তখন বেলা প্রায় ১টা। আমরা ১২ জনের দল চলে এসেছি প্রায় ৬শ’ বছরের পুরাতন মসজিদ ষাটগম্বুজে। এটা শুধু বাংলাদেশই নয়, সারা বিশ্বে এক নামে পরিচিত।
Published : 24 Nov 2017, 04:19 PM
১৯৮৩ সালে ষাটগম্বুজ মসজিদটিকে ‘ইউনেসকো’ ওর্য়াল্ড হেরিটেইজ হিসেবে ঘোষণা করার পর থেকে বিশ্বব্যাপি এর পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে।
আসলে আমাদের ছিল পিঠাখাওয়ার দাওয়াত। বন্ধু জামান ভাইয়ের বাড়ি ঝিনাইদহের কালিগঞ্জে। সেখানেই প্রথমে গিয়েছিলাম।
তিনদিন কালিগঞ্জ কাটিয়ে সেই এলাকা ঘুরে ফিলে আমরা রওনা হই ষাটগম্বুজ দেখেতে।
এই ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখতে যেদিন রওনা হব সেদিন ওঠার কথাছিল ভোর পাঁচটায়। কথার খেলাপ আমি করিনি। তবে সময় এর হেরফের করেছিলাম সেদিন।
ঝিনাইদহের প্রকৃতির অপরূপ নৈসর্গিক শোভা দেখতে দেখতে সেই ৯টায় যে যাত্রা শুরু করেছিলাম সেটা থামে প্রাচীন খলিফতাবাদ বা পুদিনার শহর নামে খ্যাত বাগেরহাঁটে। খান জাহান আলী বা রূপসা ব্রিজ হয়ে বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদে পৌঁছতে আমাদের সময় লাগে প্রায় চার ঘণ্টা।
তারপরের কাহিনি তো প্রথমেই জানালাম। পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা ১টা।
ষাটগম্বুজ মসজিদ ইতিবৃত্ত
তবে মসজিদ ব্যাপারটাই ধোঁয়াশা। ৬শ’ বছর আগে এমন জায়গায় মসজিদটি নির্মাণ কী করে হল সেটা একটা গবেষণার ব্যাপার। কারণ কোথাও লেখা বা লিপিবদ্ধ নেই ষাটগম্বুজ মসজিদ নির্মাণের সাল বা এর নির্মাতার নাম।
তবে তুরস্কের স্থাপত্যশৈলীর মতো এর স্থাপত্যশৈলি দেখে ধারণা করা হয় মসজিদটির নির্মাতা খান জাহান আলী (খান-উল-আযম উলুঘ খান-ই-জাহান)।
ধারণা করা হয় ১৫শ’ শতাব্দিতে মসজিদটি নিমার্ণ করা হয়।
এর চারপাশ ঘিরে আছে কোদালধোয়া দিঘী, ঘোড়াদিঘী আর খান জাহান আলীর বসত ভিটা। ৮১টি গম্বুজ নিয়ে গঠিত মসজিদটি কেন ষাটগম্বুজ হল তারও কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
ছাদে ওঠার সিঁড়িটি মসজিদ সুরক্ষার জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
বুরুজের ভেতর দিয়ে মসজিদের ছাদে ওঠার সিঁড়িটি রওশনকোঠা নামে খ্যাত। আর এর উত্তর-পূর্ব কোণের বুরুজটির নাম আন্ধারকোঠা।
ষাটগম্বুজ মসজিদের পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বি ভাবে সাত সারিতে ১১টা করে মোট ৭৭টি গম্বুজ আছে। আর গম্বুজগুলোর ভার বহনের জন্য ছয় সারিতে ১০টি করে মোট ৬০টি পিলার রয়েছে।
বিভিন্ন ঐতিহাসিকরা মনে করেন ৬০ পিলারের জন্যই কালে কালে মসজিদটির নাম হয়ে ওঠে ষাটগম্বুজ। আবার কেউ কেউ মনে করেন, সাতটি সারিবদ্ধ গম্বুজ সারির জন্য মসজিদটির নাম সাতগম্বুজ থেকে ষাটগম্বুজ হয়েছে।
২০ টাকা প্রবেশ ফি দিয়ে আপনাকে ষাটগম্বুজ মসজিদে প্রবেশ করতে হবে। আমরাও তাই করলাম। ১২ জনের প্রায় সবাই ভেতরে প্রবেশ করে যার যার মতো আলাদা হয়ে গেলাম।
জান্নাত সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, আমি ক্যামেরা বের করতেই সে জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে পড়ল, আমিও ফটাফট ছবি তুলে চললাম।
মসজিদের পাশের পায়ে হাঁটার রাস্তাটা দারুণ সুন্দর আর শুক্রবার বলে অস্বাভাবিক ব্যস্ত। কোনো একটা জায়গা যে খালি পাব ছবি তোলার জন্য, তেমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল কম।
জান্নাতের মতোই সুযোগের অপেক্ষায় থাকা! আশপাশে তাকালাম, জামান ভাই ছাড়া আর কাউকে দেখা গেল না।
সঙ্গে সঙ্গে কন্ঠে গান চলে এল- ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি...’
এভাবেই এক সময় নিজেকে ষাটগম্বুজ মসজিদের ভেতর আবিষ্কার করলাম। আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এর নির্মাণশৈলী দেখে চললাম।
তবে নির্মাণকালের কথা মনে হতেই আর এর স্থাপত্যশৈলী দেখে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল ৬শ’ বছর আগে এমন বিরানে এই মসজিদ নির্মাণকাণ্ড।
মসজিদের বা এর প্রধান ফটকের গায়ে তেমন কারুকাজ না থাকলেও এর সৌন্দর্য দারুণ। অসাধারণ নকশায় তৈরি মসজিদটি সব দিক থেকেই পরিপূর্ণ।
নামাজ শেষ হওয়ায় মসজিদের ভেতর মুসল্লিদের চেয়ে দর্শনার্থী অনেক বেশি। বলা যায় গিজগিজ করছে। আমরা স্যান্ডেল খুলে মসজিদের ভেতর প্রবেশ করি।
ঘুরে ঘুরে দেখি আর ছবি তুলে চলি সঙ্গে পিলারগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি।
মসজিদের ভেতর থেকে এবার পেছনে চলে আসি। এখানে তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে আর পেছনে বিশাল দিঘী। এখানেই দেখা হয় দলের অন্য সব সদস্যদের সঙ্গে।
প্রচণ্ড ক্ষিদা পেয়েছিল সবার। তাই দ্রুত ষাটগম্বুজ মসজিদ থেকে বের হয়ে আমরা চুকন নগরের দিকে যাত্রা করি। সেখানের চুইঝালের খাসির মাংস আর আব্বাস হোটেলের গল্প হবে না হয় আরেকদিন!
প্রয়োজনীয় তথ্য
ঢাকা থেকে সরাসরি বাগেরহাট তারপর ষাটগম্বুজ চলে যেতে পারেন।
সায়দাবাদ থেকে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় এই রাস্তায় বাস চলাচল। মন চাইলে খুলনা হয়ে যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে আমার বুদ্ধি সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার চিত্রা ট্রেন। রেলগাড়ি ভ্রমণ আরামদায়ক এবং সুখকর। যে স্মৃতি আপনাকে আজীবন আনন্দ দিয়ে বেড়াবে।
খুলনা থেকে বাগেরহাট ৪০ মিনিটের পথ। এবার সরাসরি বাস বা দল বড় হলে মাইক্রোবাস নিয়ে চলে যান ষাটগম্বুজ মসজিদ।
চাইলে গাবতলি বা শ্যামলি থেকেও বাগেরহাট বা খুলনার বাস ধরতে পারেন। আবার মন চাইলে প্যাডেল চালিত স্টিমারে মোড়লগঞ্জ হয়ে বাগেরহাট ষাটগম্বুজ মসজিদ যেতে পারেন।
বাগেরহাটে সদরে রাতে থাকার ব্যবস্থা করতে পারবেন। আবার খুলনাতেও থাকার ব্যবস্থা করে আসতে পারেন।
বাগেরহাটে বেশ কিছু প্রাচীণ স্থাপনা ও মসজিদসহ দেখে আসবেন। এখানকার দুটি পার্ক আর খান জাহান আলী (রহ.)য়ের মাজার বা সমাধিসৌধ।
ছবি: লেখক।
আরও পড়ুন