবে। পরিকল্পনা করলাম- যেহেতু আমার তাড়াহুড়া নাই, সেহেতু প্রতিদিন একটা একটা করে কাজ করবো।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 March 2017, 09:21 AM
Updated : 12 March 2017, 09:21 AM

প্রথমে ঠিক করলাম যে ফ্রাঙ্কফুর্ট ইউনিভার্সিটিতে যাব। কারণ ওখান থেকে আমার সার্টিফিকেট আনতে হবে যে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আমার যোগ্যতা আছে। পরের দিন সকালের দিকে আমি নতুন পোশাক পরে একাই বেরিয়ে পড়লাম। বেড়িয়ে নতুন কাপড় আর রাস্তা ইতোমধ্যে কিছুটা পরিচিত হওয়ার কারণে বেশ স্বচ্ছন্দ অনুভব করছিলাম। মনে হল একলা চলার জন্য একটু আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।

আবার সেই মেশিন থেকে ট্রামের টিকেট কাটতে হল। বন্ধুদের কাছ থেকে আগেই ইউনিভার্সিটির অবস্থান আর দিক-নির্দেশনা নিয়ে নিয়েছিলাম। গত কয়েকদিন আমরা বেশিরভাগ সময় সেন্ট্রাল স্টেশনের ডান দিকটা, মানে আমাদের ঘরের দিকে বা একদিন ‘ছায়েলের’ দিকে হাঁটাহাঁটি করেছি। শুধু একদিন গিয়েছিলাম সেন্ট্রাল স্টেশনের বাম দিকে ‘মাইঞ্জার ল্যান্ড স্ট্রিট’-এর পুলিশ অফিসে। আর এবার যেতে হবে ইউনিভার্সিটিতে।

ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে কোন পাতাল ট্রেন ছিল না, তবে কাছাকাছিই ট্রামের স্টপেজ ছিল। সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে ট্রামে উঠে প্রায় ১৫ মিনিটের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকার স্টপেজে নেমে পড়ি। এই এলাকায় যেহেতু আমি সম্পূর্ণ নতুন, তাই এবার আমাকে জিজ্ঞেস করে করে যেতে হবে সেই নির্দিষ্ট অফিসে।

ইউনিভার্সিটি এলাকার সুবিধা হলো যে, এখানে সাধারণ কথাবার্তার জন্য প্রয়োজনীয় ইংরেজি প্রায় সবাই জানে। একে ওকে জিজ্ঞেস করে আমার গন্তব্য স্থানের দিকে এগোচ্ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে গিয়ে চোখে পড়ল, পুরনো দালানের গেটে বড় বড় হরফে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম লেখা। ‘জোয়ান উলফগ্যাং গোয়েথে ইউনিভার্সিটি’, জার্মান ভাষায় ইউনিভার্সিটিকে ‘ইউনিভার্সিতাদ’ বলা হয়।

গোয়েথে নাম শুনলেই বাবার কথা মনে পড়ে যায়। ১৯৬৯ সালে গণ-আন্দোলনের সময় আমি স্কুল ছাত্র। জানুয়ারির ২০ তারিখে আসাদ ভাই গুলি খেয়ে নিহত হন, পরের দিন আমরা তিন বন্ধু রশিদ, হেলাল আর আমি স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাই, মিটিং শুনি। তারপর থেকে আমরা হয়ে উঠি ১১ দফা আন্দোলনের ক্ষুদে সেনা।

তখন আমাদের রাজনীতি বা কোন দলের সাথে সংশ্লিষ্টতা ছিল না, তবে মাঝে মাঝে মেজো ভাইয়ের কাছ থেকে বাম রাজনীতির কথা শুনতাম। তিনি ছিলেন বুয়েটের ছাত্র এবং ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের সক্রিয় সদস্য। মেজো ভাইয়ের জন্য বাসায় আসতে থাকে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন, মাও সেতুং-এর বই। রাস্তায় রাজনীতির জন্য নামার আগে বাসায় এসব বই দেখেছি, তবে পড়ার তেমন আগ্রহ অনুভব করিনি। কিন্তু রাস্তায় নেমে বুঝলাম, রাজনীতির জন্য যখন রাস্তায় নেমেছি তখন পড়াশুনা দরকার। এটা বুঝতে পেরেছিলাম যে পড়াশুনা ছাড়া রাজনীতি হয় না।

এদিকে আমার সবচেয়ে বড় ভাই বাবার কাছে অভিযোগ করে জানালেন যে খোকন আর শান্তি (খোকন আমার মেজো ভাইয়ের নাম) ‘লাল বই’, মানে বিপদজনক বই পড়ে। বাবা ছিলেন আইনজীবী, ১৯২৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল’ পাশ করে ঢাকায় আইন ব্যবসা শুরু করেন। বড় ভাইয়ের অভিযোগ শুনে বাবা ধীরে ধীরে আমাদের বললেন, “তোরা এসব পড়, তবে তার সাথে শেক্সপিয়ার, চার্লস ডিকেন, জর্জ ইলিওট, শেলি, গেট্যের বইও পড়িস।”

ইংরেজিতে গোয়েথেকে, গেট্যে বলা হয়। বাবা গেট্যের উপর বেশ জোর দিয়েছিলেন। বাবার কাছ থেকে যখন গোয়েথের নাম শুনেছিলাম, তখন বিশ্বের অন্যান্য প্রখ্যাত লেখক-কবিদের সাথে গোয়েথের নাম আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল। সেদিন যখন ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে গোয়েথের নাম দেখলাম, তখন আবার বাবার কথা খুব মনে পড়ল। ভাবলাম, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে ভর্তি হতেই হবে।

প্রায় ৪০ বছর আগের কথা আজ যখন মনে করি, তখন মনে হয়- আমার মনে তখন কতোই না ফ্যান্টাসি ছিল। এসেছি মাত্র আট দিন হলো। থাকার বাসা নেই, শীতের কাপড় নেই, রাস্তাঘাট চিনি না, আয় নেই। আর ভাষাও তখন বার্লিনের দেয়ালের মত আমার সামনে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে আর আমি কিনা গোয়েথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার স্বপ্ন দেখছি?
একটু খোঁজার পর, বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের দায়িত্বে যে অফিস, সেই কক্ষ খুঁজে পেলাম। সেখানে ঢুকে বললাম, আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ছাত্র হতে চাই। তাই সেই যোগ্যতা আমার আছে কিনা তার উপর সার্টিফিকেট চাই। যার কাছে গিয়ে বললাম, তিনি আমার দেশের সার্টিফিকেট দেখতে চাইলেন। আমি আমার সব সার্টিফিকেট ভদ্রলোককে এগিয়ে দিলাম।

তিনি হাতে নিয়ে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করলেন আমার বুয়েটের প্রবেশনাল সার্টিফিকেটটি। তারপর ছোট একটি ছাপা কাগজে পাসপোর্ট অনুযায়ী আমার নাম ও জন্ম তারিখ লিখে বিশ্ববিদ্যালয়য়ের গোল সিল মেরে দিলেন। কাজটি করাতে সময় লেগেছিল মিনিট ১৫। এই সার্টিফিকেটটি হয়ে গেল জার্মানিতে আমার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাগজ।
চলবে ...

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash.bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!