জার্মানিতে ৪০ বছর: যে বাসায় ৩৪ বছর

ভিসার ঝামেলা আপাতত গেল, এবার বাসার সমস্যার সমাধান করতে হবে।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 April 2017, 04:56 AM
Updated : 19 April 2017, 04:56 AM

জার্মানিতে আসার পর পরই ফরহাদ বলেছিল, ওর বাড়িওয়ালার ওফেনবাখ শহরে চার রুমের একটি বাড়িতে ও যেতে পারে। তাই ফরাহাদ ওখানে যাওয়ার পর ঠিক করেছিল যে, ফরহাদসহ আমরা চারজন ওখানে থাকব।

বাসাটা আসলে নিশ্চিত ছিল, কিন্তু ফ্রাঙ্কফুর্টে যাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে যখন আমাদের রাত্রি যাপনের জন্য এদিক-ওদিক পর পর তিনটি ঘরে থাকতে হলো, তখন বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আমরা শুধু একটা ঘর না, তার চেয়ে অনেক বেশি একটি ফ্ল্যাট পেতে যাচ্ছি।

ওফেনবাখে যাওয়ার কয়েকদিন আগে ফরহাদ জানাল, সে এখন যাবে না। তবে কিছুদিন পর সে আমাদের সাথে যোগ দেবে। ভাল কথা, কিন্তু আমাদের তো যেতেই হবে।

১ নভেম্বর, বাড়িওয়ালা এরনেস্ট লের্প আমাদের তিনজনকে তার গাড়িতে নিয়ে ওফেনবাখের উদ্দেশ্য রওনা হলেন। তার গাড়িতে চড়া হলো আমাদের জার্মানির জীবনে প্রথম কোন প্রাইভেট গাড়িতে চড়া। আমাদের সহায়-সম্বল ছিল- প্রত্যেকের কাছে একটি ছোট ব্যাগ।

আমার লাল রঙের ব্যাগটির ইতিহাস বলি। আমার সেজো বোন আমেরিকাতে ডক্টোরেট শেষ করে ১৯৬৮ সালে ফেরার সময় এই ব্যাগটি দেশে নিয়ে এসেছিলেন। আর সেই ব্যাগটি নিয়ে আমি এসেছি এই জার্মানিতে।

বাড়িওয়ালা মনে হয় খুব খুশি মনেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। তাই তার ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে কথা ও আমাদেরকে সেই ‘মিস্টার কিরি কিরি’ বলাতে আমরাও খুশি ছিলাম। আসলে আমাদের প্রধান খুশির কারণ ছিল, আমরা তিনজন একটি ফ্ল্যাট পেতে যাচ্ছি।

মিনিট ২০ পর আমরা সেই নির্দিষ্ট বাড়ি ‘লুডউইগস্টার ১৬৫’-এর সামনে পৌঁছালাম। ফ্ল্যাটটি ছিল বাড়ির সামনের অংশের বিল্ডিং-এর তিন তলায়। তিন তলায় উঠে বাড়িওয়ালা দরজা খুললেন। এবার আমরা চারজন ঢুকলাম। ফ্ল্যাটে ঢুকেই আমার কাছে অনেক বড় মনে হলো ফ্ল্যাটটা। কারণ এই ক’দিন তো আমরা এক রুমে কখনও তিনজন, কখনও বা পাঁচজন থেকেছি। তাও সেখানে ঘরের ভেতরেই রান্না করতে হতো। আর এখানে চারটা রুম, আলাদা রান্নাঘর, ফ্ল্যাটের ভেতরই টয়লেট এবং গোসল করার জায়গা। ভাবলাম, আর কী চাই?

রুমগুলো দুটো দুটো করে আলাদা ছিল। তার মানে করিডোরের দুই পাশে জোড়া দুই-দুই করে রুমগুলোর পেছনের কামরাগুলোতে যেতে হলে এক একটি কক্ষের ভেতর দিয়ে যেতে হত। ভাল হতো যদি চারটি রুমেই পৃথক ঢোকার দরজা থাকতো। কী আর করা, আমরা ঘরের বদলে ফ্ল্যাট পেয়েছি- এটাই তখন বড় কথা।

আরও সমস্যা ছিল, এই বাড়িতে সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেম ছিল না। তাই ঘরে ঘরে রাখতে হতো ছোট ছোট ইলেকট্রিক হিটার। তবে গরম পানির ব্যবস্থা ছিল। ড্রয়িং রুমের মত একটি বড় রুমে ঢুকে দেখলাম, মেঝেতে কার্পেট বিছানো। পরে দেখলাম, অন্যান্য ঘরেও কার্পেট ছিল আর ড্রয়িং রুমে বাড়িওয়ালা দিয়ে রেখেছেন একটা বড় আর একটা ছোট সোফা, একটা সাদা রঙের টেবিল সাথে চারটি চেয়ার, তিন ঘরেই খাট, জাজিম, বালিশ আছে আর কিচেনে আছে গ্যাস চুলা আর একটি ফ্রিজ।

যদিও ড্রয়িং রুমের কার্পেট ছাড়া অন্য সব একেবারেই নতুন জিনিস মনে হলো না। তবে জার্মানিতে সেদিন থেকেই লক্ষ্য করে আসছি, তারা যদি কাউকে কিছু দেন, তাহলে যেন তার কন্ডিশন ভাল থাকে। আর কাপড়-চাদর,এগুলো দিলে ইস্ত্রি করে সুন্দরভাবে হস্তান্তর করেন। তাই সব জিনিসই বেশ পরিচ্ছন্ন মনে হলো। এছাড়া তিনি দিয়েছিলেন বেশ বড় একটা সাদা-কালো টেলিভিশন, যেটা ওই সময় আমাদের জন্য একটা বড় কিছু মনে হয়েছিল।

আর দিয়েছিলেন একটা ছোট রেডিও সেট,যেটা পরবর্তী কয়েক বছর আমার সাথী ছিল। কারণ বন্ধুদের মধ্যে আমি একমাত্র রেডিও শুনতাম। আর তখন শোনা বেশি হত, কারণ সেই সময় জার্মানিতে আমেরিকান সেনাদের জন্য এ. এফ. এন. নামে একটি স্টেশন চালু ছিল। এটা ছিল সম্পূর্ণ ইংরেজিতে। আর মাঝে মাঝে টেলিভিশনও দেখার চেষ্টা করতাম, তবে ভাষার কারণে তেমন কিছুই বুঝতাম না।

 বাড়িঘর তো দেখা হলো, এবার তো পেটের চাহিদা। বাড়িওয়ালাকে আমরা ‘সেফ’ ডাকতাম, সেফ আমাদের যাবার আগে দোকান দেখিয়ে গেল। এইবার জার্মানিতে এসে প্রথম মনে হলো, আমাদের সত্যিকার প্রবাস জীবন শুরু হলো।

আমরা তিনজনই বাসার বেশ কাছে ‘পেনি মার্কেট’-এ গেলাম। বুঝলাম যে জার্মান ভাষায় মার্কেটকে ‘মার্কট’ বলে আর ‘পেনি’ তখন ওদের মুদ্রার নাম। এটা হচ্ছে সস্তার দোকান। ওখানে প্রয়োজনীয় কিছু, যেমন- কলা, চাল, ডিম, পেঁয়াজ, লবণ, আলু, তেল, চা, রুটি, জেলি এবং কয়েকটি কৌটার মাছ কিনে নিয়ে আসলাম। অন্তত আলু সেদ্ধ, ডিম সেদ্ধ আর ভাত খাওয়া যাবে এতে। আর বেশি ক্ষুধা লাগলে কলা,  রুটি ও জেলি তো আছেই।

আগেই বলেছি, প্যাকেটের চাল রান্নার সুবিধা হলো- ১২৫ গ্রামের চালের পাতলা প্যাকেটসহ গরম পানিতে ছেড়ে দিতে হতো। তারপর প্যাকেটগুলো যখন ফুলে ভরে যেত, তখন নামিয়ে কেটে নিতে হত। বাজার শেষে বাসায় ফিরে এসে পাউরুটি, কলা রুটি খেয়ে ও চা পান করে প্রস্তুতি নিতে থাকলাম দুপুরের খাবার তৈরির জন্য। কী আর করবো, আমাদের তিন বীর পুরুষের রান্নার অভিজ্ঞতা তো শূন্য। জীবনে মায়ের রান্নায় সহযোগিতা করা তো দূরের কথা,  কে ক’দিন রান্না ঘরে গিয়ে উঁকি দিয়েছি, সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ! এখানে এসে বুঝতে শুরু করলাম, কী পরগাছার মতোই না আমরা দেশে জীবন কাটিয়েছি।

৪০ বছর আগের ঘটনা যতটুকু মনে পড়ছে, মনে হয় ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে আসার সময় বন্ধুর বাসা থেকে কয়েকটা হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে আসছিলাম। সেগুলোতে আলু, ডিম সেদ্ধ করে আর প্যাকেটের চাল ফুটিয়ে সেদিনকার মতো চালিয়ে নিলাম। এভাবে কাটিয়ে দিলাম আমাদের ওফেনবাখের বাসার প্রথম দিনটি।

তখন কী বুঝতে পেরেছিলাম, এই ‘লুডউইগস্টার ১৬৫’-এর বাসায় আমার জীবনের ৩৪টি বছর কাটবে?

চলবে ...

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!