হাঁসজারু, বকচ্ছপ, হাতিমি- নামগুলো কেমন চেনা চেনা ঠেকছে, তাই না? ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কু- এবার তো সঙ্গে সঙ্গেই চিনে ফেলেছো। এদের সঙ্গে কাদের নাম জড়িত, বলো তো? অদ্ভূত প্রাণীগুলোর ¯্রস্টা সুকুমার রায়। আর পরে তোমাদের প্রিয় যে দুটো চরিত্রের নাম বললাম, তাদের ¯্রস্টা সত্যজিৎ রায়। এরা কিন্তু আবার বাপ-বেটা। আর সুকুমারের বাবা, মানে সত্যজিতের দাদার নাম জানো তো? উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। এই তিনজনের কিন্তু একটা পত্রিকার সঙ্গে যাকে বলে নাড়ির যোগ ছিল। পত্রিকার নামটি বলতে পারবে? হ্যাঁ, ‘সন্দেশ’।
Published : 30 Mar 2013, 07:38 AM
সন্দেশ পত্রিকাটিতে নাড়ির যোগ কেমন ছিল? পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতাই যে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। পর্যায়ক্রমে তিনজনেই পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু তাই নয়, উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার আর সত্যজিৎ- এই তিনজনের ছোটদের জন্য যতো লেখা, তার বেশিরভাগই ছাপা হয়েছিল এই পত্রিকাতেই। উপরে যে হাঁসজারু- বকচ্ছপ- হাতিমি আর ফেলুদা- প্রফেসর শঙ্কুর নাম বললাম, এই লেখাগুলোও প্রথম ছাপা হয়েছিল সন্দেশে-ই।
‘সন্দেশ’-এর গল্প শুরু করার আগে বলে রাখি, এই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গল্প কিন্তু তোমাদের একবার শুনিয়েছি; মনে আছে তো? মনে না থাকলেও সমস্যা নেই, লিঙ্ক দিয়ে দিচ্ছি, পড়ে নাও-
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গল্প (http://kidz.bdnews24.com/mainStory.php?mainstoryid=202)
তো, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বিয়ে করলেন ১৮৮৫ সালে। বিয়ের পরপর ১৩ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাসায় থাকতে শুরু করলেন। পরে এই বাড়ি ছেড়ে উঠলেন ৭ নম্বর শিবনারায়ণ দাস লেনের বাড়িতে। এই বাড়িটিও পরে ছেড়ে দেন, ওঠেন ২২ নম্বর সুফিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে (এখন এর নাম কৈলাস বোস স্ট্রিট)। এই বাড়িতেই তিনি তার বিখ্যাত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন; নাম ‘ইউ রায় এন্ড সন্স’। আর এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে, এই বাড়ি থেকেই ১৯১৩ সালে প্রথম সন্দেশ প্রকাশিত হয়। সে সময়ে উপেন্দ্রকোশোর সবে ৫০-এ পা দেবেন।
উপেন্দ্রকিশোর যখন তোমাদের জন্য লেখালেখি শুরু করলেন, তখনো বাংলাসাহিত্যে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো শিশুসাহিত্যিকই নেই; বলতে পারো তিনি এক্ষেত্রে দিকপাল। আর তার হাত ধরে যে শিশুপত্রিকার যাত্রা শুরু হলো, সে পত্রিকা কতোটা জনপ্রিয় হতে পারে, তা একবার চিন্তা করেই দেখো। খুব শিগগিরই নামডাক হয়ে গেলো সন্দেশের।
কিন্তু উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বেশিদিন বাঁচেননি; মারা যান পত্রিকাটি প্রকাশ করার আড়াই বছরের মাথায়। ১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর। তাতে কী আর সন্দেশ বন্ধ হবে? তার সুযোগ্য পুত্র সুকুমার আছেন না! এবার সম্পাদনার ভার কাঁধে নিলেন তিনি। আর জানোই তো, শিশুসাহিত্যিক হিসেবে সুকুমার ছিলেন বাবার চেয়েও এককাঠি বেশি; তার হাতে সন্দেশ আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। সন্দেশে হাসি-কৌতুকের সঙ্গে যুক্ত হলো বিজ্ঞানের নানা বিষয়ও। সন্দেশ সম্পাদনাকালে, সন্দেশের জন্য তিনি কী কী লিখেছিলেন জানো? মোটমাট ১০৩টি কবিতা, ৮৮টি গল্প, ১২২টি প্রবন্ধ, ৮টি নাটক আর ২টি বড়ো গল্প। আর তার সম্পাদক থাকার সময়ে পত্রিকায় প্রকাশিত সবগুলো ছবিও তিনি-ই এঁকেছিলেন।
সুকুমার রায় তার বাবার চেয়েও কম বয়সে মারা যান; ১৯২৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বরে যখন তিনি মারা যান, তার বয়স মোটে ৩৬। সুকুমার রায়ের সন্তান ছিল একজনই- সত্যজিত রায়। সত্যজিতের বাবা সুকুমার যেমন প্রতিভায় উপেন্দ্রকিশোরের নাম রেখেছিলেন, তেমনি সত্যজিতও কম যান না। শিশুসাহিত্যিক তো বটেই, বিশ্ব চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা নির্মাতাদেরও একজন হয়ে উঠেছিলেন সত্যজিত রায়।
না, সুকুমারের মৃত্যুর পরই সত্যজিত সন্দেশের হাল ধরেননি; ধরেছিলেন সুকুমারের ভাই সুবিনয়। কিন্তু ঠিকমতো চালাতে পারলেন না; ১৯২৫ সালে বন্ধ হয়ে গেল সন্দেশ। ১৯২৯ সালে হাতবদল হলো তাদের পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইউ রায় এন্ড সন্সের, আবারো চালু হলো সন্দেশ; সম্পাদক হিসেবে থেকে গেলেন সুবিনয় রায়। এবার ইউ রায় এন্ড সন্সেরই গণেশ উল্টালো, মানে বন্ধ হয়ে গেলো, সেই সাথে বন্ধ হয়ে গেলো সন্দেশ-ও।
একই বছরে, মানে ১৯৬৩ সালেই সত্যজিৎ রায় ‘সুকুমার সাহিত্য সমবায় সমিতি’ নামে একটি অলাভজনক সমবায় সমিতি গঠন করলেন; সন্দেশ পরিচালনার ভার অর্পণ করলেন এই সমিতির উপরেই। এমনকি এখনো এই সমিতি-ই সন্দেশ চালাচ্ছে। ১৯৭৪ সালে সত্যজিতের মাসতুতো বোন নলিনী দাসকে সন্দেশের আরেকজন সহসম্পাদক করা হয়; আর তার স্বামী অশোকানন্দ দাস হন সম্মানসূচক প্রকাশক।
উপেন্দ্রকিশোর আর সুকুমারের সন্দেশ ছিলো কেবলই ছোট্টদের পত্রিকা; সত্যজিতের হাত ধরে তা কিশোরদেরও হয়ে উঠলো; সত্যজিতের দুই অমর চরিত্র ফেলুদা আর প্রফেসর শঙ্কুর আবির্ভাব এই সন্দেশেই। তবে সন্দেশে সত্যজিতের প্রথম যে গল্পটি প্রকাশিত হয়, সেটি অবশ্য তেমন পরিচিত নয়। গল্পটির নাম, ‘বঙ্কু বাবুর বন্ধু’। সত্যজিত পরে এই গল্পটি নিয়ে একটি সিনেমার স্ক্রিপ্টও বানান, ‘দি এলিয়েন’ নামে। আফশোষের বিষয়, শেষ পর্যন্ত তিনি আর সিনেমাটি বানাতে পারেননি। বানালে কী মজাই যে হতো!
তবে সুকুমার রায়ের মতোই, তিনিও সন্দেশে বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে লেখার ব্যাপারটা চালু রাখেন। সাথে যোগ করেন কমিক স্ট্রিপ, লিমেরিক ইত্যাদি। একটি অংশে ষোল বছরের কমবয়সীরা নিজেদের লেখা ও আঁকা ছাপাতে পারতো; বিভাগটির নামটিও ছিল দারুণ- ‘হাত পাকাবার আসর’।
সন্দেশের গল্পের মধ্যে এই অংশটা যেন ঠিক খাপ খাচ্ছে না, তাই না? টানা এতোদিন কী আর সন্দেশ কোনো ঝক্কি ছাড়া চলেছে? আর তাই এবার বিপদটা আসলোও অনেক বড়ো। ১৯৯২-৯৩ সালে, মাত্র ১৪ মাসের মধ্যেই মারা গেলেন সত্যজিৎ রায়, নলিনী দাস আর অশোকানন্দ দাস। পরের বছরই অসুস্থ হয়ে পড়লেন লীলা মজুমদার। সব মিলিয়ে সন্দেশ চালানোই দায় হয়ে পড়লো।
ভাবছো, সত্যজিৎ রায়ের বুঝি ছেলে নেই? থাকবে না কেন, আছে না- সন্দ্বীপ রায়। তাই বলে কী আর সত্যজিৎ রায়ের মতো হওয়া সম্ভব নাকি! সন্দ্বীপ রায় অবশ্য বাবার অনেক কাজেই হাত দিয়েছেন; গুপী গাইন বাঘা বাইনকে নিয়ে বানানো সত্যজিৎ রায়ের নিনেমাগুলো দেখেছো না? এর মধ্যে তিন নম্বরটি, মানে ‘গুপী বাঘা ফিরে এলো’ তো সত্যজিৎ রায় বানিয়ে যেতে পারেননি, কেবল চিত্রনাট্য লিখে গিয়েছিলেন; সন্দ্বীপ রায়-ই না সেটা বানিয়েছেন। সত্যজিৎ ফেলুদার মোটে দুটো উপন্যাস নিয়ে সিনেমা বানাতে পেরেছিলেন- ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ আর ‘সোনার কেল্লা’। অন্যগুলো, আর ফেলুদাকে নিয়ে যে টিভি সিরিয়াল, সেগুলোও তো সন্দ্বীপের বানানো। কিছুদিন আগে যে ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ মুক্তি পেলো, সেটিও সন্দ্বীপ রায়েরই বানানো। সত্যজিতের মতো যুগান্তকারী প্রতিভা না থাকলেও, সন্দ্বীপ রায়ও কম প্রতিভাবান নন, তা তো বুঝতেই পারছো।
তাই বলে সন্দেশের মতো পত্রিকা হারিয়ে যাবে? তাই কি এতো সহজে হতে দেওয়া যায়? কক্ষণো না। তাই এবার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলো ফোর্ড ফাউন্ডেশন; সন্দেশকে পুনর্জীবিত করতে তারা কিছু অর্থসাহায্যও করলো। এবার সন্দেশ রঙিন সাজে সাজলো, চেহারাও বেশ সুশ্রী হয়ে উঠলো। কিন্তু সমবায় সমিতির মতানৈক্যের কারণে, এ যাত্রায়ও সন্দেশ আর্থিকভাবে সচল হতে পারলো না। ২০০৫ সাল থেকে আবারও প্রায়ই দু-একটি সংখ্যা বাদ পড়তে লাগলো।
২০০৬ সালে অগাস্ট মাস থেকে, আবারো নতুন উদ্যমে সন্দেশকে চালু করা হয়েছে। চারটি অপ্রকাশিত সংখ্যার পর, সে বছরের শারদীয় সন্দেশ বের করা হয়েছে নতুন উদ্যমে। তারপর থেকে নিয়মিতই চেষ্টা করা হচ্ছে সন্দেশ প্রকাশের।
তো, ‘সন্দেশ’-এর গল্প তো শুনলে, এবার সন্দেশ খাবে কিনা, সে তো আর আমি জানি না, সে তোমাদের বিষয়। তবে, খাও আর না খাও, সন্দেশের একশ’ বছরপূর্তির কথাটা কিন্তু মনে রেখো, কেমন? আর যাদের সন্দেশ পত্রিকাটি পড়ার সুযোগ হয়নি, তারা অবশ্য সত্যজিতের সম্পাদনায় ‘সেরা সন্দেশ’ পড়ে দেখতে পারো।